রমা

নাট্যোল্লিখিত ব্যক্তিগণ

পুরুষ

বেণী ঘোষাল জমিদার

রমেশ ঘোষাল ঐ খুল্লতাত-পুত্র

মধু পাল মুদী

বনমালী পাড়ুই হেডমাস্টার

যতীন … যদুনাথ মুখুয্যের কনিষ্ঠ পুত্র, রমার ভাই

গোবিন্দ গাঙ্গুলী

ধর্মদাস চাটুয্যে

ভৈরব আচার্য গ্রামবাসিগণ

দীননাথ ভট্টাচার্য

ষষ্ঠীচরণ

পরাণ হালদার

ভজুয়া রমেশের হিন্দুস্থানী দরোয়ান

গোপাল সরকার ঐ সরকার

দীনু ভট্টাচার্যের ছেলে-মেয়েরা, ময়রা, ভৃত্য, খরিদ্দারগণ, বাঁড়ুয্যে, নাপিত, যাত্রী, কর্মচারী, ভিখারিগণ, কুলদা, কৃষকগণ, আকবর, গহর, ওসমান, বৈষ্ণব, সরকার, সনাতন হাজরা, জগন্নাথ, নরোত্তম, দরোয়ান, ইত্যাদি।

স্ত্রী

বিশ্বেশ্বরী বেণীর মা

রমা যদু মুখুয্যের কন্যা

রমার মাসি, সুকুমারী, ক্ষান্ত, খেঁদী, নন্দর মা, ভিখারিণীগণ, বৈষ্ণবী, লক্ষ্মী, ইত্যাদি।

প্রথম অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

[৺যদুনাথ মুখুয্যে মহাশয়ের বাটীর পিছনের দিক। খিড়কির দ্বার খোলা, সম্মুখে অপ্রশস্ত পথ। চারিদিকে আম-কাঁঠালের বাগান এবং অদূরে পুষ্করিণীর বাঁধানো ঘাটের কিয়দংশ দেখা যাইতেছে। সকালবেলায় রমা ও তাহার মাসী স্নানের জন্য বাহির হইয়া আসিল এবং ঠিক সেই সময়েই বেণী ঘোষাল আর একদিক দিয়া প্রবেশ করিল। রমার বয়স বাইশ-তেইশের বেশি নয়। অল্প বয়সে বিধবা হইয়াছিল বলিয়া হাতে কয়েকগাছি চুড়ি ছিল, এবং থানের পরিবর্তে সরু পাড়ের কাপড় পরিত। বেণীর বয়সও পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশের অধিক হইবে না]

বেণী। তোমার কাছেই যাচ্ছিলেম রমা।

মাসী । তা খিড়কির দোর দিয়ে কেন বাছা?

রমা। তোমার এককথা মাসী । বড়দা ঘরের লোক, ওঁর আবার সদর-খিড়কি কি? কিছু দরকার আছে বুঝি? তা ভেতরে গিয়ে একটু বসুন না, আমি চট করে ডুবটা দিয়া আসি।

বেণী। বসবার জো নেই দিদি, ঢের কাজ। কিন্তু কি করবে স্থির করলে?

রমা। কিসের বড়দা?

বেণী। আমার ছোটখুড়োর শ্রাদ্ধের কথাটা বোন। রমেশ ত কাল এসে পৌঁছেছে। বাপের শ্রাদ্ধ নাকি খুব ঘটা করেই করবে। যাবে নাকি?

রমা! আমি যাবো তারিণী ঘোষালের বাড়ি!

বেণী। সে ত জানি দিদি, আর যেই কেন না যাক, তোরা কিছুতেই সে বাড়িতে পা দিবিনে। তবে শুনতে পেলাম ছোঁড়া নিজে গিয়ে সমস্ত বাড়ি-বাড়ি বলে আসবে। বজ্জাতি বুদ্ধিতে সে তার বাপের ওপরে যায়। যদি সত্যই আসে কি বলবে?

রমা। আমি কিছুই বলবো না বড়দা,—বাইরের দরোয়ান তার জবাব দেবে।

মাসী । দরোয়ান কেন লা, আমি বলতে জানিনে? নচ্ছার ব্যাটাকে এমনি বলাই বোলব যে, বাছাধন জন্মে কখনো আর মুখুয্যেবাড়িতে মাথা গলাবে না। তারিণী ঘোষালের ছেলে ঢুকবে নেমন্তন্ন করতে আমার বাড়িতে! আমি কিছুই ভুলিনি বেণীমাধব। তারিণী এই ছেলের সঙ্গেই আমার রমার বিয়ে দিতে চেয়েছিল। তখনো ত যতীন জন্মায় নি, ভেবেছিলো যুদু মুখুয্যের সমস্ত বিষয়টা তা হলে মুঠোর মধ্যে আসবে। বুঝলে না বাবা বেণী!

বেণী। বুঝি বৈ কি মাসী, সব বুঝি।

মাসী । বুঝবে বৈ কি বাবা, এ ত পড়েই রয়েচে। আর তা যখন হল না তখন ঐ ভৈরব আচায্যিকে দিয়ে কি-সব জপ-তপ, তুকতাক করিয়ে মায়ের কপালে আমার এমনি আগুন জ্বেলে দিলে যে, ছ’মাস পেরুল না বাছার হাতের নোয়া মাথার সিঁদুর ঘুচে গেল। ছোট জাত হয়ে চায় কিনা মুখুয্যের মেয়েকে বৌ করতে! তেমনি হারামজাদার মরণও হয়েছে। সদরে গেল মকর্দমা করতে আর ঘরে ফিরতে হল না। এক ব্যাটা, তার হাতের আগুনটুকু পর্যন্ত পেলে না। ছোট জাতের মুখে আগুন!
রমা। কেন মাসী, তুমি লোকের জাত তুলে কথা কও? তারিণী ঘোষাল বড়দারই ত আপনার খুড়ো। বামুন মানুষকে ছোট জাত বল কি করে? তোমার মুখে যেন কিছু বাধে না।

বেণী। (সলজ্জে) না রমা, মাসী সত্যি কথাই বলচেন। তুমি কতবড় কুলীনের মেয়ে, তোমাকে কি আমরা ঘরে আনতে পারি বোন? ছোটখুড়োর এ কথা মুখে আনাই বেয়াদবি। আর তুকতাকের কথা যদি বল ত সে সত্যি। দুনিয়ায় ছোটখুড়ো আর ভৈরবের অসাধ্য কাজ কিছু নেই। রমেশ আসতে না আসতেই ঐ ব্যাটাই ত জুটে গিয়ে হয়েছে তার মুরুব্বি।

মাসী । সে ত জানা কথা বেণী। ছোঁড়া বছর দশ-বারো ত দেশে আসেনি।—সেই যে মামারা এসে কাশী না কোথায় নিয়ে গেল আর কখনো এ মুখো হতে দিলে না। এতকাল ছিল কোথায়? করছিল কি?

বেণী। কি করে জানবো মাসী! ছোটখুড়োর সঙ্গে তোমাদেরও যে ভাব আমাদেরও তাই। শুনচি, এতদিন বোম্বাই না কোথায় ছিল। কেউ বলচে ডাক্তারি পাস করেচে, কেউ বলচে উকিল হয়েচে,—আবার কেউ বলচে সব ফাঁকি। ছোঁড়া নাকি পাঁড় মাতাল। যখন বাড়ি এসে পৌঁছল, তখন চোখ-দুটো ছিল নাকি জবাফুলের মত রাঙা।

মাসী । বটে! তা হলে ত তাকে বাড়ি ঢুকতে দেওয়াই যায় না।

বেণী। কিছুতে না। হাঁ রমা, তোমার রমেশকে মনে পড়ে?

রমা। (সলজ্জ মৃদু হাসিয়া) এ ত সেদিনের কথা বড়দা। তিনি আমার চেয়ে বছর-চারেকের বড়। এক পাঠশালায় পড়েচি, একসঙ্গে খেলা করেচি, ওঁদের বাড়িতেই ত থাকতাম। খুড়ীমা আমাকে মেয়ের মত ভালবাসতেন।

মাসী । তার ভালবাসার মুখে আগুন। ভালবাসা ছিল কেবল কাজ হাসিল করবার জন্যে। তাদের ফন্দিই ছিল কোনমতে তোকে হাত করা। কম ধড়িবাজ ছিল রমেশের মা!

বেণী। তাতে আর সন্দেহ কি। ছোটখুড়ীও যে—

রমা। দেখো মাসি, তোমাদের আর যা ইচ্ছে বল, কিন্তু খুড়ীমা আমার স্বর্গে গেছেন, তাঁর নিন্দে আমি কারও মুখ থেকেই সইতে পারবো না।

মাসী । বলিস কি লো? একেবারে এতো?

বেণী। তা বটে, তা বটে। ছোটখুড়ী ভালমানুষের মেয়ে ছিলেন। তাঁর কথা উঠলে মা আজও চোখের জল ফেলেন। তা সে যাক, কিন্তু এই ত স্থির রইল দিদি, নড়চড় হবে না ত?

রমা। (হাসিয়া) না। বড়দা, বাবা বলতেন আগুনের শেষ, ঋণের শেষ, আর শত্রুর শেষ কখনো রাখিস নে রমা। তারিণী ঘোষাল জ্যান্তে আমাদের কম জ্বালা দেয়নি—বাবাকে পর্যন্ত জেলে দিতে গিয়েছিল। আমি কিছুই ভুলিনি বড়দা, যতদিন বেঁচে থাকবো ভুলবো না। রমেশ সেই শত্রুরই ছেলে। আমরা ত নয়ই—আমাদের সংস্রবে যারা আছে তাদের পর্যন্ত যেতে দেব না।

বেণী। এই ত চাই। এই ত তোমার যোগ্য কথা।

রমা। আচ্ছা বড়দা, এমন করা যায় না যে কোন ব্রাহ্মণ না তার বাড়ি যায়? তা হলে—বেণী। আরে, সেই চেষ্টাই ত করচি বোন। তুই শুধু আমার সহায় থাকিস আর আমি কোন চিন্তা করিনে। রমেশকে এই কুঁয়াপুর থেকে না তাড়াতে পারি ত আমার নামই বেণী ঘোষাল নয়। তারপরে রইলাম আমি আর ঐ আচায্যিব্যাটা। ছোটখুড়ো আর বেঁচে নেই, দেখি তাকে কে রক্ষা করে!

রমা। (হাসিয়া) রক্ষে করবেন বোধ করি রমেশ ঘোষাল। কিন্তু আমি বলে রাখলেম বড়দা, আমাদের শত্রুতা করতে ইনিও কম করবেন না।

বেণী। (এদিক-ওদিক চাহিয়া এবং কণ্ঠস্বর আরও মৃদু করিয়া) রমা, আসল কথা হচ্চে, বিষয়-সম্পত্তির ব্যাপার সে আজও কিছুই বোঝে না। বাঁশ নুইয়ে ফেলতে চাও ত এই সময়। পেকে উঠলে আর হবে না তা তোমাকে নিশ্চয় বলে দিচ্চি। দিনরাত মনে রাখতে হবে এ তারিণী ঘোষালের ছেলে আর কেউ নয়। চেপে বসলে আর—

[অন্তরাল হইতে গম্ভীর-কণ্ঠের ডাক আসিল,—“রানী কৈ রে?” রমা চকিত হইয়া উঠিল। এবং পরক্ষণেই দ্বারের ভিতর দিয়া রমেশ প্রবেশ করিল। তাহার রুক্ষ মাথা, খালি পা, উত্তরীয়টা মাথায় জড়ান। বেণীর প্রতি দৃষ্টি পড়িতেই—]

রমেশ। এই যে বড়দা এখানে? বেশ, চলুন। আপনি নইলে করবে কে? আমি সারা গাঁ আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্চি। রানী কৈ? বাড়ির মধ্যে দেখি কেউ নেই। ঝি বললে এই দিকে গেছে—

[রমা নতমুখে দাঁড়াইয়া ছিল, সহসা তাহাকে পাইয়া]

রমেশ। আরে এই যে! ইস! কত বড় হয়েচো! ভালো আছো ত? আমাকে চিনতে পারচো না বুঝি? আমি তোমাদের রমেশদা।

রমা। (মুখ তুলিয়া চাহিল না, কিন্তু অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল) আপনি ভাল আছেন?

রমেশ। হাঁ ভাই ভাল আছি। কিন্তু আমাকে ‘আপনি’ কেন রানী? (বেণীর দিকে চাহিয়া) রমার একটি কথা আমি কোনদিন ভুলতে পারিনি বড়দা। মা যখন মারা গেলেন তখন ত ও ছোট; কিন্তু তখনি আমার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলেছিল, তুমি কেঁদো না রমেশদা, আমার মাকে আমরা দুজনে ভাগ করে নেব। তোমার বোধ হয় মনে পড়ে না, না? আমার মাকে মনে পড়ে ত?

[রমা নিরুত্তর, লজ্জায় যেন তাহার মাথা আরও হেঁট হইয়া গেল]

রমেশ। কিন্তু আর ত সময় নেই ভাই। যা করবার করে দাও,—যাকে বলে একান্ত নিরাশ্রয় আমি তাই হয়েই আবার তোমাদের দোরগোড়ায় ফিরে এসে দাঁড়িয়েচি। তোমরা না গেলে এতটুকু ব্যবস্থা পর্যন্ত হয়ত হবে না।

মাসী । (কাছে আসিয়া রমেশের মুখের দিকে চাহিয়া) তুমি বাপু তারিণী ঘোষালের ছেলে না?

[রমেশ নিঃশব্দ বিস্ময়ে চাহিয়া রহিল]

মাসী । আগে ত দেখনি, চিনতে পারবে না বাছা,—আমি রমার আপনার মাসী । কিন্তু এমন বেহায়া পুরুষমানুষ তোমার মত আর ত দেখিনি। যেমন বাপ তেমনিই কি ব্যাটা! বলা নেই কহা নেই, একটা গেরস্তর বাড়ির অন্দরে ঢুকে উৎপাত করতে শরম হয় না তোমার?

রমা। কি বকচো মাসী, নাইতে যাও না।

[বেণীর নিঃশব্দে প্রস্থান]

মাসী । নে রমা বকিস নে। যে কাজ করতেই হবে তাতে তোদের মত আমার চক্ষুলজ্জা হয় না। বলি, বেণীর অমন কোরে পালানোর কি দরকার ছিল? বলে গেলেই ত হোত, আমরা বাপু তোমার গোমস্তাও নই, খাস-তালুকের প্রজাও নই যে, তোমার কর্মবাড়িতে জল তুলতে ময়দা মাখতে যাবো। তারিণী মরেচে লোকের হাড় জুড়িয়েছে। এ কথাটা বলার বরাত আমাদের মত দুজন মেয়েমানুষের ওপর না দিয়ে নিজে বলে গেলেই ত পুরুষের মত কাজ হোতো।

[রমেশ নির্বাক পাথরের মূর্তির মত দাঁড়াইয়া রহিল]

মাসী । যাই হোক, বামুনের ছেলেকে আমি চাকর-বাকর দিয়ে অপমান করতে চাইনে, একটু হুঁশ করে কাজ কোরো। কচিখোকাটি নও যে লোকের বাড়িতে ঢুকে আবদার করে বেড়াবে। রানী কি? রানী ওর নাম নাকি? তোমার বাড়িতে আমার রমা কখনো পা ধুতে যেতেও পারবে না। এই তোমাকে আমি বলে দিলাম।

রমেশ। তোমাকে মা বলতেন রানী, ছেলেবেলার সেই ডাকটাই মনে ছিল রমা। আমি ত জানতাম না যে, আমাদের বাড়িতে তুমি যেতেই পারো না। না জেনে যে উপদ্রব করে গেলাম সে আমাকে তুমি ক্ষমা করো রমা।

[রমেশের প্রস্থান ও বেণীর আবির্ভাব]

বেণী। (তাহার সমস্ত মুখ খুশীতে ভরিয়া গিয়াছে) হাঁ, শোনালে বটে মাসী । আমাদের সাধ্যিই ছিল না অমন করে বলা। এ কি চাকর-বাকরদের কাজ রমা? আমি আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখলাম কিনা, ছোঁড়া মুখখানা যেন আষাঢ়ের মেঘের মত করে বেরিয়ে গেল। এই ত ঠিক হল।

মাসী । হল ত জানি, কিন্তু মেয়েমানুষের ওপর ভার না দিয়ে, না সরে গিয়ে নিজে বললেই ত আরো ভাল হতো। আর না-ই যদি বলতে পারতে, আমি কি বললাম দাঁড়িয়ে থেকে শুনে গেলে না কেন বাছা?

রমা। দুঃখ কোরো না মাসী, উনি না শুনুন আমরা শুনেচি। যে যতই বলুক না কেন, এতখানি বিষ জিভ দিয়ে ছড়াতে তোমার মত আর কেউ পেরে উঠত না।

মাসী । কি বললি লা?

রমা। কিছু না। বলি, রান্নাবান্না কি আজ হবে না? যাও না ডুবটা দিয়ে এসো না।

[পুষ্করিণীর উদ্দেশে রমার দ্রুতপদে প্রস্থান]

বেণী। ব্যাপার কি মাসী?

মাসী । কি করে জানবো বাছা? ও রাজরানীর মেজাজ বোঝা কি আমাদের মত দাসীবাঁদীর কর্ম?

[প্রস্থান

[গোবিন্দ গাঙ্গুলীর প্রবেশ]

গোবিন্দ। ভ্যালা যা হোক। সকাল থেকে সারা গাঁ-টা খুঁজে বেড়াচ্চি বেণীবাবু গেল কোথায়! বলি শুনেচ খবরটা? বাবাজী কাল ঘরে পা দিয়েই ছুটেছিলেন নন্দীদের ওখানে।

এ যদি না দু’দিনে উচ্ছন্ন যায় ত আমার গোবিন্দ গাঙ্গুলী নাম তোমরা বদলে রেখো। নবাবী কাণ্ড-কারখানার ফর্দ শোন ত অবাক হয়ে যাবে। তারিণী ঘোষাল সিকি পয়সা রেখে মরেনি তা জানি, তবে এত কেন? হাতে থাকে কর্‌, না থাকে বিষয় বন্ধক দিয়ে কে কবে ঘটা করে বাপের শ্রাদ্ধ করে তা ত কখনো শুনিনি বাবা। আমি তোমাকে নিশ্চয় বলচি বেণীমাধববাবু, এ ছোঁড়া নন্দীদের গদী থেকে অন্ততঃ পাঁচটি হাজার টাকা দেনা করেচে।

বেণী। বল কি! তা হলে কথাটা ত বার করে নিতে হচ্ছে গোবিন্দখুড়ো?

গোবিন্দ। (মৃদু হাস্য করিয়া) সবুর করো না বাবাজী, একবার ভাল করে ঢুকতেই দাও না। তার পরে নাড়ীর খবর ফেড়ে বার করে আনবো—তখন বুঝবে গোবিন্দ গাঙ্গুলীকে। এর মধ্যে অনেক কথাই শুনতে পাবে বাবাজী, অনেক শালাই লাগিয়ে যাবে,—কিন্তু চেনো ত খুড়োকে? সেইটুকু মনে মনে বুঝো, এখন আর কিছু ফাঁস করচি নে।

বেণী। রমার কাছে এসেছিলাম।

গোবিন্দ। তা জানি। কি বলে সে?

বেণী। তারা ত নয়ই, তাদের সম্পর্কে যে যেখানে আছে তারা পর্যন্ত নয়।

গোবিন্দ। ব্যস্‌! ব্যস্‌! আর দেখতে হবে না।

বেণী। কিন্তু তোমরা যে—

গোবিন্দ। উতলা হও কেন বাবাজী, আগে ঢুকি। উদ্যোগ আয়োজনটা একটু ভাল করে করাই, তখন না,—ছাদ্দ-গড়ানো কাকে বলে একবার বাইরে দাঁড়িয়ে দেখো!

বেণী। তবে যে শুনি—

গোবিন্দ। অমন ঢের শুনবে বাবাজী, অনেক ব্যাটা এসে অনেক রকম করে লাগাবে। কিন্তু গোবিন্দখুড়োকে চেনো ত? ব্যস্‌! ব্যস্‌!

দ্বিতীয় দৃশ্য

[রমেশের বহির্বাটী। চণ্ডীমণ্ডপের বারান্দার একধারে ভৈরব আচার্য থান ফাড়িয়া কাপড় পাট করিয়া গাদা দিতেছে। চণ্ডীমণ্ডপের অভ্যন্তরে বসিয়া গোবিন্দ গাঙ্গুলী ধূমপান করিতেছে এবং আড়চোখে চাহিয়া বস্ত্ররাশির মনে মনে সংখ্যা-নিরূপণ করিতেছে। কর্মবাড়ি। আসন্ন শ্রাদ্ধকৃত্যের বহুবিধ আয়োজন চারিদিকে বিক্ষিপ্ত। নানা লোক নানা কাজে ব্যস্ত। সময় অপরাহ্ণ]

[রমেশের প্রবেশ]

রমেশ। (গোবিন্দ গাঙ্গুলীর প্রতি সবিনয়ে) এই যে আপনি এসেচেন।

গোবিন্দ। আসবো বৈ কি বাবা, আসবো বৈ কি! এ যে আমার আপনার কাজ রমেশ।

[নেপথ্যে কাশির শব্দ। কাশিতে কাশিতে চার-পাঁচটি ছেলেমেয়ে লইয়া ধর্মদাস চাটুয্যের প্রবেশ। তাঁহার কাঁধের উপর মলিন উত্তরীয়, নাকের উপর একজোড়া ভাঁটার মত মস্ত চশমা পিছনে দড়ি দিয়া বাঁধা। সাদা চুল, সাদা গোঁফ তামাকের ধূঁয়ায় তাম্রবর্ণ। অগ্রসর হইয়া রমেশের মুখের প্রতি ক্ষণকাল চাহিয়া কোন কথা না কহিয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন। রমেশ চিনিল না ইনি কে। কিন্তু যেই হোন, ব্যস্ত হইয়া হাত ধরিতেই—]

ধর্মদাস। (কাঁদিয়া) না বাবা রমেশ, তারিণী যে এমন করে ফাঁকি দিয়ে পালাবে তা স্বপ্নেও জানিনে। কিন্তু আমারও এমন চাটুয্যে-বংশে জন্ম নয় যে কারু ভয়ে মুখ দিয়ে মিথ্যে কথা বেরুবে। আসবার সময় তোমার আপন জাঠতুতো ভাই বেণী ঘোষালের মুখের উপর কি বলে এলাম জানো? বললাম, রমেশ যেমন শ্রাদ্ধের আয়োজন করচে, এমন করা চুলোয় যাক, এ-অঞ্চলে কেউ চোখেও দেখেনি। আমার নামে অনেক শালা অনেক রকম তোমার কাছে লাগিয়ে যাবে বাবা, কিন্তু এটা নিশ্চয় জেনো, এই ধর্মেরই শুধু ধর্মেরই দাস, আর কারও নয়।

[এই বলিয়া গোবিন্দর হস্ত হইতে হুঁকোটা ছিনাইয়া লইয়া
এক টান্‌ দিয়াই প্রবল বেগে কাশিয়া ফেলিলেন]

রমেশ। না না, বলেন কি, বলেন কি—

[প্রত্যুত্তরে ধর্মদাস ঘড়ঘড় করিয়া কত কি বলিলেন, কিন্তু কাশির ধমকে তাহার একটা বর্ণও বুঝা গেল না। গোবিন্দ সর্বাগ্রে আসিয়াছিলেন, সুতরাং এই নবীন জমিদারটিকে ভাল ভাল কথা বলিবার সুযোগ তাঁহারই ছিল, অথচ নষ্ট হইতেছে বুঝিয়া তিনি তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইলেন]

গোবিন্দ। কাল সকালে, বুঝলে ধর্মদাসদা, এখানে আসবো বলে বেরিয়েও আসা হল না। বেণীর ডাকাডাকি—গোবিন্দখুড়ো তামাক খেয়ে যাও। একবার ভাবলেম কাজ নেই,—তার পরে মনে হল ভাবখানা বেণীর দেখেই যাইনে। বেণী কি বললে জানো বাবা রমেশ, বলে খুড়ো, তোমরা ত দেখচি হয়েচ রমেশের মুরুব্বি, বলি লোকজন খাবে-টাবে ত? আমিই বা ছাড়ি কেন,—তুমি বড়লোক আছো না-আছো, আমার রমেশও কারো চেয়ে খাটো নয়। তোমার ঘরে ত একমুঠো চিঁড়ের পিত্যেশ কারু নেই। বললাম, বেণীবাবু, এই ত পথ—দাঁড়িয়ে একবার কাঙ্গালী-বিদেয়ের ঘটাটা দেখো। কালকের ছেলে রমেশ, কিন্তু বুকের পাটা ত বলি একে। কিন্তু তাও বলি ধর্মদাসদা, আমাদের সাধ্যই বা কি! যাঁর কাজ তিনিই ওপরে থেকে করাচ্চেন। তারিণীদা শাপভ্রষ্ট দিকপাল ছিলেন বৈ ত নয়।

[ধর্মদাসের কিছুতেই কাশি থামে না, আর তাহারই সম্মুখে গোবিন্দ বেশ বেশ কথাগুলি এই অপরিপক্ক তরুণ জমিদারটিকে বলিয়া যাইতেছে দেখিয়া আরও ভাল বলিবার চেষ্টায় ধর্মদাস যেন আকুলি-বিকুলি করিতে লাগিল]

গোবিন্দ। তুমি ত আমার পর নও বাবা, নিতান্ত আপনার। তোমার মা ছিলেন আমার সাক্ষাৎ পিসতুত বোনের আপনার ভাগ্নী। রাধানগরের বাঁড়ুয্যে বাড়ি,—সে-সব তারিণীদা জানতেন। তাই যে-কোন কাজকর্মে—মামলা-মকর্দমা করতে, সাক্ষী দিতে—ডাক্‌ গোবিন্দকে—

ধর্মদাস। কেন বাজে বকিস গোবিন্দ? খক্‌ খক্‌ খক্‌—খ—আমি আজকের নই, না জানি কি? সে বছর সাক্ষী দেবার কথায় বললি আমার জুতো নেই, খালিপায়ে যাই কি করে? খক্‌ খক্‌—তারিণী অমনি আড়াই টাকা দিয়ে জুতো কিনে দিলে। তুই তাই পায়ে দিয়ে সাক্ষী দিয়ে এলি কিনা বেণীর হয়ে! খক্‌ খক্‌ খক—খ—

গোবিন্দ। (চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া) এলুম?

ধর্মদাস। এলিনে?

গোবিন্দ। দূর মিথ্যেবাদী!

ধর্মদাস। মিথ্যেবাদী তোর বাবা।

গোবিন্দ। (ভাঙ্গা ছাতি লইয়া লাফাইয়া উঠিল) তবে রে শালা!

ধর্মদাস। (বাঁশের লাঠি উঁচাইয়া) ও শালার আমি—খক খক খক—খ—ও শালার আমি সম্পর্কে বড়ভাই হই কিনা, তাই শালার আক্কেল দেখ! (কাশি)

গোবিন্দ। ওঃ—শালা আমার বড়ভাই!

[চারিদিকের লোক ছুটিয়া আসিল, ছেলে-মেয়েরা হাঁ করিয়া চাহিয়া
রহিল এবং রমেশ দ্রুতপদে তাহাদের মাঝখানে আসিয়া দাঁড়াইল]

রমেশ। এ কি এ! আপনারা উভয়েই প্রাচীন—ব্রাহ্মণ—এ কি কাণ্ড!

ভৈরব। (উঠিয়া আসিয়া রমেশের প্রতি) প্রায় শ’চারেক কাপড় ত হল, আরও চাই কি?

[রমেশ নিরুত্তর]

ভৈরব। ছিঃ গাঙ্গুলীমশাই, বাবু একেবারে অবাক হয়ে গেছেন। আপনি কিছু মনে করবেন না বাবু, এমন ঢের হয়। বৃহৎ কাজকর্মের বাড়িতে কত ঠ্যাঙাঠেঙি রক্তারক্তি পর্যন্ত হয়ে যায়—আবার যে কে সেই হয়। নিন চাটুয্যেমশাই, দেখুন দিকি আরও থান ফাড়বো কি না?

গোবিন্দ। হয়ই ত! হয়ই ত! ঢের হয়। নইলে বিরদ্‌ কর্ম বলেচে কেন। সে বছর তোমার মনে আছে ভৈরব, যদু মুখুয্যেমশাইয়ের কন্যা রমার গাছ-পিতিষ্ঠের দিন সিধে নিয়ে, রাঘব ভট্‌চায্যে আর হারান চাটুয্যেতে মাথা ফাটাফাটি হয়ে গেল! কিন্তু আমি বলি ভৈরব ভায়া, বাবাজীর এ কাজটা ভাল হচ্চে না। ছোটলোকদের কাপড় দেওয়া আর ভস্মে ঘি ঢালা এক কথা। তার চেয়ে বামুনদের একজোড়া আর ছেলেদের একখানা করে দিলে নাম হোতো। আমি বলি বাবাজী সেই যুক্তিই করুন, কি বল ধর্মদাসদা?

ধর্মদাস। গোবিন্দ মন্দ যুক্তি বলেনি বাবাজী। ওদের মিছে দেওয়া। নইলে আর শাস্তরে ব্যাটাদের ছোটলোক বলেচে কেন! বুঝলে না বাবা রমেশ?

রমেশ। হাঁ, বুঝেচি বৈ কি।

ভৈরব। তা হলে কি এই কাপড়েই হবে?

রমেশ। বোধ হয় হবে না। বলা যায় না কত কাঙ্গালী আসবে, আপনি বরঞ্চ আরও দু’শ কাপড় ঠিক করে রাখুন।

গোবিন্দ। তা নইলে কি হয়? তুমি একা আর কত পারবে ভায়া, চল আমিও যাই।

[বলিতে বলিতে গোবিন্দ বস্ত্ররাশির কাছে অগ্রসর হইয়া গেল, এবং উপবেশন করিয়া কাপড় গুছাইতে লাগিল। ধর্মদাস এই অবকাশে রমেশকে একধারে টানিয়া লইয়া গিয়া কানে কানে বলিতে লাগিল। ওদিকে গোবিন্দ উদ্‌গ্রীব হইয়া আড়চোখে চাহিয়া দেখিতে লাগিল]

ধর্মদাস। এ-দেশ বড় খারাপ বাবা, ভাঁড়ার-টাঁড়ার কাউকে দিয়ে বিশ্বেস কোরো না। তেল, নুন, ঘি, ময়দা অর্ধেক সরিয়ে ফেলবে। আমি এখুনি গিয়ে তোমার পিসীমাকে পাঠিয়ে দিচ্চি বাবা, একটি কুটো তোমার নষ্ট হবে না।

রমেশ। যে-আজ্ঞে—

[মুণ্ডিত-শ্মশ্রু শীর্ণকায় ও প্রাচীন দীননাথ ভট্টাচার্য প্রবেশ করিলেন। ইঁহার সঙ্গেও দুই-তিনটি ছেলে-মেয়ে। মেয়েটি সকলের বড়, পরনে একখানি শতচ্ছিন্ন ডুরে কাপড়]

দীননাথ। কৈ গো বাবাজী, কোথায় গো?

গোবিন্দ। (উঠিয়া দাঁড়াইয়া) এস দীনুদা, বোস। বড় ভাগ্যি আমাদের যে আজ তোমার পায়ের ধুলো পড়লো। ছেলেটা একা সারা হয়ে যায় তা তোমরা ত—

[ধর্মদাস কটমট করিয়া তাহার প্রতি চাহিল]

গোবিন্দ। তা তোমরা ত কেউ এদিক মাড়াবে না দাদা।

দীনু। আমি ত ছিলাম না ভায়া, তোমার বৌঠাকরুনকে আনতে তাঁর বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম। বাবাজী কোথায়? শুনচি নাকি ভারী আয়োজন হচ্চে। পথে ও-গাঁয়ের হাটে শুনে এলাম খাইয়ে-দাইয়ে ছেলে-বুড়োর হাতে নাকি ষোল পাত লুচি আর চার জোড়া করে সন্দেশ দেওয়া হবে।

গোবিন্দ। (গলা খাটো করিয়া) তা ছাড়া হয়ত একখানা করে কাপড়ও—

[রমেশের প্রবেশ]

দীনুদা, এই আমার রমেশ। তা তোমাদের পাঁচজনের বাপ-মায়ের আশীর্বাদে যোগাড়-সোগাড় ত একরকম করচি, কিন্তু বেণী একেবারে উঠে পড়ে লেগেচে। এই আমার কাছেই দু’বার লোক পাঠিয়েচে। তা আমার কথা না হয় ছেড়েই দিলে, রমেশের সঙ্গে আমার নাড়ীর টান রয়েচে, কিন্তু এই যে দীনুদা, ধর্মদাসদা, এঁরাই কি বাবা তোমাকে ফেলতে পারবেন? দীনুদা ত পথ থেকে শুনতে পেয়ে ছুটে আসচেন। ওরে ও ষষ্ঠীচরণ, তামাক দে না রে! বাবা রমেশ, একবার এদিকে এসো দিকি, একটা কথা বলে নিই।

[ভৃত্য আসিয়া দীনুর হাতে হুঁকা দিয়া গেল এবং গোবিন্দ
রমেশকে আর একদিকে সরাইয়া লইয়া গিয়া চাপা গলায়]

গোবিন্দ। ভেতরে বুঝি ধর্মদাস-গিন্নি আসচে? খবরদার বাবা, খবরদার—বিট্‌লে বামুন যতই ফোসলাক, কখনো তার হাতে ভাঁড়ার-টাড়ার দিও না, মাগী অর্ধেক ফাঁক করে দেবে। বলি, তোমার ভাবনা কি বাবা? তোমার যে আপনার মামী রয়েচে। আমি গিয়েই তাকে পাঠিয়ে দিচ্চি, নাড়ীর টানে সে যেমন করবে আর কি কেউ তেমন পারবে? না, কখনো পারে?

[শিশু-দু’টা ছুটিয়া আসিয়া দীনুর কাঁধের উপর ঝুলিয়া পড়িল]

শিশুরা। বাবা, সন্দেশ খাবো।

দীনু। (একবার রমেশ ও একবার গোবিন্দর প্রতি চাহিয়া) সন্দেশ কোথায় পাব রে? সন্দেশ কৈ?

[দীনুর মেয়ে অন্তরালে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া]

দীনুর মেয়ে। কেন, ঐ যে হচ্চে বাবা—

[বাকি ছেলে-মেয়েরা নাকে কাঁদিতে কাঁদিতে
আসিয়া ধর্মদাসকে ঘিরিয়া ধরিল]

ছেলে-মেয়েরা। আঁমরাও দাঁদামশাই—

রমেশ। (অগ্রসর হইয়া) বেশ ত, বেশ ত, ও আচার্যিমশাই, বিকেলবেলায় ছেলেরা সব বাড়ি থেকে বেরিয়েচে, খেয়ে ত আসেনি। (অন্তরালবর্তী ময়রার উদ্দেশে) ওহে ও, কি নাম তোমার? নিয়ে এস ত ঐ থালাটা এদিকে। আচার্যিমশাই, দেখুন ত যেন দেরি না হয়।

[ভৈরব আচার্য ভিতরে চলিয়া গেল এবং ক্ষণকাল পরেই ময়রা সন্দেশের থালা আনিতেই ছেলেরা উপুড় হইয়া পড়িল—বাঁটিয়া দিবার অবকাশ দেয় না এমনি ব্যস্ত করিয়া তুলিল। ছেলেদের খাওয়া দেখিতে দেখিতে দীননাথের শুষ্কদৃষ্টি সজল ও তীব্র হইয়া উঠিল]

দীনু। ওরে ও খেঁদি, খাচ্ছিস ত খুব, সন্দেশ হয়েছে কেমন বল দিকি?

খেঁদি। বেশ বাবা—

[এই বলিয়া সে চিবাইতে লাগিল]

দীনু। (মৃদু হাসিয়া ঘাড় নাড়িয়া) হাঁ:—তোদের আবার পছন্দ! মিষ্টি হলেই হল। হাঁ হে কারিকর, এ কড়াটা কেমন নাবালে? কি বল গোবিন্দভায়া, এখনো রোদ একটু আছে বলে মনে হচ্চে না?

ময়রা। আজ্ঞে, আছে বৈ কি। এখনো ঢের বেলা আছে, এখনো সন্ধ্যে-আহ্নিকের—

দীনু। তবে কৈ দাও দিকি গোবিন্দভায়াকে একটা, চেকে দেখুক কেমন কলকাতার কারিকর তোমরা—

[ময়রা গোবিন্দ ও দীনু উভয়কেই সন্দেশ দিতে গেল]

দীনু। না না, আমাকে আবার কেন? তবে, আধখানা—আধখানার বেশী নয়। (হুঁকা রাখিয়া দিয়া) ওরে, ও ষষ্ঠীচরণ, একটু জল আন দিকি বাবা, হাতটা ধুয়ে ফেলি।

রমেশ। (ভিতরের দিকে চাহিয়া) ওরে, অমনি ভিতর থেকে গোটা-চারেক রেকাবী নিয়ে আসিস ষষ্ঠী।

গোবিন্দ। সন্দেশের চেহারা দেখেই বোধ হচ্চে হয়েছে ভাল। কি হে, ময়রার পো, পাকটা একটু নরমই রাখলে বুঝি?

ময়রা। আজ্ঞে হাঁ, এ কড়াটা একটু নরমই রেখেচি।

গোবিন্দ। (হাস্য করিয়া) আমরা বুঝি কিনা! তাকালেই ধরে দিতে পারি কোন্‌টা কেমন।

ময়রা। আজ্ঞে, আপনারা বুঝবেন না ত বুঝবে কারা!

[ষষ্ঠীচরণ ও আর একজন ভৃত্য রেকাবী, জলের গ্লাস প্রভৃতি আনিয়া উপস্থিত করিল, ময়রা সন্দেশের থালাটা সম্মুখে আনিয়া রাখিল, এবং ব্রাহ্মণদিগের পাত্রে তুলিয়া দিতে লাগিল। কাহারও মুখে কথা নাই, ছেলে-মেয়েরা এবং ধর্মদাস, গোবিন্দ ও দীনু গোগ্রাসে গিলিতেছে এবং দেখিতে দেখিতে সমস্ত থালাটাই নিঃশেষিত হইয়া গেল]

দীনু। হাঁ, কলকাতার কারিকর বটে! কি বল ধর্মদাসদা?

[ধর্মদাসের কণ্ঠস্বর সন্দেশের তাল ভেদ করিয়া বেশ স্পষ্ট
বাহির হইল না, কিন্তু বুঝা গেল মতের অনৈক্য নাই]

গোবিন্দ। (নিশ্বাস ফেলিয়া) হাঁ, ওস্তাদি হাত বটে!

ময়রা। যদি কষ্টই করলেন ঠাকুরমশাই, তা হলে মিহিদানাটাও অমনি পরখ করে দিন।

দীনু। মিহিদানা। কৈ আনো দিকি বাপু।

ময়রা। এই যে আনি।

[এই বলিয়া সে চক্ষের পলকে একথালা মিহিদানা আনিয়া হাজির করিল এবং ব্রাহ্মণদিগের পাত্রে উজাড় করিয়া দিল। মিহিদানা শেষ হইয়া আসিতে বিলম্ব হইল না]

দীনু। (হাত বাড়াইয়া মেয়ের প্রতি) ওরে ও খেঁদি, ধর দিকি মা, এই দুটো মিহিদানা।

খেঁদি। আমি আর খেতে পারবো না বাবা।

দীনু। পারবি পারবি। এক ঢোঁক জল খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে নে দিকি, মুখ মেরে গেছে বৈ ত না। না পারিস আঁচলে একটা গেরো দিয়ে রাখ, কাল সকালে উঠে খাস।

[এই বলিয়া মেয়ের হাতে গুজিয়া দিল]

দীনু। (ময়রার প্রতি) হাঁ বাপু, খাওয়ালে বটে। যেন অমৃত। তা বেশ হয়েছে, মিষ্টি বুঝি দু’রকম করলে বাবাজী?

ময়রা। আজ্ঞে না, রসগোল্লা, ক্ষীরমোহন—

দীনু। অ্যাঁ, ক্ষীরমোহন? কৈ, সে ত বার করলে না বাপু? (বিস্মিত রমেশের মুখের প্রতি চাহিয়া) হাঁ খেয়েছিলাম বটে রাধানগরের বোসেদের বাড়ি, আজও যেন মুখে লেগে রয়েচে। বললে বিশ্বাস করবে না বাবাজী, ক্ষীরমোহন খেতে আমি বড্ড ভালবাসি।

রমেশ। (হাসিয়া) আজ্ঞে না, অবিশ্বাস করবার কোন কারণ নেই। ওরে ষষ্ঠী, ভেতরে বোধ করি আচায্যিমশাই আছেন, যা ত কিছু ক্ষীরমোহন তাঁকে আনতে বলে আয় দিকি।

[ষষ্ঠীচরণের প্রস্থান]

গোবিন্দ। (উদ্বিগ্নকণ্ঠে) অ্যাঁ? মিষ্টি কি সব বাইরে পড়ে নাকি! না না, এ ত ভাল না।

ধর্মদাস। চাবি? চাবি? ভাঁড়ারের চাবি কার কাছে?

গোবিন্দ। বলি, ভৈরো আচায্যির হাতে নয় ত?

[ষষ্ঠীচরণের প্রবেশ]

ষষ্ঠী। এখন আর ভাঁড়ার-ঘর খোলা হবে না বাবু, ক্ষীরমোহন বার হবে না।

রমেশ। আঃ, বল গে যা আমি আনতে বলচি।

গোবিন্দ। দেখলে ধর্মদাসদা, আচায্যির আক্কেল। এ যে দেখি মায়ের চেয়ে মাসীর বেশী দরদ। সে জন্যেই আমি বলি—

ষষ্ঠী। আচায্যিমশায়ের দোষ কি? ও-বাড়ি থেকে গিন্নি-মা এসে ভাঁড়ার বন্ধ করে ফেলেচেন। এ তাঁরই হুকুম।

ধর্মদাস ও গোবিন্দ। কে? বেণীবাবুর মা? ও-বাড়ির বড়-গিন্নিঠাকরুন?

রমেশ। জ্যাঠাইমা এসেচেন নাকি?

ষষ্ঠী। হাঁ বাবু। তিনি এসেই ছোট-বড় দুটো ভাঁড়ারই তালা-বন্ধ করে ফেলেচেন। চাবি তাঁরই আঁচলে।

গোবিন্দ। দেখলে ধর্মদাসদা ব্যাপারখানা? বলি মতলবটা বুঝলে ত?

দীনু। এ মতলব বোঝা আর শক্ত কি ভায়া! তালা-বন্ধ করে চাবি নিজের কাছে রেখেচেন, তার মানে ভাঁড়ার আর কারো না হাতে পড়ে। তিনি সমস্তই ত জানেন।

গোবিন্দ। বোঝ না সোঝ না তুমি কথা কও কেন বল ত? তুমি এ-সব ব্যাপারের কি জানো যে হঠাৎ মানে করতে এসেচ?’

দীনু। আরে, এতে বোঝা-বুঝিটা আছে কোন্‌খানে? শুনচো না গিন্নী-মা স্বয়ং এসে তালা-বন্ধ করেছেন? এতে কথা কইবে আবার কে?

গোবিন্দ। ঘরে যাও না ভটচায। যে জন্যে ছুটে এলে, গুষ্টিবর্গ মিলে খেলে, বাঁধলে—আর কেন? ক্ষীরমোহন পরশু খেয়ো, আজ বাড়ি যাও, আমাদের ঢের কাজ।

রমেশ। আপনার হল কি গাঙ্গুলীমশাই? যাকে-তাকে এমন খামোকা অপমান করচেন কেন?

[ধমক খাইয়া গোবিন্দ লজ্জিত হইল। পরে শুষ্কহাস্য করিয়া]

গোবিন্দ। অপমান আবার কাকে করলাম বাবাজী। ভাল, ওকেই জিজ্ঞাসা করে দেখ না ঠিক সত্যি কথাটি বলেচি কিনা? ও ডালে-ডালে বেড়ায় যদি, আমি পাতায়-পাতায় ঘুরি যে। দেখলে ধর্মদাসদা, দীনে বামনার আস্পর্ধা? আচ্ছা রমেশ। আচ্ছা কি?

দীনু। (রমেশের প্রতি) না বাবা, গোবিন্দ সত্য কথাই বলেচেন। আমি বড় গরীব সে এদিকের সবাই জানে। ওঁদের মত আমার জমি-জমা চাষ-বাস কিছুই নেই, একরকম চেয়েচিন্তে ভিক্ষে-শিক্ষে করেই আমাদের দিন চলে।—ভাল জিনিস ছেলেপিলেদের কিনে খাওয়াবার ক্ষমতা ত ভগবান দেননি, তাই বড়ঘরে কাজকর্ম হলে ওরা খেয়ে বাঁচে। কিছু মনে কোরো না বাবা, তারিণীদাদা বেঁচে থাকতে আমাদের তিনি খাওয়াতে বড় ভালবাসতেন।

[দীনুর দু’চক্ষু জলে ভরিয়া টপটপ করিয়া দু’ফোঁটা অশ্রু সকলের সম্মুখেই
ঝরিয়া পড়িল। দীনু মলিন ও ছিন্ন উত্তরীয়-প্রান্তে তাহা মুছিয়া ফেলিল]

গোবিন্দ। আহা! তারিণীদাদা শুধু তোমাকে খাওয়াতেই ভালবাসতেন। শুনলে ধর্মদাসদা, শুনলে কথা?

দীনু। আমি কি তাই বলচি গোবিন্দ? আমার মত গরীব-দুঃখী কেউ কখনো তারিণীদার কাছ থেকে খালি হাতে ফেরেনি।

রমেশ। ভটচায্যিমশাই, এই দুটো দিন আমার ওপরে একটু দয়া রাখবেন। আর যদি খাঁদুর মা এ-বাড়িতে একবার পায়ের ধুলো দিতে পারেন ত ভাগ্য বলে মানব।

দীনু। আমি বড় গরীব বাবা, আমি বড় দুঃখী। আমাকে এমন করে বললে যে আমি লজ্জায় মরে যাই—

[ভৃত্যের প্রবেশ]

ভৃত্য। বাবু, গিন্নি-মা একবার বাড়ির ভেতরে ডাকচেন।

রমেশ। যাই।

দীনু। বাবা, আমরা তা হলে এখন আসি।

রমেশ। আসুন, কিন্তু আমার প্রার্থনা যেন ভুলে যাবেন না।

দীনু। না বাবা, প্রার্থনা বলচ কেন, এ তোমার দয়া।

[ছেলেদের লইয়া দীনুর প্রস্থান]

গোবিন্দ। বাবা রমেশ, আমিও এখন তাহলে আসি। সন্ধ্যে-আহ্নিক, ঠাকুরের শীতল দেওয়া—রমেশ। কিন্তু গাঙ্গুলীমশাই—

গোবিন্দ। কিছু বলতে হবে না বাবা, এ আমার আপনার কাজ। তুমি না ডাকলেও আমাকে নিজে এসে সমস্ত করতে হতো। কাল সক্কালেই তোমার মামীকে পাঠিয়ে দিয়ে তবে নিশ্চিন্ত হতে পারব।

ধর্মদাস। তুই বড় বাজে বকিস গোবিন্দ।

গোবিন্দ। কোন ভাবনা নেই রমেশ, ভাঁড়ার-টাড়ার যা কিছু—

ধর্মদাস। ভাঁড়ারের জন্যে তোর এত মাথাব্যথা কেন বল ত?

গোবিন্দ। এ আমাদের নিজের কাজ বাবা। আমি আর ধর্মদাসদা—আমরা দু’ভাই তোমার ডাকার অপেক্ষা রাখিনি,—আপনারাই এসে উপস্থিত হয়েচি। হয়েচি কিনা?

ধর্মদাস। বলি শোন রমেশ, আমরা বেণী ঘোষাল নই, আমাদের জন্মের ঠিক আছে।

রমেশ। আঃ—কি বলচেন আপনারা?

[জ্যাঠাইমা অন্তরাল হইতে একটুখানি মুখ বাহির করিয়া]

জ্যাঠাইমা। ওরা অমনিই বলে রমেশ! শিক্ষা আর সঙ্গদোষে জানেও না যে, কি ওরা বললে।

[গোবিন্দ ও ধর্মদাসের দ্রুতপদে প্রস্থান

রমেশ। জ্যাঠাইমা!

জ্যাঠাইমা। হাঁরে আমিই। বলি চিনতে পারিস ত?

[বলিতে বলিতে তিনি সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন। তাঁহার বয়স পঞ্চাশের কম নয়, কিন্তু কিছুতেই চল্লিশের বেশী বলিয়া মনে হয় না। মাথার চুলগুলি ছোট করিয়া ছাঁটা, দুই-এক গাছি কুঞ্চিত হইয়া কপোলের উপর পড়িয়াছে। একদিন যে রূপের খ্যাতি এ-অঞ্চলে প্রসিদ্ধ ছিল, আজিও সেই অনিন্দ্যসৌন্দর্য তাঁহার নিটোল পরিপূর্ণ দেহটিকে বর্জন করিয়া দূরে যাইতে পারে নাই। দেখিয়া আজও মনে হয় তাঁহার সকল অবয়ব যেন শিল্পীর সাধনার ধন]

রমেশ। একদিন যে ছেলেকে তুমি মানুষ করেছিলে, আর একদিন বড় হয়ে ফিরে এসে সে-ই তোমাকে চিনতে পারবে না এই কি তোমার রমেশের কাছে আশা কর জ্যাঠাইমা?

জ্যাঠাইমা। না, সে আশঙ্কা করিনি রমেশ। তবুও ত তোরই মুখ থেকে না শুনে পারিনে বাবা, জ্যাঠাইমাকে তোর মনে আছে।

রমেশ। মনে আছে মা, খুব বড় করেই তোমাকে মনে আছে। কিন্তু যা পারতাম নিজেই করতাম, তুমি কেন আবার এ-বাড়িতে এলে?

জ্যাঠাইমা। তুই ত আমাকে ডেকে আনিস নি বাবা, যে তোর কাছে তার কৈফিয়ত দেব।

রমেশ। ডেকে আনব কি মা, মা বলে যে তোমার কোলেই সকলের আগে ছুটে গিয়েছিলাম। কিন্তু বাড়ি নেই বলে ত তুমি দেখা করনি জ্যাঠাইমা!

জ্যাঠাইমা। সেই অভিমানেই বুঝি নিজের বাড়ি থেকে আজ আমাকে বিদায় করতে চাস রমেশ?

রমেশ। অভিমান! যার মা নেই, বাপ নেই, নিজের জন্মভূমিতে যে নিরাশ্রয়, বিদেশী,—বিনাদোষে যাকে প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজন বাড়ি থেকে দূর করে দেয় তার অভিমানের দাম কি জ্যাঠাইমা?

জ্যাঠাইমা। আমার কাছেও তার দাম নেই রমেশ?

রমেশ। না নেই। আজ নিজের ছেলেকেই শুধু ছেলে বলে জেনে রেখেচ। কিন্তু আর একটা মা-মরা ছেলেকে যে একদিন ঠিক তেমনি কোরেই মানুষ করতে হয়েছিল সে কথা আজ ভুলে গেছ।

জ্যাঠাইমা। এমনি কোরে শূল বিঁধে তুই কথা বলবি রমেশ? ঘরে-বাইরে এই শাস্তি পাব বলেই কি তোদের দুজনকে মানুষ করেছিলাম রে?

রমেশ। ঘরে-বাইরে! তাই ত বটে! (হঠাৎ পায়ের কাছে হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া) আমাকে ক্ষমা করো জ্যাঠাইমা, আমি প্রাণের জ্বালায় তোমার এই দিকটার পানে চেয়ে দেখিনি।

[জ্যাঠাইমা রমেশকে তুলিয়া ডান হাত
দিয়া তাহার চিবুক স্পর্শ করিলেন]

জ্যাঠাইমা। জানি বাবা।

রমেশ। কিন্তু আর তুমি এ-বাড়িতে এসো না। আমার সব সইবে, কিন্তু আমার জন্যে দুঃখ পাবে এ আমার সইবে না জ্যাঠাইমা।

জ্যাঠাইমা। এ তোর অন্যায় রমেশ। দুঃখ সওয়াই যদি দরকার হয় ত তোরও সইবে, আমারও সইবে। ফাঁকি দিয়ে আরামের চেষ্টা করলে, তার ফাঁক দিয়ে শুধু আরামই বার হয়ে যায় না বাবা, ঢের বেশি দুঃখ হুড়মুড় কোরে ঢুকে পড়ে। আমাকে বারণ করবার মতলব তুই করিস নে। তা ছাড়া তোর নিষেধ শুনবোই বা কেন?

রমেশ। তোমাকে ভুলেছিলাম জ্যাঠাইমা, তাই নিষেধ করবার স্পর্ধা করেচি। আমার কথা তুমি শুনো না—যা তোমার ভাল মনে হবে তাই করো।

জ্যাঠাইমা। তাইতো করবো।

রমেশ। কোরো। কত ঝড়-বাদল, কত দুর্যোগ তোমার মাথার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে—দূর থেকে মাঝে মাঝে আমি তার খবর পেয়েচি। কিন্তু কিছুতেই তোমাকে বদলাতে পারেনি। তেমনি অনির্বাণ তেজের আগুন তোমার বুকের মধ্যে তেমনিই দপদপ করে জ্বলচে।

জ্যাঠাইমা। তুই থাম, ছেলে-মুখে বুড়ো-কথা বলিস নে।—তা শোন। তোর বড়দার কাছে একবার গিয়েছিলি?

[রমেশ অধোমুখে নীরব]

জ্যাঠাইমা। বাড়ি নেই বলে দেখা করেনি বুঝি?

[রমেশ তেমনি নিরুত্তর]

জ্যাঠাইমা। না-ই করুক, আর একবার যা। (ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া) আমি জানি রে, সে তোদের ওপর প্রসন্ন নয়, কিন্তু তোর কাজ ত তোকে করা চাই। সে বড় ভাই—তার কাছে হেঁট হতে তোর লজ্জা নেই। তা ছাড়া এটা মানুষের এমনি দুঃসময় বাবা, যে-কোন লোকের হাতে-পায়ে ধরে মিটমাট করে নেওয়াই মনুষ্যত্ব। লক্ষ্মী মানিক আমার—যা আর একবার। এখন হয়ত সে বাড়িতেই আছে।

রমেশ। তুমি আদেশ করলেই যাব জ্যাঠাইমা।

জ্যাঠাইমা। আর দ্যাখ, রমাদের ওখানেও একবার যা।

রমেশ। গিয়েছিলাম।

জ্যাঠাইমা। গিয়েছিলি? তোকে সে চিনতে পেরেছিল ত?

রমেশ। বোধ হয় পেরেছিল। নইলে অপমান করে বাড়ি থেকে দূর করে দেবে কেন?

জ্যাঠাইমা। অপমান করে দূর করে দিলে? রমা?

রমেশ। অপমানটা বোধ করি তার তেমন মনঃপূত হয়নি। তাই বলে দিয়েচে এবার এলে দরোয়ান দিয়ে বার করে দেবে।

জ্যাঠাইমা। রমা বলেচে? এ যে নিজের কানে শুনলেও বিশ্বাস হয় না রমেশ!

রমেশ। বড়দা ছিলেন, তাঁকে জিজ্ঞাসা করে দেখো জ্যাঠাইমা।

জ্যাঠাইমা। বেণী ছিল? তবে, হবেও বা। (একমুহূর্ত পরে) কিন্তু ঠিক বলচিস রমেশ, রমা বললে বাড়ি ঢুকলে দরোয়ান দিয়ে বার করে দেবে? আমাকে ভাঁড়াস নে বাবা, ঠিক করে বল।

রমেশ। হাঁ জ্যাঠাইমা, তাই। তবে, নিজে না বলে কে তার মাসী আছে তার মুখ দিয়েই বলিয়েচে।

জ্যাঠাইমা। (নিশ্বাস ফেলিয়া) ওঃ—তাই বল। নইলে রাতও মিথ্যে দিনও মিথ্যে রমেশ, এত বড় গর্হিত কথা তার গলায় ছুরি দিলেও সে তোকে বলতে পারত না। এ সেই মাসীর কথা, তার নয়।

রমেশ। তবে কি তাদের বাড়িতেও আমাকে যেতে হুকুম করো জ্যাঠাইমা? রমাকে কি তুমি এমনি করেই জান?

জ্যাঠাইমা। জানি। কিন্তু যেতে আর বলিনে। তোর বাপের সঙ্গে তাদের চিরদিন মামলা-মকদ্দমা চলেচে, তাদের শত্রু বললেও মিথ্যে বলা হয় না, তবুও আমি জানি ও কথা রমা বলেনি। অমন মেয়ে বাবা, লক্ষ কোটির মধ্যেও সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। ও আছে বলে তবুও এই গ্রামের মধ্যে একটুখানি ধর্ম বেঁচে আছে।

রমেশ। তাকে দেখে ত সে কথা মনেও হল না জ্যাঠাইমা।

জ্যাঠাইমা। হঠাৎ হয়ও না, তবুও এ কথা সত্যি রমেশ। তা সে যাই হোক, সেখানে যখন যাওয়াই হতে পারে না তখন তা নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই। কিন্তু এতক্ষণ যাঁরা এখানে ছিলেন এবং আমি আসামাত্রই যাঁরা সরে গেলেন তাঁদের তুই বিশ্বেস করিস নে বাবা, তাঁদের আমি চিনি।

রমেশ। কিন্তু তাঁরাই ত এ বিপদে আমার সবচেয়ে আপনার লোক জ্যাঠাইমা। তাঁদের বিশ্বাস না করলে কাদের করবো?

জ্যাঠাইমা। তাই ত ভাবচি বাবা, এ কথার জবাব দেবই বা কি! হাঁ রে, তোর নেমন্তন্নর ফর্দ তৈরি হয়ে গেছে?

রমেশ। না, এখনো হয়নি।

জ্যাঠাইমা। সেইটে একটু বুঝে-সুঝে করিস রমেশ। এ গ্রামে, আর এই গ্রামেই বা বলি কেন, সব গাঁয়েই এই। এ ওর সঙ্গে খায় না, ও তার সঙ্গে কথা কয় না,—একটা কাজকর্ম পড়ে গেলে মানুষের আর দুশ্চিন্তার অন্ত থাকে না। কাকে বাদ দিয়ে কাকে রাখা যায়, এর চেয়ে শক্ত কাজ আর নেই।

রমেশ। কেন এ-রকম হয় জ্যাঠাইমা?

জ্যাঠাইমা। সে অনেক কথা বাবা। যদি থাকিস এখানে, আপনিই সব জানতে পারবি। কারুর সত্যিকার দোষ-অপরাধ আছে, কারুর মিথ্যে অপবাদ আছে, তা ছাড়া মামলা-মকদ্দমা, মিথ্যে সাক্ষী দেওয়া নিয়েও মস্ত দলাদলি। আমি যদি তোর এখানে দু’দিন আগে আসতাম রমেশ, এত উদ্যোগ-আয়োজন কিছুতে করতে দিতাম না। কি যে সেদিন হবে আমি তাই শুধু ভাবচি।

[এই বলিয়া তিনি নিশ্বাস মোচন করিলেন]

রমেশ। তোমার দীর্ঘনিশ্বাসের মর্ম বোঝা কঠিন জ্যাঠাইমা, কিন্তু আমার সঙ্গে ত এর কোন যোগ নেই। আমাকে বিদেশী বললেই হয়,—কারো সঙ্গে শত্রুতাও নেই, দলাদলিও নেই,—আমি কাউকে অপমান করতে পারব না, সকলকেই সসম্ভ্রমে আহ্বান করে আনব।

জ্যাঠাইমা। উচিত ত তাই। কিন্তু—যাই হোক, সকলের মত নিয়ে এ কাজটা করিস বাবা, নইলে ভারী গণ্ডগোল হবে। মা বিপদ-তারিণী।

রমেশ। তুমি কি এখুনি চলে যাচ্ছ?

জ্যাঠাইমা। না এখখুনি নয়! দু’একটা কাজ পড়ে আছে সেগুলো সেরে ফেলেই যাবো। কিন্তু চাবি আমার সঙ্গে রইলো রমেশ, কাল সক্কালেই আমি নিজে এসে ভাঁড়ার খুলব।

[প্রস্থান

[ধর্মদাস, গোবিন্দ ও পরাণ হালদারের প্রবেশ]

গোবিন্দ। (রমেশের প্রতি) বাবা, এই পরাণ-মামাকে ধরে নিয়ে এলাম। আসতে কি চায়! কিন্তু আমিও ছাড়নে-বালা নই! বলি, বেণীই জমিদার আর আমার ভাগ্‌নে রমেশ নয়? (উপরের দিকে মুখ তুলিয়া) তারিণীদা, স্বর্গে বসে সমস্তই দেখচো শুনচো, কিন্তু এই তোমার কাছে প্রতিজ্ঞে করচি আমি, এই উঠোনের ওপর বেণীর যদি না এমনি করে নাক রগড়াতে পারি ত আমার নামই গোবিন্দ গাঙ্গুলী নয়।

ধর্মদাস। আহা, তুই থাম না গোবিন্দ। (কাশিতে কাশিতে) সে আমি ঠিক করে নেব।

[অকস্মাৎ বেণী ঘোষাল প্রবেশ করিল]

বেণী। এই যে রমেশ, একবার এলাম—বড় জরুরী কাজ—মা এসেচেন নাকি?

গোবিন্দ। আসবে বৈ কি বাবা, একশ’বার আসবে। এ ত তোমারই বাড়ি। তাই ত আমি রমেশ বাবাজীকে সকাল থেকে বলচি, রমেশ, ঝগড়া-বিবাদ তারিণীদার সঙ্গেই যাক—আর কেন? তোমরা দু’ভাই এক হও, আমরা দেখে চোখ জুড়োই! তা ছাড়া বড় গিন্নীঠাকরুন যখন স্বয়ং এসে উপস্থিত হয়েচেন, তখন—

বেণী। মা এসেচেন?

গোবিন্দ। শুধু আসা কেন, ভাঁড়ার-টাঁড়ার, করা-কর্ম যা-কিছু তিনিই ত করচেন। আর তিনি না করলে করবেই বা কে?

[সকলেই নীরব হইয়া রহিল]

গোবিন্দ। (নিশ্বাস ফেলিয়া) নাঃ—গাঁয়ের মধ্যে বড়-গিন্নীঠাক্‌রুনের মত মানুষ কি আর আছে? না, হবে? না বেণীবাবু, সামনে বললে খোশামোদ করা হবে, কিন্তু যে যাই বলুক, গাঁয়ে যদি লক্ষ্মী থাকেন ত সে তোমার মা। এমন মা কারু হয়?

[এই বলিয়া পুনশ্চ একটা নিশ্বাস ত্যাগ করিলেন]

বেণী। আচ্ছা—

গোবিন্দ। শুধু আচ্ছা নয় বেণীবাবু। আসতে হবে, করতে হবে, সমস্ত ভার তোমার ওপর। ভাল কথা, সবাই আপনারা ত উপস্থিত আছেন, নেমন্তন্নটা কিরকম হবে একটা ফর্দ করে ফেলা হোক। কি বল রমেশ বাবাজী? ঠিক কি না হালদার মামা? ধর্মদাসদা চুপ করে থাকলে হবে না,—কাকে বলতে হবে, কাকে বাদ দিতে হবে জান ত সব।

রমেশ। বড়দা, একবার পায়ের ধুলো যদি দিতে পারেন—

বেণী। মা যখন এসেচেন তখন আমার আসা না-আসা—কি বলো গোবিন্দ খুড়ো?

রমেশ। আপনাকে আমি পীড়াপীড়ি করতে চাইনে বড়দা, যদি অসুবিধে না হয় ত একবার দেখে-শুনে যাবেন।

বেণী। সে ত ঠিক। আমার মা যখন এসেচেন তখন আমার আসা না-আসা—কি বল হালদার-মামা? তা মাকে একটু শিগগির যেতে বোলো রমেশ, বিশেষ দরকারী কাজ, আমারও এখন দাঁড়াবার জো নেই—প্রজারা সব—

[বলিতে বলিতে বেণীর দ্রুতপদে প্রস্থান

গোবিন্দ। (নেপথ্যে গলা বাড়াইয়া দেখিয়া লইয়া) আরে, বেণী ঘোষাল! তুই পাতায়-পাতায় বেড়াস ত আমি তার শিরে-শিরে ফিরি। আমার নাম গোবিন্দ গাঙ্গুলী। নিজের চোখে দেখতে এসেচে মা এসেচে কিনা! বুঝি না বটে! (রমেশের প্রতি) আর দেখলে বাবা রমেশ, কেমন তোফা মিষ্টি মোলায়েম কথাগুলি শুনিয়ে দিলাম! যেন মিছরির ছুরি! আর বলবার জো নেই যে কর্মবাড়িতে গিয়ে খাতির পাইনি। লোকের কাছে যে বলে বেড়াবে, রমেশ না হয় ছেলেমানুষ, কিন্তু তার মামা গোবিন্দ গাঙ্গুলী ত উপস্থিত ছিল। বৃহৎ কাজেকর্মে কর্মকর্তা হয়ে থাকা সহজ ব্যাপার নয় বাবা, এক-একটা চাল ভাবতে মাথা ঘুরে যায়!

ধর্মদাস। তুই বড় বাজে বকিস গোবিন্দ! থাম না!

[একদিক দিয়া সুকুমারী ও তাহার মা ক্ষান্ত প্রবেশ করিয়া বাটীর অন্তঃপুরে চলিয়া গেল। পরাণ হালদার কঠিন-চক্ষে তাহাদের নিরীক্ষণ করিলেন। মুহূর্তে ভৃত্য ষষ্ঠীচরণ প্রবেশ করিল]

পরাণ। ওরা বাড়ির মধ্যে গেল কারা?

ষষ্ঠী। ক্ষান্ত বামুন-ঠাকরুন আর তাঁর মেয়ে।

পরাণ। যা ভেবেচি তাই। ওদের বাড়ি ঢুকতে দিলে কে?

ষষ্ঠী। আচায্যিমশাই ডেকে এনেচেন। দু’দিন ধরে সমস্ত কাজকর্ম করচেন।

পরাণ। ওরা যদি খাদ্যদ্রব্য স্পর্শ করে থাকে ত কোন ব্রাহ্মণই এখানে জলগ্রহণ করতে পারবে না।

[ক্ষান্ত আড়ালে দাঁড়াইয়া বোধ হয় শুনিতেছিল,
তৎক্ষণাৎ বাহির হইয়া আসিল]

ক্ষান্ত। কেন শুনি হালদার-ঠাকুরপো? (রমেশের প্রতি) হাঁ বাবা, তুমিও ত গাঁয়ের একজন জমিদার, বলি সমস্ত দোষই কি এই ক্ষেন্তি বামনীর মেয়ের? মাথার উপর আমাদের কেউ নেই বলে কি যতবার ইচ্ছে শাস্তি দেবে? (গোবিন্দকে দেখাইয়া) ঐ উনি মুখুয্যেবাড়ির গাছ-পিতষ্ঠের সময় জরিমানা বলে দশ টাকা আদায় করেন নি? গাঁয়ের ষোল-আনা মনসা-পূজোর নামে দু’জোড়া পাঁঠার দাম ধরে নেননি? তবে কতবার ঐ এককথা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে চায় শুনি?

গোবিন্দ। যদি আমার নামটাই করলে ক্ষান্তমাসী, তবে সত্যি কথা বলি বাছা, খাতিরে কথা কইবার লোক গোবিন্দ গাঙ্গুলী নয়, সে দেশসুদ্ধ লোকে জানে। তোমার মেয়ের প্রায়শ্চিত্তও হয়েচে, সামাজিক দণ্ডও করেচি,—সব মানি। কিন্তু যজ্ঞিতে কাঠি দিতে ত আমরা হুকুম দিইনি? মরলে ওকে পোড়াতে আমরা কাঁধ দেব, কিন্তু—

ক্ষান্ত। মলে তোমার নিজের মেয়েকে কাঁধে করে পোড়াতে যেয়ো বাছা, আমার মেয়ের ভাবনা তোমাকে ভাবতে হবে না। বলি, হাঁ গোবিন্দ, নিজের গায়ে হাত দিয়ে কি কথা কও না? তোমার ছোট-ভাজের কাশীবাসের কথা মনে পড়ে না! হালদার-ঠাকুরপোর বেয়ানের তাঁতী অপবাদ ছিল না? সে-সব বড়লোকের বড় কথা বুঝি?

গোবিন্দ। তবে রে হারামজাদা মাগী—

ক্ষান্ত। (অগ্রসর হইয়া) মারবি নাকি রে? ক্ষেন্তি বামনীকে ঘাঁটালে ঠগ বাছতে গাঁ উজোড় হয়ে যাবে। বলি, এতেই হবে, না আরও বলবো?

[ভৈরব আচার্য দ্রুতপদে প্রবেশ করিয়া]

ভৈরব। এতেই হবে মাসী, আর কাজ নেই। (ভিতরের দিকে চাহিয়া) সুকুমারী, চল দিদি, এসো মাসী আমার সঙ্গে বাড়ির ভেতরে গিয়ে বসবে চল।

[ভৈরব ও ক্ষান্তর প্রস্থান]

গোবিন্দ। দেখলে পরাণ-মামা, আমাদের অপমান করে ওদের বাড়ির ভেতরে বসাতে নিয়ে চলল। দেখলে ভৈরবের আস্পর্ধা! আচ্ছা—

পরাণ। আমাদের বিনা হুকুমে ঐ দুটো ভ্রষ্টা মাগীদের কেন বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হল, রমেশ তার কৈফিয়ত দিক। নইলে কেউ আমরা এখানে জলস্পর্শ করব না।

জ্যাঠাইমা। (দ্বারের নিকট হইতে) রমেশ!

রমেশ। তুমি কি এখনো আছ জ্যাঠাইমা?

জ্যাঠাইমা। আছি বৈ কি। গোবিন্দ গাঙ্গুলীকে বল যে ক্ষান্ত-ঠাকুরঝি আর সুকুমারীকে আদর করে আমি ডেকে আনিয়েচি, আচায্যিমশাই নয়। তাঁদের খামোকা অপমান করার কোন দরকার ছিল না।

পরাণ। কিন্তু ওদের দূর করে না দিলে আমরা কেউ জলগ্রহণ করতে পারব না।

জ্যাঠাইমা। সে পরশুর কথা। আজ আমার কর্ম-বাড়িতে চেঁচামেঁচি হাঁকাহাঁকি করতে আমি নিষেধ করচি। আমি সকলকেই নিমন্ত্রণ করব, কাউকে বাদ দিতে পারব না।

পরাণ। কিন্তু আমরা কেউ এখানে জলটুকু পর্যন্ত মুখে দিতে পারব না।

জ্যাঠাইমা। আমাকে ভয় দেখাতে বারণ কর রমেশ। দেশে অনাথ-আতুর কাঙালের অভাব নেই। আয়োজন আমার ব্যর্থ হবে না।

রমেশ। (ব্যাকুলকণ্ঠে) কিন্তু সমস্ত এঁরা পণ্ড কোরে দিতে চান। এর সকল দায় যে তোমার মাথায় পড়বে জ্যাঠাইমা!

জ্যাঠাইমা। এ তোর অন্যায় রমেশ। আমার বাড়ির কাজের দায়িত্ব আমার মাথায় পড়বে না ত কি পরের মাথায় পড়বে? এখন ওঁদের যেতে বলে দে। ঢের কাজ পড়ে আছে, নষ্ট করবার সময় নেই।

[জ্যাঠাইমা অন্তঃপুরে চলিয়া গেলেন। সদর দ্বার দিয়া গোবিন্দ, ধর্মদাস
ও পরাণ হালদার ধীরে ধীরে প্রস্থান করিল]

রমেশ। ভেবেছিলাম বুঝি আমার কেউ নেই,—কিন্তু সবাই আছে যার তুমি আছ জ্যাঠাইমা।

তৃতীয় দৃশ্য

গ্রাম্য পথ

[দীনু ভটচায শ্রাদ্ধবাটী হইতে নিমন্ত্রণ খাইয়া ঘরে ফিরিতেছে। সঙ্গে পটল, ন্যাড়া, বুড়ী প্রভৃতি বালক-বালিকা। সকলেরই হাতে ছোট-বড় পুঁটলি, অন্য হাতে খুরিতে করিয়া দধি, ক্ষীর প্রভৃতি]

খেঁদি। (সভয়ে) বাবা, ভোজো আসচে—

[শুনিয়া সকলে চকিত হইয়া উঠিল।
রমেশের ভৃত্য ভজুয়া প্রবেশ করিল]

দীনু। এই যে ভজুয়াবাবু, কোথায় যাওয়া হচ্ছে?

ভজুয়া। আরে ই-সব কি লিয়ে যাচ্চে ভটচায-মোশা—

দীনু। কিছুই নয় বাবা,—এই দুটো এঁটো-কাঁটা—পাড়ার ছোটলোক গরীব-দুঃখীর ছেলেমেয়ে আছে ত, গেলেই সব হাত পেতে দাঁড়াবে, তাদেরই দেবার জন্যে—

ভজুয়া। আরে, কমতি কি আছে। পুরি মিঠাই কেত্‌না গরীব-দুঃখী উহই বএঠকে খা রহা—

দীনু। খাচ্চে বৈ কি বাবা, খাচ্চে বৈ কি। রাজার ভাণ্ডার, অভাব কি! তবে সবাই কি আসতে পারবে? তাদের জন্যেই দুটো-একটা—

ভজুয়া। হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক ঠিক। বড়ি খারাব গাঁও ভটচায, কিত্‌না গুলমাল। ই উঠে তো উ বোসে, ই ভাগে তো উ খিঁচকে লাগে—হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ—

দীনু। হয় বাবা হয়, বিরদ কাজে-কর্মে—বুড়ী, পটলার হাতটা একবার বদলে নে মা আমাদের গাঁ ত তবু পদে আছে বাবা—হোরে, পথপানে চেয়ে চল না। হোঁচট খেয়ে দইয়ের ভাঁড়টা ফেলে দিবি যে। যে কাণ্ড দেখে এলাম খেঁদির মামার বাড়িতে,—বিশ-ঘর বামুন-কায়েতের বাস নেই বাবা—দশটা দলাদলি। পটলা, হাঁ করে স্বগ্‌গ-পানে তাকিয়ে যাচ্ছিস যে? তবে একটা কথা বলতে পারি বাবা, ভিক্ষে-শিক্ষে করতে অনেক জায়গাতেই ত যাই, অনেকে অনুগ্রহও করেন, আমি দেখেচি তোমার বাবুর মত ছেলে-ছোকরাদেরই যা কিছু দয়ামায়া আছে। নেই কেবল বুড়ো ব্যাটাদের। বাগে পেলেই একজন আর একজনের গলায় পা দিয়ে জিভ বার করে তবে ছাড়ে।

[এই বলিয়া নিজের জিভ বাহির করিয়া দেখাইল]

ভজুয়া। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।

১১২৯

দীনু। তা ভজুয়াবাবু কোথায় যাচ্চ?

ভজুয়া। আচায্যিঠাকুরকে বাড়ি।

দীনু। তা যাও যাও, একটু তরস্ত যাও। আমরাও আসি বাবা।

[সকলের প্রস্থান

চতুর্থ দৃশ্য

[মধু পালের মুদির দোকান। কেনা-বেচা চলিতেছে]

১ম খরিদ্দার। এক পয়সার তেল দিতে কি বেলা কাটিয়ে দেবে নাকি?

মধু। এই যে দিই।

২য় খরিদ্দার। এক পয়সার হলুদ দিতে কি বুড়ো হয়ে যাবে পালদা?

মধু। এই যে রে ভাই দিচ্ছি। একলা মানুষ—

৩য় খরিদ্দার। দু’পয়সার মুশুর ডালের জন্যে দেখচি এবেলা আর রান্না চড়ানো হবে না!

মধু। হবে গো খুড়ো হবে, এই নাও না।

[রমেশের প্রবেশ]

মধু। (গলা বাড়াইয়া দেখিয়া) অ্যাঁ! এ যে আমাদের ছোটবাবু! প্রাতঃপেন্নাম হই। (এই বলিয়া সে একটা মোড়া-হাতে বাহির হইয়া আসিল) আমার সাত-পুরুষের ভাগ্যি যে দোকানে আপনার পায়ের ধুলো পড়লো। বসুন।

রমেশ। শ্রাদ্ধর দরুন দশটা টাকা বাকী পড়ে আছে, তুমিও যাও না, আমারও পাঠানো হয় না। আজ ভাবলেম নিজেই গিয়ে দিয়ে আসি। এই নাও।

মধু। (হাত পাতিয়া গ্রহণ করিয়া) এ ত আমাদের বাপ-দাদারাও কখনো শোনেনি, বাবু, মানুষের বাড়ি বয়ে এসে টাকা দিয়ে যায়!

রমেশ। (মোড়ায় উপবেশন করিয়া) দোকান কেমন চলচে মধু?

মধু। কেমন করে আর ভাল চলবে বাবু? দু-আনা চার-আনা এক-টাকা পাঁচ-সিকে করে প্রায় ষাট- সত্তর টাকা বিলেত পড়ে গেছে। এই ও- বেলায় দিয়ে যাচ্চি বলে আর ছ’মাসেও আদায় হবার জো নেই—এ কি, বাঁড়ুয্যেমশাই যে! কবে এলেন? প্রাতঃপেন্নাম হই।

[বাঁড়ুয্যেমশায়ের বাঁ হাতে একটা গাড়ু, পায়ের নখে, গোড়ালিতে কাদার দাগ,
কানে পৈতা জড়ানো, ডান হাতে কচুপাতায় মোড়া চারটি কুচো চিংড়ি]

বাঁড়ুয্যে। কাল রাত্তিরে এলাম। তামাক খা’দিকি মধু।

[এই বলিয়া গাড়ু রাখিয়া হাতের কুচো চিংড়ি মেলিয়া ধরিলেন]

বাঁড়ুয্যে। সৈরুবী জেলেনীর আক্কেল দেখলি মধু, খপ করে হাতটা আমার ধরে ফেললে হে! কালে কালে কি হল বল দিকি রে, এই কি এক পয়সার চিংড়ি? বামুনকে ঠকিয়ে ক’ কাল খাবি মাগী, উচ্ছন্ন যেতে হবে না?

মধু। হাত ধরে ফেললে আপনার?

বাঁড়ুয্যে। আড়াইটি পয়সা শুধু বাকি, তাই বলে খামকা বাজারসুদ্ধ লোকের সামনে হাত ধরবে আমার! কে না দেখলে বল! মাঠ থেকে বসে এসে গাড়ুটি মেজে, নদীতে হাত-পা ধুয়ে মনে করলাম বাজারটা একবার ঘুরে যাই। মাগী এক চুবড়ি মাছ নিয়ে বসে—স্বচ্ছন্দে বললে কিনা কিচ্ছু নেই ঠাকুর, যা ছিল সব উঠে গেছে। আরে, আমার চোখে ধুলো দিতে পারিস? ডালাটা ফস কোরে তুলে ফেলতেই দেখি না,—অমনি খপ কোরে হাতটা চেপে ধরে ফেললে! তোর সাবেক আড়াইটা আর আজকের একটা—এই সাড়ে-তিনটে পয়সা নিয়ে আমি গাঁ ছেড়ে পালাব? কি বলিস মধু?

মধু। তাও কি হয়!

বাঁড়ুয্যে। তবে তাই বল্‌ না। গাঁয়ে কি শাসন আছে? নইলে ষষ্ঠে-জেলের ধোপা-নাপতে বন্ধ কোরে চাল কেটে তুলে দেওয়া যায় না? (হঠাৎ রমেশের প্রতি চাহিয়া) বাবুটি কে মধু?.

মধু। আমাদের ছোটবাবু যে! শ্রাদ্ধের দরুন দশটি টাকা বাকি ছিল বলে বাড়ি বয়ে দিতে এসেচেন।

বাঁড়ুয্যে। অ্যাঁ, রমেশ বাবাজী? বেঁচে থাকো বাবা, হাঁ, এসে শুনলাম একটা কাজের মত কাজ করেচ বটে। এমন খাওয়া-দাওয়া এ-অঞ্চলে কখনো হয়নি। কিন্তু বড় দুঃখ রইলো চোখে দেখতে পেলাম না। পাঁচ শালার ধাপ্পায় পড়ে কলকাতায় চাকরি করতে গিয়ে হাড়ীর হাল। আরে ছি, সেখানে মানুষ থাকতে পারে!

মধু। (তামাক সাজিয়া হুঁকা তাঁহার হাতে দিল) তার পরে? একটা চাকরি-বাকরি হয়েছিল ত?

বাঁড়ুয্যে। হবে না? এ কি ধান দিয়ে লেখাপড়া শেখা আমার? কিন্তু হলে কি হবে। যেমন ধোঁয়া, তেমনি কাদা। বাইরে বেরিয়ে গাড়িচাপা না পড়ে যদি ঘরে ফিরতে পারিস ত জানবি তোর বাপের পুণ্যি। কখনো গিয়েছিলি সেখানে?

মধু। আজ্ঞে না। মেদিনীপুর শহরটা একবার দেখেছি—।

বাঁড়ুয্যে। আরে দূর ব্যাটা পাড়াগেঁয়ে ভুত। কিসে আর কিসে! তোর রমেশবাবুকে জিজ্ঞেস কর্‌ না সত্যি না মিছে।—না মধু, খেতে না পাই ছেলেপুলের হাত ধরে ভিক্ষে করব,—বামুনের ছেলের তাতে কিছু আর লজ্জা নেই,—কিন্তু বিদেশ যাবার নামটি যেন না কেউ আমার কাছে করে। বললে বিশ্বেস করবি নে,সেখানে শুষনি কলমি চালতা আমড়া থোড় মোচা পর্যন্ত কিনে খেতে হয়। পারবি খেতে?—এই একটি মাস না খেয়ে খেয়ে যেন রোগা ইঁদুরটি হয়ে গেছি।

[এই বলিয়া তিনি হুঁকাটা মধুর হাতে দিয়া উঠিয়া গিয়া মধুর তেলের ভাঁড় হইতে খানিকটা তেল বাঁ হাতের তেলোয় লইয়া অর্ধেকটা দুই নাক ও দুই কানের গর্তে ঢালিয়া দিয়া বাকিটা মাথায় মাখিয়া ফেলিলেন]

বাঁড়ূয্যে। বেলা হল, অমনি ডুবটা দিয়ে একেবারে ঘরে যাই। এক পয়সার নুন দে দিকি মধু, পয়সাটা বিকেলবেলা দিয়ে যাব।

মধু। আবার বিকেলবেলা!

[মধু অপ্রসন্নমুখে দোকানে উঠিয়া ঠোঙায় করিয়া নুন দিল]

বাঁড়ুয্যে। (নুন হাতে লইয়া) তোরা সব হলি কি মধু? এ যে গালে চড় মেরে পয়সা নিস দেখি। (এই বলিয়া নিজেই এক খামচা নুন ঠোঙায় দিয়া রমেশের প্রতি মৃদু হাসিয়া) ঐ ত একই পথ,- চল না বাবাজী, গল্প করতে করতে যাই।

রমেশ। আমার একটু দেরি আছে।

বাঁড়ুয্যে। তবে থাক।

[এই বলিয়া গাড়ু লইয়া গমনোদ্যত হইলেন]

মধু। বাঁড়ুয্যেমশাই, সেই ময়দার পয়সা পাঁচ আনা কি অমনি—

বাঁড়ুয্যে। হাঁ রে মধু, তোদের কি লজ্জা-শরম, চোখের চামড়া পর্যন্ত নেই? পাঁচ ব্যাটা-বেটীর মতলবে কলকাতা যাওয়া-আসা করতে পাঁচ-পাঁচটা টাকা আমার গলে গেলো, আর, এই কি তোদের তাগাদা করবার সময় হলো? কারো সর্বনাশ, আর কারো পৌষ মাস বটে! দেখলে বাবা রমেশ, এদের ব্যাভারটা একবার দেখলে?

মধু। (লজ্জিত হইয়া) অনেক দিনের—

বাঁড়ুয্যে। হলই বা অনেক দিনের। এমন কোরে সবাই মিলে পিছনে লাগলে ত আর গাঁয়ে বাস করা যায় না।

[এই বলিয়া তিনি একরকম রাগ করিয়াই নিজের জিনিসপত্র লইয়া চলিয়া গেলেন। এবং পরক্ষণে বনমালী পাড়ুই ধীরে ধীরে প্রবেশ করিয়া রমেশের পায়ের কাছে ভূমিষ্ঠ প্রণাম করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন]

রমেশ। আপনি কে?

বনমালী। আপনাদের ভৃত্য, বনমালী পাড়ুই। গ্রামের মাইনার ইস্কুলের প্রধান শিক্ষক।

রমেশ। (সসম্ভ্রমে উঠিয়া দাঁড়াইয়া) আপনি ইস্কুলের হেডমাস্টার?

বনমালী। আপনার ভৃত্য। দু’দিন আপনাকে প্রণাম জানাতে গিয়েও দেখা হয়নি।

রমেশ। আপনার ইস্কুলের ছাত্রসংখ্যা কত?

বনমালী। বিয়াল্লিশ জন। গড়ে দু’জন পাস হয়। একবার নারাণ বাঁড়ুয্যের সেজছেলে জলপানি পেয়েছিল।

রমেশ। বটে?

বনমালী। আজ্ঞে হাঁ। কিন্তু এ-বছর চাল ছাওয়া না হলে বর্ষার জল আর বাইরে পড়বে না।

রমেশ। সমস্তই আপনাদের মাথায় পড়বে?

বনমালী। আজ্ঞে, হাঁ। কিন্তু সে এখনো দেরি আছে। কিন্তু সম্প্রতি আমরা কেউ তিন মাসের মাইনে পাইনি। মাস্টাররা বলচেন, ঘরের খেয়ে বনের মশা আর বেশীদিন তাড়ানো যাবে না।

রমেশ। আপনার মাইনে কত?

বনমালী। ছাব্বিশ। পাই তেরো টাকা পোনের আনা।

রমেশ। ছাব্বিশ টাকা মাইনে, আর পান তেরো টাকা পোনের আনা, এর মানে?

বনমালী। গভর্নমেন্টের হুকুম কিনা। তাই ছাব্বিশ টাকার রসিদ লিখে সব-ইনস্পেকটারকে দেখাতে হয়। নইলে সরকারী সাহায্য বন্ধ হয়ে যায়।

রমেশ। এতে ছেলেদের কাছে আপনার সম্মানহানি হয় না?

বনমালী। না, এই দেশাচার। তা ছাড়া ছেলেরা আমাকে বাঘের মত ভয় করে। বিতিয়ে পিঠ লাল করে দিই।

রমেশ। দেবার কথাই। আর সব মাস্টারের মাইনে কত?

বনমালী। তেইশ টাকা।

রমেশ। তেইশ! একজনের না তিনজনের?

বনমালী। তিনজনের। ন’টাকা, আট টাকা আর ছ’টাকা। এও বেণীবাবু দিতে নারাজ। তিনি বলেন, আট টাকাটা সাত টাকা হলেই হয় ভাল।

রমেশ। সে ঠিক। কর্তা বুঝি তিনিই?

বনমালী। হাঁ, তিনিই সেক্রেটারি। কিন্তু কখনো একটি পয়সাও দেন না। যদু মুখুয্যেমশায়ের কন্যা রমা,―সতীলক্ষ্মী তিনি―তাঁর দয়া না থাকলে ইস্কুল অনেক দিন পূর্বেই বন্ধ হয়ে যেত।

রমেশ। বলেন কি? এ ত শুনিনি।

বনমালী। হাঁ, শুধু তাঁর দয়াতেই ইস্কুল চলে ছোটবাবু, আর কারো নয়। একটি ভাইও তাঁর এই ইস্কুলে পড়ে। এ-বছর তিনিই চাল ছাইয়ে দেবেন বলেছিলেন, কিন্তু কেন যে দিলেন না বলতে পারিনে। হয়ত কেউ ভাঙ্‌চি দিয়েছে।

রমেশ। তাও হয় নাকি? আচ্ছা, আজ আপনি যান, আপনার বেলা হয়ে যাছে, কাল আপনাদের ইস্কুল আমি দেখতে যাব।

বনমালী। যে আজ্ঞে। আপনার দয়া হলে আর আমাদের ভাবনা কি?

[এই বলিয়া সে আর একবার হেঁট হইয়া প্রণাম করিয়া প্রস্থান করিল,
এবং অন্য পথ দিয়া গোপাল সরকার ও ভজুয়া দ্রুতপদে প্রবেশ করিল]

রমেশ। হঠাৎ আপনি এমন ব্যস্ত হয়ে যে সরকারমশাই?

গোপাল। বেণীবাবু ত অত্যন্ত অত্যাচার শুরু করে দিলেন। প্রত্যহ এ ত সহা যায় না ছোটবাবু।

রমেশ। ব্যাপার কি?

গোপাল। কাপাসডাঙার বাইশ-বিঘের বন্দটা এখনো ভাগ হয়নি, মুখুয্যেদের সঙ্গে যৌথ আছে। এক অংশ তাঁদের, এক অংশ বেণীবাবুর, আর এক অংশ আমাদের। সেদিন পাড়ের অতবড় তেঁতুলগাছটা কাটিয়ে তাঁরা দু’ অংশে ভাগ কোরে নিলেন, আমাদের একটা টুকরো পর্যন্ত দিলেন না। আপনাকে জানালাম, আপনি বললেন তুচ্ছ একটু কাঠের জন্যে ত আর ঝগড়া করা যায় না!

রমেশ। বাস্তবিক, এত সামান্য জিনিসের জন্যে কি বড়দার সঙ্গে ঝগড়া করা যায় সরকারমশাই?

গোপাল। সেই জোরে আজ বেণীবাবু জোর করে গড়পুকুরের মাছ ধরে নিয়ে গেছেন। বোধ করি মুখুয্যেবাড়িতে এতক্ষণ তার অংশ ভাগ হচ্চে।

রমেশ। কিন্তু ঠিক জানেন এতে আমাদের অংশ আছে?

গোপাল। তবে কি মিছেই এ কাজে মাথার চুল পাকালাম ছোটবাবু?

রমেশ। কিন্তু সবাই যে বলে রমা বড় ধর্মনিষ্ঠ মেয়ে! তাঁকে একবার জিজ্ঞাসা করে পাঠালেন না কেন?

গোপাল। শুনলাম তিনি নাকি হেসে বলেচেন, ছোটবাবুকে বোলো বিষয় তাঁর হাতে দিয়ে একটা মাস-হারা নিয়ে যেখানকার মানুষ সেখানে চলে যেতে। জমিদারি রক্ষে করা ভীতু লোকের কাজ নয়।

রমেশ। তবে বুঝি চুরি করাটাই সে মস্ত সাহসের কাজ বলে ঠাউরেচে? ভজুয়া সঙ্গে তোর লাঠি আছে?

ভজুয়া। (লাঠি আস্ফালন করিয়া) হুজুর।

রমেশ। সমস্ত মাছ গিয়ে কেড়ে নিয়ে আয়। একা পারবি ত?

ভজুয়া। (মাথা নত করিয়া) সির্ফ হুকুমকা নোকর হুজুর!

[এই বলিয়া প্রস্থানোদ্যত হইল]

গোপাল। (অকস্মাৎ অত্যন্ত ভয় পাইয়া) এ যে সত্যি সত্যিই ফৌজদারি বেধে যাবে ছোটবাবু।

রমেশ। উপায় কি?

গোপাল। হঠাৎ একটা কাজ করে ফেলা কি ভাল হবে ছোটবাবু?

রমেশ। তবে কি আপনি করতে বলেন?

গোপাল। আমি বলি,—আমি বলি,—থানায় একটা ডাইরি কোরে,—না হয়, ভাল কোরে একবার জিজ্ঞেসা কোরে—

রমেশ। তবে সেই ভাল সরকারমশাই। আমার মত ভীতু লোকের এর বেশী কিছু করা উচিতও নয়। ও-বাড়ির মাইজীকে চিনিস ত ভজুয়া? চিনিস! বেশ, তাঁকে গিয়ে জিজ্ঞেসা করে আয় গড়পুকুরের মাছে আমার অংশ আছে কিনা। যদি বলেন—আছে, নিয়ে আসিস। যদি বলেন—নেই, শুধু চলে আসবি। আমার নিশ্চয় বিশ্বাস, সরকারমশাই, সামান্য দুটো মাছের জন্যে রমা মিছে কথা বলবে না।

[ভজুয়ার দ্রুতপদে প্রস্থান]

পঞ্চম দৃশ্য

[বেণী ঘোষালের বাটীর অন্তঃপুরে বিশ্বেশ্বরীর গৃহ।
রমা প্রবেশ করিয়া সম্মুখের দাসীকে দেখিতে পাইল]

রমা। জ্যাঠাইমা কোথায় নন্দর মা?

দাসী। পূজোর ঘর থেকে এখনো বার হয়নি। ডেকে দেব দিদি?

রমা। তাঁর পূজোর ব্যাঘাত করে? না না, আমি বসচি। তিনি বেরুলে তাঁকে খবর দিয়ো যে আমি এসেচি।

দাসী। আচ্ছা দিদি।

[দাসী প্রস্থান করিল, এবং পরক্ষণে অতি
সন্তর্পণে পা টিপিয়া যতীন প্রবেশ করিল]

যতীন। দিদি!

রমা। (চমকিয়া মুখ ফিরাইয়া) অ্যাঁ, তুই কোথা থেকে রে?

যতীন। তোমার পেছনে পেছনে এসেচি, তুমি দেখতে পাওনি!

[এই বলিয়া সে রমাকে জড়াইয়া ধরিল]

রমা। কি দুষ্টু ছেলে রে তুই! বেলা হল ইস্কুলে যাবিনে?

যতীন। আমাদের যে আজ ছুটি দিদি।

রমা। ছুটি কিসের রে? আজ ত সবে বুধবার।

যতীন। হলই বা বুধবার! বুধ, বেস্পতি, শুক্‌কুর, শনি, রবি—এক্কেবারে পাঁচ দিন ছুটি।

রমা। কেন রে যতীন?

যতীন। আমাদের ইস্কুলের চাল ছাওয়া হচ্ছে যে। তার পর চুনকাম হবে, কত বই আসবে,—চার-পাঁচটা চেয়ার-টেবিল এসেচে,—একটা আলমারি, একটা বড় ঘড়ি এসেচে, একদিন তুমি গিয়ে দেখে এসো না দিদি।

রমা। বলিস কিরে?

যতীন। সত্যি দিদি। রমেশবাবু এসেচেন না!—তিনি সব করে দিচ্ছেন। আরও কত কি তিনি করে দেবেন বলেছেন। রোজ দু’ঘণ্টা করে এসে আমাদের পড়িয়ে যান।

রমা। হাঁ রে যতীন। তোকে তিনি চিনতে পারেন?

যতীন। হাঁ—

রমা। কি বলে তাঁকে তুই ডাকিস?

যতীন। ডাকি? আমরা ছোটবাবু বলি।

রমা। (ভাইটিকে বুকের কাছে টানিয়া লইয়া) ছোটবাবু কি রে, তিনি যে তোর দাদা হন।

যতীন। যাঃ—

রমা। যা কি রে? বেণীবাবুকে যেমন বড়দা বলে ডাকিস, এঁকে তেমনি ছোড়দা বলে ডাকতে পারিস নে?

যতীন। আমার দাদা হন তিনি? সত্যি বলচ দিদি?

রমা। সত্যি বলচি রে, তোর ছোড়দা হন তিনি।

যতীন। এতদিন তিনি কোথায় ছিলেন দিদি?

রমা। এতদিন লেখাপড়া শিখতে বিদেশে ছিলেন। তুই বড় হলে তোকেও এমনি কোরে বিদেশে গিয়ে থাকতে হবে যতীন, আমাকে ছেড়ে পারবি ত থাকতে?

যতীন। (বার দুই-তিন অনিশ্চিতভাবে মাথা নাড়িল) ছোড়দার সমস্ত পড়া শেষ হয়ে গেছে দিদি?

রমা। হাঁ ভাই, তাঁর সব পড়া সাঙ্গ হয়ে গেছে।

যতীন। কি করে তুমি জানলে?

রমা। (ক্ষণকাল স্তব্ধ থাকিয়া) নিজের পড়া শেষ না হলে কি কেউ পরের ছেলের জন্যে এত দিতে পারে? এটুকু বুঝি তুই বুঝতে পারিস নে?

যতীন। (মাথা নাড়িয়া জানাইল সে পারে) আচ্ছা, ছোড়দা কেন আমাদের বাড়ি আসেন না দিদি, বড়দা ত রোজ রোজ যান?

রমা। তুই তাঁকে ডেকে আনতে পারিস নে?

যতীন। এখুনি যাব দিদি?

রমা। (ভয়-ব্যাকুল দুই হাতে তাহাকে বুকে জড়াইয়া) ওরে, কি পাগলা ছেলে রে তুই! খবরদার যতীন, কখখনো এমন কাজ করিস নে ভাই, কখখনো করিস নে।

যতীন। তোমার চোখে জল এলো কেন দিদি? তুমি বারণ করলে ত আমি কখখনো কিছু করিনে।

রমা। (চোখ মুছিয়া ফেলিয়া) তা ত কর না জানি। তুমি আমার লক্ষ্মী মানিক ছোট্ট ভাই কিনা,—তাই।

যতীন। বাড়ি চল না দিদি!

রমা। তুই এখন যা, আমি একটুখানি পরে যাবো ভাই।

[যতীন প্রস্থান করিল

[বিশ্বেশ্বরী প্রবেশ করিলেন]

রমা। আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলে জ্যাঠাইমা?

বিশ্বেশ্বরী। এ-সব তোরা কি করেছিস মা? বেণীর চুরি-করার কাজে তুই কি করে সাহায্য করলি রমা?

রমা। আমি ত এ কাজ করতে তাঁকে বলিনি জ্যাঠাইমা!

বিশ্বেশ্বরী। স্পষ্ট বলনি বটে, তবুও অপরাধ তোমার কম হয়নি রমা।
রমা। কিন্তু তখন যে আর উপায় ছিল না জ্যাঠাইমা। ভজুয়া লাঠি-হাতে বাড়ির মধ্যে গিয়ে যখন দাঁড়ালো তখন মাছ ভাগ হয়ে গিয়েছিল। বড়দা তাঁর ভাগ নিয়ে চলে আসছিলেন, পাড়ার পাঁচজনেও দুটো-একটা নিয়ে ঘরে ফিরছিলেন।

বিশ্বেশ্বরী। কিন্তু আসলে মাছ আদায় করতে ভজুয়া যায়নি রমা। রমেশ নিজে মাছ-মাংস ছোঁয় না, এতে তার প্রয়োজন নেই। সে শুধু তোমারই কাছে জানতে পাঠিয়েছিল কাপাসডাঙার গড়পুকুরে তার অংশ আছে কিনা। নেই, এ কথা তুই বললি কি কোরে মা? (রমা অধোমুখে নিরুত্তর)

বিশ্বেশ্বরী। তোমার পরে যে তার কত শ্রদ্ধা, কত বিশ্বাস, সে তুমি জান না বটে, কিন্তু আমি জানি। সেদিন তেঁতুলগাছটা কাটিয়ে তোমরা দু’ঘরে ভাগ কোরে নিলে; গোপাল সরকারের কথাতেও রমেশ কান দিলে না, বললে, আমার ভাগ থাকলে আমি পাবই। রমা কখনো আমাকে ঠকিয়ে নেবে না, কিন্তু কাল যা করেচ মা, তাতে—একটা কথা তোমাকে আজ বলে রাখি মা। বিষয়-সম্পত্তির দাম যত বেশীই হোক, এই মানুষটির প্রাণের দাম তার অনেক বেশী। কারও কথায়, কোন বস্তুর লোভেই, রমা, চারিদিকের আঘাত দিয়ে এ-জিনিসটি তোমরা নষ্ট কোর না। যা হারাবে তা আর কোনদিন পূর্ণ হবে না।

রমেশ।(নেপথ্যে) জ্যাঠাইমা!

বিশ্বেশ্বরী। কে, রমেশ? আয় বাবা এই ঘরে আয়।

[রমেশ প্রবেশ করিতেই রমা আনতমুখে ঈষৎ আড় হইয়া বসিল]

বিশ্বেশ্বরী। হঠাৎ এমন দুপুরবেলা যে রে?

রমেশ। দুপুরবেলা না এলে যে তোমার কাছে একটু বসতে পাইনে জ্যাঠাইমা। তোমার কত কাজ। হাসলে যে? আচ্ছা, তোমার মনে পড়ে, ঠিক এমনি দুপুরবেলায় ছেলেবেলায় একদিন চোখের জলে তোমার কাছে বিদায় নিয়েছিলাম। আজও তেমনি নিতে এলাম। কিন্তু এই বোধ হয় শেষ নেওয়া জ্যাঠাইমা!

জ্যাঠাইমা। বালাই, ষাট! ও কি কথা বাবা? আয় আমার কাছে এসে বোস।

[রমেশ তাঁহার কাছে গিয়া বসিয়া একটুখানি হাসিল, কিন্তু জবাব দিল না।
বিশ্বেশ্বরী পরমস্নেহে তাহার মাথায় গায়ে হাত বুলাইয়া দিয়া কহিলেন—]

বিশ্বেশ্বরী। শরীরটা কি এখানে ভাল থাকচে না বাবা?

রমেশ। এ যে খোট্টার দেশের ডাল-রুটির শরীর জ্যাঠাইমা, এ কি এত শীঘ্র খারাপ হয়? তা নয়। তবে, এখানে আমি আর একদিনও টিকতে পারচি নে। আমার সমস্ত প্রাণ যেন কেবলই খাবি খেয়ে উঠচে।

বিশ্বেশ্বরী। শুনে বাঁচলাম বাবা, তোর শরীর খারাপ হয়নি। কিন্তু এই যে তোর জন্মস্থান, এখানে টিকতে পারচিস না কেন বল দেখি?

রমেশ। সে আমি বলবো না। আমি নিশ্চয় জানি, তুমি সমস্তই জান।

বিশ্বেশ্বরী। সব না জানলেও কতক জানি বটে, কিন্তু ঠিক সেই জন্যেই তোকে আমি কোথাও যেতে দেব না রমেশ।

রমেশ। কিন্তু এখানে কেউ আমাকে চায় না জ্যাঠাইমা।

বিশ্বেশ্বরী। চায় না বলেই তোর পালান চলবে না রমেশ। এই যে ডাল-রুটি-খাওয়া দেহের বড়াই করছিলি সে কি শুধু পালানোর জন্যে ! হাঁ রে, গোপাল সরকার বলছিল কি একটা রাস্তা মেরামতের জন্যে তুই চাঁদা তুলছিলি। তার কি হলো?

রমেশ। আচ্ছা, এই একটা কথাই তোমাকে বলি। কোন্ পথটা জান? যেটা পোস্টাফিসের সুমুখ দিয়ে বরাবর স্টেশনে গেছে। বছর-পাঁচেক পূর্বে বৃষ্টিতে ভেঙ্গে এখন একটা প্রকাণ্ড গর্ত হয়ে আছে। লোক পা পিছলে হাত-পা ভেঙ্গে পার হয়, কিন্তু মেরামত করে না। গোটা-কুড়ি টাকা মাত্র খরচ, কিন্তু এর জন্যে আজ আট-দশ দিন ঘুরে ঘুরেও আট-দশটা পয়সা পাইনি। কাল মধুর দোকানের সামনে দিয়ে রাত্রে আসচি, কানে গেল কে একজন আর সকলকে বারণ করে দিয়ে বলচে, তোরা কেউ একটা পয়সাও দিসনে। জুতো পায়ে মসমসিয়ে হাঁটা, দু′ চাকার গাড়িতে ঘুরে বেড়ানো,—ওরই ত গরজ। কেউ কিছু না দিলে ও আপনিই সারাবে। না করে, ‘বাবু-বাবু’ বলে একটুখানি পিঠে হাত বোলানো। বাস্।

বিশ্বেশ্বরী। (হাসিয়া) ওরা অমন বলে। তাই দে না বাপু সারিয়ে। তোর দাদামশায়ের ত ঢের টাকা পেয়েচিস।

রমেশ। (রাগিয়া উঠিয়া) কিন্তু কেন দেবো? আমার ভারী দুঃখ হচ্চে যে, না বুঝে অনেকগুলো টাকা এদের ইস্কুলের জন্যে খরচ করে ফেলেচি। এ-গাঁয়ের কারও জন্যে কিছু করতে নেই। এরা এত নীচ যে এদের দান করলে এরা বোকা মনে করে। ভাল করলে গরজ ঠাওরায়। এদের ক্ষমা করাও অপরাধ। ভাবে, ভয়ে ছেড়ে দিলে।

[শুনিয়া বিশ্বেশ্বরী হাসিতে লাগিলেন]

রমেশ। হাসচ যে জ্যাঠাইমা?

বিশ্বেশ্বরী। না হেসে কি করি বল ত বাছা ? হাঁ রে, রাগ করে তুই এই লোকগুলোকেই ছেড়ে যেতে চাস? আহা, এরা যে কত দুঃখী, কত দুর্বল, কত অবোধ তা যদি জানতিস রমেশ, এদের ওপর অভিমান করতে তোর আপনিই লজ্জা হোতো। (রমার প্রতি) তুমি যে সেই থেকে ঘাড় হেঁট করে বসে আছ মা,—হাঁ রমেশ, তোরা দুই ভাই-বোনে কি কথা-কোসনে?

রমা। (তেমনি অধোমুখে) আমি ত বিরোধ রাখতে চাইনি জ্যাঠাইমা। রমেশদা—

রমেশ ৷ (চমকিয়া) এ কে, রমা নাকি। একলা এসেচেন না সঙ্গে মাসিটিকেও এনেচেন?

বিশ্বেশ্বরী। এ তোর কি কথা রমেশ? তোদের ভাল করে চেনাশুনা নেই বলেই—

রমেশ। রক্ষে কর জ্যাঠাইমা, এর বেশী চেনাশোনার আশীর্বাদ আর কোরো না। বাড়ি গিয়ে মাসীটিকে যদি পাঠিয়ে দেন ত তোমাকে আমাকে দু’জনকেই চিবিয়ে খেয়ে তিনি ঘরে ফিরবেন! বাপরে, পালাই—

বিশ্বেশ্বরী। যাসনে রমেশ, শুনে যা!

রমেশ। (থমকিয়া দাঁড়াইয়া) না জ্যাঠাইমা, আমি সমস্ত শুনেচি। যারা অহঙ্কারের স্পর্ধায় তোমাকে পর্যন্ত মাড়িয়ে চলতে চায় তাদের হয়ে তুমি একটা কথাও বোলো না। তোমাকে অপমান করা আমার সইবে না।

[দ্রুতপদে প্রস্থান]

রমা। (বিশ্বেশ্বরীর মুখের প্রতি চাহিয়া সহসা কাঁদিয়া ফেলিল) তোমাকে অপমান করতে আমি মাসীকে পাঠিয়ে দি, এ কলঙ্ক আমার কেন জ্যাঠাইমা?

বিশ্বেশ্বরী। (রমাকে কাছে টানিয়া লইয়া) তোমাকে ও ভুল বুঝেচে মা, যা সত্যি সে ও একদিন জানবেই জানবে।

দ্বিতীয় অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

[তারকেশ্বরের গ্রাম্য পথ। প্রভাতবেলায় এই মাত্র সূর্যোদয় হইয়াছে। রমা নিকটস্থ কোন একটা পুষ্করিণী হইতে স্নান সারিয়া আর্দ্র-বস্ত্রে গৃহে ফিরিতেছিল, রমেশের সহিত তাহার একেবারে মুখোমুখি দেখা হইয়া গেল। একবার সে মাথায় আঁচল টানিয়া দিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু ভিজা কাপড় টানা গেল না। তখন তাড়াতাড়ি হাতের জলপূর্ণ ঘটিটি নামাইয়া রাখিয়া সিক্ত বসনতলে দুই বাহু বুকের উপর জড় করিয়া হেঁট হইয়া দাঁড়াইল]

রমা। আপনি এখানে যে?

রমেশ। (একপাশে সরিয়া দাঁড়াইয়া) আপনি কি আমাকে চেনেন?

রমা। চিনি। আপনি কখন তারকেশ্বরে এলেন?

রমেশ। এইমাত্র গাড়ি থেকে নেমেচি। আমার মামার বাড়ির মেয়েদের আসবার কথা ছিল, কিন্তু তারা কেউ আসেন নি।

রমা। এখানে কোথায় আছেন?

রমেশ। কোথাও না। পূর্বে কখনো আসিনি, আজকের দিনটা কোনমতে কোথাও কাটাতে হবে। যা হোক একটা আশ্রয় খুঁজে নেবো।

রমা। সঙ্গে ভজুয়া আছে ত?

রমেশ। না, একাই এসেচি।

রমা। বেশ যা হোক! (এই বলিয়া রমা হাসিয়া হঠাৎ মুখ তুলিতেই আবার দু’জনের চোখাচোখি হইল। সে মুখ নীচু করিয়া মনে মনে একটু দ্বিধা করিয়া শেষে বলিল) তবে আমার সঙ্গেই আসুন। (এই বলিয়া সে ঘটিটা তুলিয়া লইয়া অগ্রসর হইতে উদ্যত হইল)

রমেশ ৷ আমি যেতে পারি, কারণ, এতে দোষ থাকলে আপনি কখনই ডাকতেন না। আপনাকে যে আমি চিনি না তাও নয়। কিন্তু কিছুতেই স্মরণ করতে পারচি নে। মনে হচ্ছে কখনো স্বপ্নে দেখে থাকব। আপনার পরিচয় দিন।

রমা। আসুন। পথে যেতে যেতে আমার পরিচয় দেব। স্বপ্ন কবেকার দেখা মনে পড়ে?

রমেশ। না। সঙ্গে আপনার আত্মীয় কেউ নেই?

রমা। না, দাসী আছে, সে বাসায় কাজ করচে, চাকরটা গেছে বাজারে। তা ছাড়া আমি ত প্রায়ই এখানে আসি,—সমস্তই চিনি।

রমেশ। কিন্তু আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্চেন কেন?

রমা। নইলে আপনার খাওয়া-দাওয়ার ভারী কষ্ট হবে।

রমেশ। হলই বা। তাতে আপনার কি?

রমা। পুরুষমানুষকে সব বুঝোন যায়, যায় না শুধু এই কথাটি। আমি রমা!

রমেশ। রমা?

রমা। হাঁ, যার সঙ্গে পরিচয় থাকাও আপনার ঘৃণার বস্তু—সেই।

রমেশ। কিন্তু আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?

রমা। আমার বাসায়। সেখানে মাসী নেই, ভয় নেই, আসুন।

[উভয়ের প্রস্থান]

[পরক্ষণে নিম্নলিখিত ব্যক্তিগণের প্রবেশ। নাপিত ও তাহাকে দ্রুতপদে অনুসরণ করিয়া
অপর এক ব্যক্তি। মুখে প্রচুর দাড়ি-গোঁফ ও মাথায় সুদীর্ঘ কেশ, খানিকটা ক্ষুর দিয়া কামানো। এই লোকটি মানত করিয়া ঠাকুরের কাছে চুল-দাড়ি দিতে আসিয়াছিল]

যাত্রী। (ব্যস্তভাবে) নাপিত, নাপিত, তুমি নাপিত নাকি হে? দাও ত দাদা এইটুকু কামিয়ে। খপ্‌ কোরে একটা ডুব দিয়ে বাবার পূজোটুকু সেরে দিয়ে আসি। বাবার থান, নইলে দুটো পয়সার মজুরি নয়,—এই সিকিটি নিয়ে দাও দাদা খপ্‌ করে। সাড়ে বারোটার গাড়ি ধরতে হবে,—ঘরে ছেলেটার আবার দু’দিন জ্বর। দাও দাও, এখানেই বসে যাবো নাকি?

নাপিত। (সিকিটি হাতে লইয়া বেশ করিয়া পরীক্ষা করিয়া পরে ট্যাঁকে গুঁজিয়া বারদুই তাহার আপাদ-মস্তক নিরীক্ষণ করিয়া) এই যে! দাড়ি-চুল কে এঁটো করে দিয়েচে দেখচি?

যাত্রী। এঁটো? এঁটো কি রকম? দেখচো বাবার দাড়ি-চুল, এ কি আমার? এঁটো কি রকম?

নাপিত। (হাত দিয়া দেখাইয়া) এই ত খাবলে দুই-ই এঁটো করে দিয়েচে।

যাত্রী। এঁটো হয়ে গেল? এক ব্যাটা নাপতে সিকিটি হাতে নিয়ে এইটুকু ক্ষুর বুলিয়ে দিয়ে বলে কর্তার সিকিটি অমনি দাও। বললুম, কর্তা আবার কে? এই তো গদিতে পাঁচ-সিকে জমা দিয়ে হুকুম নিয়ে আসচি। বলে, দেখ গে তবে আর কোথাও। সিকি ত গেছেই, রাগ করে উঠে এলুম। দাও দাদা, তোমার বাপ-মায়ের কল্যাণে—

নাপিত। আর গণ্ডা-আষ্টেক পয়সা বার কর দিকি। তার চার-আনা, কর্তার চার-আনা।

যাত্রী। আবার তার চার-আনা, কর্তার চার-আনা? মানুষ-জনকে কি পাগল করে দেবে নাকি? দাও তবে আমার সিকি ফিরিয়ে, আমি তার কাছে গিয়েই কামাব।

নাপিত। যাবে যাও না। আমি কি তোমাকে ধরে রেখেচি নাকি?

যাত্রী। (রাগতভাবে) সিকি ফিরিয়ে দাও বলচি।

নাপিত। কিসের সিকি শুনি? এতক্ষণ দর-দস্তুর করলি মাগ্‌না নাকি?

যাত্রী। আবার তুই- তোকারি?

নাপিত। ওঃ—গুরুঠাকুর এসেচেন! এ তারকেশ্বর থান, মনে রাখিস! চোখ রাঙাবি ত গলাধাক্কা খাবি। কোন্‌ বাবা তোকে কামিয়ে দেয় যা না।

[ছেলের হাত ধরিয়া একটি প্রৌঢ়াগোছের স্ত্রীলোক ও তাহার
আঁচল ধরিয়া মন্দিরের দুইজন কর্মচারীর দ্রুতপদে প্রবেশ]

১ম কর্মচারী। অ্যাঁ! বাবাকে ঠকানো! ঠকানোর আর জায়গা পাসনি মাগী? মোটে পাঁচসিকে মানোত?

প্রৌঢ়া। (কাতর-কণ্ঠে) না বাবা ঠকাই নি। যা মানোত করেছিলুম তাই জমা দিয়েচি।

১ম কর্মচারী। কবে মানোত করেছিলি, বল, বল, শুনি?

প্রৌঢ়া। বছর-তিনেক আগে, সেই বানের সময়। সত্যি বলচি বাবা—

২য় কর্মচারী। সত্যি বলচ? মিথ্যেবাদী কোথাকার। বছর-তিনের মধ্যে ঘরে আর ব্যারাম-স্যারাম হয়নি? আর মানত করবার দরকার হয়নি? কখখনো না। দে মাগী বুকে হাত দে। মনে করে দ্যাখ। ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করিস—এ যে-সে দেবতা নয়, স্বয়ং তারকনাথ।

প্রৌঢ়া। (অত্যন্ত ভয় পাইয়া) শাপ-মন্যি দিও না বাবা, এই আর একটি টাকা নিয়ে—

১ম কর্মচারী। (হাত পাতিয়া গ্রহণ করিয়া) একটি টাকা? অন্ততঃ আরো পাঁচটি টাকা মানোত করেছিলি। দ্যাখ ভেবে। বাবার কৃপায় আমরা সব জানতে পারি, আমাদের ঠকান যায় না।

২য় কর্মচারী। দে না মা টাকা ক’টা ফেলে! ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করিস, কেন আর বাবার কোপে পড়বি? তোর ব্যাটার কল্যাণে দে, দিয়ে দে ফেলে।

প্রৌঢ়া। (কাঁদ-কাঁদ হইয়া) টাকা যে আর নেই বাবা। কোথায় পাব টাক।

১ম কর্মচারী। কেন ঐ ত তোর গলায় সোনার কবচ রয়েচে। ওটা পোদ্দারের দোকানে রেখে কি আর পাঁচটা টাকা পাবিনে? সঙ্গে না হয় লোক দিচ্ছি, দোকান দেখিয়ে দেবে, তার পরে একদিন ফিরে এসে খালাস করে নিয়ে যাবি।

[একজন স্ত্রীলোককে ঘিরিয়া পাঁচ-সাত জন ভিখারিণীর প্রবেশ]

১ম ভিখারিণী। দে মা তোর ব্যাটা-বেটীর কল্যাণে—

২য় ভিখারিণী। দে মা একটি পয়সা তোর মেয়ে-জামাইয়ের কল্যাণে—

৩য় ভিখারিণী। দে মা তোর বাপ-মায়ের—

৪র্থ ভিখারিণী। দে মা তোর স্বামী-পুত্তুরের—

[সকলে মহা ঠেলাঠেলি টানাটানি করিতে লাগিল]

চুলওয়ালা যাত্রী। চাইনে দাড়ি-চুল দিতে। চাইনে মানত শোধ করতে।

মানতওয়ালা প্রৌঢ়া। এ যে আমার ইষ্টি-কবচ বাবা! বাঁধা দেব কি করে?

ভিখারীতাড়িত স্ত্রীলোক। ওগো কি সর্বনাশ! কে আমার আঁচল কেটে নিলে?

ভিখারীর দল। তোর স্বামী-পুত্তুরের কল্যাণে দে একটা পয়সা। দে একটা আধলা—

১ম কর্মচারী। ব্যাটা-বেটী নিয়ে ঘর করিস বাছা! বাবার থান!

নাপিত। কামাবে যে গো?

যাত্রী। কামাবো? রইল তারকনাথ মাথায়। চললুম ঘরে ফিরে।

[প্রস্থান

ভিখারীতাড়িত স্ত্রীলোক। ঘরে ফিরব কি করে গো! কে আঁচল কেটে নিলে।

ভিখারীর দল। দে মা একটা পয়সা। দে মা একটা আধলা।

[বলিতে বলিতে ঠেলিয়া লইয়া গেল]

মানতওয়ালা প্রৌঢ়া। দোহাই বাবা তারকনাথ, আমার ইষ্টি-কবচটি আর নিয়ো না।

[ছেলের হাত ধরিয়া দ্রুতপদে প্রস্থান]

১ম কর্মচারী। এক টাকার বেশী হোল না আদায়।

২য় কর্মচারী। নেই মাগীর আর কিছু।

[প্রস্থান

নাপিত। যাক চার গণ্ডা পয়সাই কোন্‌ মাথা খুঁড়লে মেলে?

[প্রস্থান

দ্বিতীয় দৃশ্য

[তারকেশ্বরের বাসাবাটী। সামান্য রকমের একটা বিছানা পাতা, তাহাতে বসিয়া রমেশ। রমা ব্যস্ত হইয়া প্রবেশ করিল]

রমা। বেশ আপনি! রান্নাঘরে যেই গেছি আর একটু তরকারি আনতে, অমনি উঠে হাত-মুখ ধুয়ে
দিব্যি ভালমানুষটির মত বিছানায় এসে বসেচেন! কেন উঠলেন বলুন ত?

রমেশ। ভয়ে।

রমা। ভয়ে! কার ভয়ে! আমার?

[এই বলিয়া সে অদূরে উপবেশন করিল]

রমেশ। সে ভয় ছিলই, তা ছাড়া আর একটা আছে। আজ জ্বরের গত ঠেকচে।

রমা। জ্বরের মত ঠেকচে? এ কথা আগে বললেন না কেন? স্নান করে ভাত খেতে বসলেনই বা কোন্‌ বুদ্ধিতে?

রমেশ। খুব সহজ বুদ্ধিতে। যে আয়োজন, এবং যে যত্ন করে খেতে দিলে তাকে না বলে ফেরাবোই বা কোন্‌ সুবিবেচনায়? ভাবলাম, হোক গে জ্বর,—ওষুধ খেলেই সারবে। কিন্তু এ অন্ন না খেয়ে যদি ফাঁকে পড়ি, এ ফাঁক এ জীবনে আর ভরবে না।

রমা। যান এই বিদেশে সত্যিই যদি জ্বর হয়ে পড়ে, বলুন ত সে কত বড় অন্যায়?

রমেশ। অন্যায় ত আছেই। কিন্তু যে-রানীকে এতটুকু দেখে গেছি, তার স্বহস্তের রান্না ত্যাগ করাটাই কি কম অন্যায় হতো?

রমা। তবু ঐ কথা! এ বিদেশে ত কোন আয়োজনই করতে পারিনি।

রমেশ। আয়োজনের কথা কে ভাবচে? ভাবচি শুধু যত্নের কথাটুকু। এ আমি কোথায় পেতাম?

রমা। (সলজ্জে) কেন, আপনাকে যত্ন করবার লোকের কি অভাব আছে নাকি?

রমেশ। কোথায় পাব বল ত? ছেলেবেলায় মা মারা গেলেন, তার পরে জ্যাঠাইমার হাত থেকে গিয়ে পড়লাম বহু দূরে মামার বাড়িতে। মামীমা বেঁচে নেই, সমস্ত বাড়িটাই যেন হোটেল। সেখান থেকে পড়তে গেলাম এলাহাবাদে—সেও হোটেল। তার পরে গেলাম ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে। সেখানে বহুকাল কাটল, কিন্তু ছেলেবেলার সেই হোটেলবাসের দুঃখ আর ঘুচল না। খেতে হয় খাও,—বাধা দেবারও শত্রু নেই, এগিয়ে দেবারও মিত্র নেই।

[রমা নীরব]

রমেশ। শরীর অসুস্থ, সাধ মিটিয়ে আজ খেতে পারলাম না, তবু মনে হচ্চে যেন জীবনের এই প্রথম সুপ্রভাত, এ জীবনের সমস্ত ধারাটা যেন একটা বেলার মধ্যেই একেবারে বদলে গেল।

রমা। (অধোমুখে) কি সমস্ত বাড়িয়ে বলচেন বলুন ত?

রমেশ। বাড়ানোর শক্তি থাকলে বাড়াতাম, কিন্তু সে সাধ্য নেই।

রমা। ভাগ্যে নেই, নইলে এর বেশি শক্তি থাকলে আমাকে ছুটে পালাতে হতো। আমারও ভাগ্য ভাল যে, ঘরে ফিরে গিয়ে নিন্দে করবেন না, বলে বেড়াবেন না যে ওদের রমা এমনি যে আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে পেটভরে দুটো খেতেও দেয়নি।

রমেশ। না রানী, নিন্দে করব না, সুখ্যাতি করেও বেড়াব না। আজকের দিনটা আমার নিন্দে-সুখ্যাতির বাইরে। বাস্তবিক, খাওয়া জিনিসটার মধ্যে যে পেট-ভরানোর অতিরিক্ত আরও কিছু আছে, আজকের পূর্বে এ কথা যেন আমি জানতামই না।

রমা। আজই বুঝি প্রথম জানলেন?

রমেশ। তাই ত জানলাম।

রমা। কিন্তু এরও ঢের বেশি জানবার আছে। সেদিনটায় আমাকে কিন্তু একটা খবর পাঠিয়ে দেবেন।

রমেশ। এ কথার মানে?

রমা। সব কথার মানে যে জানতেই হবে, তারই বা কি মানে আছে রমেশদা? আচ্ছা, সত্যি বলুন ত, আমাকে কি তখন একেবারে চিনতেই পারেন নি?

রমেশ। কি করেই বা পারব বল ত? সেই ছেলেবেলায় দেখা। ফিরে এসে ত তোমার মুখ দেখতে পাইনি। যখনি চেষ্টা করেচি তখনি হয়ত মুখ ফিরিয়ে নিয়েচ, না হয় ত অন্যদিকে চেয়ে আছ। তাই ত আজ হঠাৎ মনে হয়েছিল, এ মুখ বোধ হয় কখনো স্বপ্নে দেখে থাকব। এমন স্বপ্ন ত—

রমা। আচ্ছা, আপনি রাত্রে কি খান?

রমেশ। যা জোটে তাই।

রমা। আচ্ছা, আপনি এত অগোছালো কেন বলুন ত? শুনি জিনিসপত্র কোথায় থাকে কোথায় যায়, কোন ঠিকানা নেই। কিছুর ওপরেই যেন একটা মায়া-মমতা নেই। সমস্তই যেন শূন্যে ভেসে বেড়ায়।

রমেশ। এত নিন্দে কার কাছে শুনলে?

রমা। সে শুনেই বা আপনার হবে কি? ফিরে গিয়ে তার সঙ্গে ঝগড়া করবেন নাকি?

রমেশ। আমি কি কেবল ঝগড়া করেই বেড়াই?

রমা। তাই ত করেন। এসে পর্যন্ত আমার সঙ্গে ত কেবল ঝগড়া করেই বেড়াচ্চেন।

মাসীই কি বাড়ির মালিক নাকি, না আমি তাঁকে শিখিয়ে দিই যে, তিনি বারণ করেচেন বলেই আমাদের মুখ-দেখা পর্যন্ত বন্ধ করেচেন? পুকুরের মাছ কি আমি চুরি করেছিলাম যে, আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন তার কৈফিয়ত চাইতে?

রমেশ। কৈফিয়ত ত নয়, একটা জবাব। কিন্তু সে জবাবের ত কোন অমর্যাদা হয়নি রানী!

রমা। হয়নি। কিন্তু, হয়নি বলেই ত তার সমস্ত অমর্যাদার বোঝা গিয়ে চেপেচে আজ আমার মাথায়। এর ভার কি আমি জানিনে, না এ শাস্তি আমি বুঝিনে? গ্রামে যে যা করবে আপনার বিরুদ্ধে, আমিই কি হব তার দায়ী? আপনার সমস্ত বিতৃষ্ণা কি গিয়ে পড়বে শুধু আমারই ওপরে? এই ন্যায় বুঝি শিখে এসেচেন বিদেশ থেকে?

[দাসীর প্রবেশ]

দাসী। দিদি, নটবর কি জিনিসপত্র সব বাঁধবে? নইলে ছ’টার গাড়ি ত ধরা যাবে না।

রমা। তার তাড়াতাড়ি কি কুমুদা?

দাসী। যে মেঘ করেচে দিদি, রাত্তিরে হয়ত ভয়ানক জল হবে।

রমা। হলই বা। মাঠে বসে ত আর তোরা নেই।

দাসী। না, তাই বলচি।

[দাসীর প্রস্থান]

রমেশ। তোমাদের বুঝি সন্ধ্যার গাড়িতে যাবার কথা?

রমা। হাঁ। আর আপনার?

রমেশ। আমার? আমার ত কোনমতে আজকের দিনটা এখানে থাকতেই হবে।

রমা। একে শরীর ভাল নয়, তাতে বর্ষাকাল, থাকবেন কোথায়?

রমেশ। যেখানে হোক। যারা সব পূজো দিতে আসে তারা থাকে কোথায়?

রমা। তাদের জায়গা আছে। আপনি ত পূজো দেবেন না, আপনাকে থাকতে দেবে কেন?

রমেশ। (হাসিয়া) তাদের গায়ে কি নাম লেখা থাকে নাকি?

রমা। (হাসিয়া) থাকে। ভক্ত-লোকেরা বাবার কৃপায় পড়তে পারে। অভক্তদের তারা দূর করে দেয়। বিছানা-টিছানা কিছুই সঙ্গে আনেন নি ত?

রমেশ। না। বিছানা তাঁদের আনবার কথা।

রমা। খাসা ব্যবস্থা। দেহ অসুস্থ, আকাশে জল এলো বলে, সঙ্গে চাকর নেই, একটা বিছানা নেই, খাবার বন্দোবস্ত নেই, অথচ চিন্তার বালাইটুকু পর্যন্ত নেই। কারা কোথা থেকে কবে আসবেন, তার প্রতি নির্ভর। একেবারে পরমহংস অবস্থা। এমন হোল কি করে?

রমেশ। যাদের কেউ কোথাও নেই, তাদের আপনিই হয়।

রমা। তাই ত দেখচি। না হয় আজ এই বাড়িতেই থাকুন।

রমেশ। কিন্তু যাঁর বাড়ি—

রমা। তাঁর আপত্তি নেই। অপদার্থ মানুষগুলোকে তিনি দয়া করেন। থাকতেও দেন।

রমেশ। তোমাকে কিন্তু এই বিছানাটা রেখে যেতে হবে রমা।

রমা। তা যাব। কিন্তু ফিরিয়ে দেবেন,—হারিয়ে ফেলবেন না যেন।

রমেশ। বিছানা হারাব কি রকম? আমাকে তুমি কি যে ভাব তার ঠিকানা নেই। কে আমার সম্বন্ধে তোমার মন একেবারে বিগড়ে দিয়েচে।

রমা। (হাসিয়া) কে আর দেবে, হয়ত মাসীই দিয়েচে। কিন্তু তিনি এখানে নেই, আপনি নির্ভয়ে বিশ্রাম করুন। আমি ততক্ষণ কাজকর্ম একটু সেরে নিই।

[এই বলিয়া সে যাইবার জন্য উঠিয়া দাঁড়াইল]

রমেশ। যাঁর বাড়ি তাঁর সঙ্গে একটা পরিচয় না হলে—

রমা। তাঁর সঙ্গে আপনার এই এতটুকু বয়স থেকে পরিচয় আছে। ভাবনার কারণ নেই, ছেলেবেলায় যাকে রানী বলে ডাকতেন—এ তারই বাড়ি।

রমেশ। বাড়ি তোমার? এখানে বাড়ি কিসের জন্যে?

রমা। বললাম ত। জায়গাটা আমার বড় ভাল লাগে, প্রায় আসি,—তাই।

রমেশ। ঠাকুর-দেবতার প্রতি তোমার খুব ভক্তি, না?

রমা। একে আর ভক্তি বলে না। তবু যতদিন বেঁচে আছি চেষ্টা করতে হবে ত?

[দাসীর প্রবেশ]

দাসী। টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হলো দিদি, যেতে আজ কষ্ট হবে।

রমা। তবে না-ই গেলি আজ। নটবরকে বলে দে, কাল যাওয়া হবে।

দাসী। বাঁচি তা হলে। কিন্তু যাবার কথা, বাড়িতে যে তাঁরা ভাববেন?

রমা। মাঝে মাঝে একটু ভাবা ভাল কুমুদা। তুই যা, আমি যাচ্চি।

[দাসীর প্রস্থান]

রমেশ। কেবল আমার জন্যেই তোমাদের যাওয়া হোল না।

রমা। আপনার জন্যে নয়, আপনার অসুখের জন্যে। মুখ দেখে বেশ বোঝা যাচ্চে, হয়ত জ্বর হবে। এ অবস্থায় ফেলেই বা যাই কি করে?

রমেশ। আমি ত তোমার কেউ নই রমা, বরঞ্চ পথের কাঁটা। তবু এক গ্রামের লোক বলে যে যত্ন আজ তোমার কাছে পেলাম তা মুখে বলবার নয়।

রমা। তা হলে না-ই বা বললেন। আর দু’দিন বাদে ভুলে গেলেও অভিযোগ করব না।

[এই বলিয়া সে চলিয়া যাইতে উদ্যত হইল]

রমেশ। তোমাকে আশীর্বাদ করি রমা, তুমি সুখী হও, দীর্ঘজীবী হও—

রমা। (সহসা ফিরিয়া দাঁড়াইয়া) এইবার কিন্তু সত্যিই রাগ করব রমেশদা। আমি বিধবা,—আমাকে দীর্ঘজীবী হতে বলা শুধু অভিশাপ দেওয়া। কোন শুভাকাঙ্ক্ষীই কোনদিন এ আশীর্বাদ আমাদের করে না। এখন আমি চললাম।

[দ্রুতপদে প্রস্থান]

তৃতীয় দৃশ্য

[গ্রাম্য পথ। সময় অপরাহ্ণপ্রায়। তিন দিন অত্যধিক ও অবিশ্রাম বারিপাতে পুষ্করিণী-খাল-বিল-নালা সমস্তই জলে পরিপূর্ণ হইয়া গেছে। পথ অতিশয় কর্দমাক্ত। ক্ষণকাল মাত্র বৃষ্টির বিরাম পড়িয়াছে। লাঠি ও ছাতি হাতে বেণী ও গোবিন্দ প্রবেশ করিল। দুর্গম পথে চলার চিহ্ন তাহাদের সর্বাঙ্গে বিদ্যমান]

গোবিন্দ। (অন্তরাল হইতেই উচ্চকণ্ঠে) বলি, কিসের এত খাতির হে! কুটুমের দল এয়েচেন আবদার নিয়ে বাঁধ কাটিয়ে জল নিকেশ করে দাও, মাঠ হেজে যাবে! গেল, গেলই! ছোটলোক ব্যাটাদের আস্পর্ধার কথা শুনে হাসব কি কাঁদব ভেবে পাইনে বড়বাবু!

বেণী। বল ত খুড়ো! চাষা ব্যাটাদের একশো বিঘের মাঠ হেজে যাবে, জল বার করে দাও। সুমুখের বিলটার যে বছর সালিয়ানা দুশো টাকার জলকর বিলি হয়। একটা মাছও কি তা হলে থাকবে?

গোবিন্দ। তাও কি কখনো থাকে? ছোটলোক ব্যাটারা, দুটো টাকার মুখ কখনো একসঙ্গে দেখিস নে তোরা,—জানিস, দু-দুশো টাকার লোকসান কাকে বলে? বলি, লোক-জন সব মোতায়েন রেখেছ ত? লুকিয়ে-চুরিয়ে ব্যাটারা কোথাও কেটেকুটে দেবে না ত? বলা যায় না বড়বাবু! প্রাণের দায়ে শালারা সব পারে।

বেণী। দরোয়ান আর গোপাল লস্করকে পাঠিয়েচি পাহারা দিতে। আর খবর পাঠিয়েচি রমার পীরপুরের প্রজা আকবর লেঠেল আর তার দুই ব্যাটাকে। একশো জনের মোয়াড়া আটকাতে পারে তারা।

গোবিন্দ। ঠিক করেচ বাবা। কলকেটি সেজে ফুঁ দিচ্চি, আর তোমার চাকর গিয়ে হাজির। বলি, ভিজতে ভিজতে কেন রে হরি? বলে, বড়বাবু তোমাকে ডাকচে। মিথ্যে বলব না বাবা, হাতের হুঁকো হাতে রইল, একবার টানবার সময় হল না। ছাতি আর ছড়িটি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। তোমার খুড়ী বললে এ দুর্যোগে যাও কোথা? বললুম, থাম্‌ মাগী, আবার পিছু ডাকে! দেখচিস বড়বাবু ডাকতে পাঠিয়েচে না? তার আবার সুযোগ-দুর্যোগ কি?

বেণী। জান ত খুড়ো তোমার পরামর্শ ছাড়া আমি এক-পা কোথাও চলিনে। আমার কাছে কান্নাকাটি কোরে যখন হোল না, তখন ব্যাটারা গেল ছোটবাবুর কাছে দরবার করতে। হোঁৎকা-গোঁয়ার, ওর কি! হয়ত বলে বসবে, হোকগে লোকসান আমাদের, দে তোরা বাঁধ কেটে।

গোবিন্দ। পারে, ও হারামজাদা সব পারে বড়বাবু। (গলা ছোট করিয়া) বলি রমাকে একটা খবর দিয়ে রেখেচ ত? সে ছুঁড়ীরও সব সময়ে মেজাজের ঠিক থাকে না। গরীব-দুঃখীর কান্না দেখলে হয়ত বা সায় দিয়েই বসবে।

বেণী। নাঃ—সে ভয় নেই খুড়ো, তাকে আমি সকালবেলাতেই টিপে দিয়ে রেখেচি। কাল রাত্তির থেকেই একটা কানাঘুষো শুনচি কিনা! ঐ যে আবার ক’ ব্যাটা এই দিকেই আসছে।

[কয়েকজন কৃষকের প্রবেশ। তাহাদের সর্বাঙ্গ
জলে ও কাদায় একাকার হইয়া গেছে]

কৃষকেরা। (সমস্বরে) দোহাই বড়বাবু, গরীবদের বাঁচান। এ আবাদ পচে গেলে আমরা ছেলেপুলে নিয়ে অনাহারে মরব।

গোবিন্দ। কেন হে সনাতন, মুরুব্বিরা ছুটে গেলেন যে ছোটবাবুর কাছে! এখন বাঁচান না তিনি!

সনাতন। যে গেছে সে গেছে গাঙ্গুলীমশাই, আমরা এই পা-দুটিই জানি, এই পা ধরেই পড়ে থাকব। (বেণীর পদতলে পড়িয়া ক্রন্দন)

২য় কৃষক। (বেণীর পদতলে পড়িয়া) আমাদের রাখতে হয় রাখুন, মারতে হয় মারুন,—পা আমরা ছাড়ব না।

বেণী। (জোর করিয়া পা ছাড়াইয়া লইয়া) যা—যা—আমি দু’-দুশো টাকার জলকর নষ্ট করতে পারব না। চল খুড়ো আমারা যাই, আমাদের আরও কাজ আছে।

[বেণী ও গোবিন্দ যাইতে উদ্যত হইল]

কৃষকেরা। বড়বাবু, গাঙ্গুলীমশাই, তবে কি সত্যি সত্যিই আমরা মারা যাব?

গোবিন্দ। (ফিরিয়া দাঁড়াইয়া মুখ বিকৃত করিয়া) মারা যাবি কি যাবিনে তার আমরা কি জানি?

[উভয়ের প্রস্থান]

কৃষকেরা। হা ভগবান! দুঃখীদের কি তবে সত্যিই মারবে? ওপরে বসে সব দেখচ, তবু কোন উপায় করে দেবে না?

[সকলের দ্রুতবেগে প্রস্থান]

চতুর্থ দৃশ্য

[রমার বহির্বাটী। কাল সন্ধ্যা। প্রাঙ্গণের একদিকে চণ্ডীমণ্ডপের কিয়দংশ দেখা যাইতেছে এবং অন্যদিকে ছোট একটি তুলসীমঞ্চ। রমা সন্ধ্যাদীপ হাতে ধীরে ধীরে প্রবেশ করিয়া মঞ্চমূলে প্রদীপ রাখিয়া গলায় আঁচল দিয়া প্রণাম করিল। এমনি সময়ে তাহার আনত মাথার কাছে নিঃশব্দ পদক্ষেপে রমেশ আসিয়া দাঁড়াইল]

রমা। (মুখ তুলিয়া অকস্মাৎ রমেশকে দেখিয়া বিস্ময়ে) এ কি আপনি যে!

রমেশ। অত্যন্ত প্রয়োজনে আসতে হলো রমা।

রমা। (ঈষৎ হাসিয়া) বেশ আসা! কিন্তু হঠাৎ কেউ যদি দেখে ত ভাববে আমি বুঝি প্রদীপ জ্বেলে আপনাকেই নমস্কার করছিলাম। এমনি কোরে বুঝি দাঁড়ায়?

রমেশ। রমা, আমি শুধু তোমার কাছেই এসেচি।

রমা। (হাসিমুখে) সে আমি জানি। নইলে কি মাসীর কাছে এসেচেন আমি বলচি? (এই বলিয়া সে প্রদীপ হাতে লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল) কি আদেশ বলুন?

রমেশ। তুমি নিশ্চয়ই সব শুনেচ। জল বার করে দেবার জন্যে তোমার মত নিতে এসেচি।

রমা। আমার মত?

রমেশ। হ্যাঁ, তোমার মত নিতেই ছুটে এসেচি রমা। আমি নিশ্চয় জানি দুঃখীদের এত বড় বিপদে তুমি কখনোই না বলতে পারবে না।

রমা। জল বার কোরে দেওয়াই উচিত বটে, কিন্তু কি কোরে হবে রমেশদা, বড়দার যে মত নেই।

[বেণী ও গোবিন্দর প্রবেশ]

বেণী। না, আমার মত নেই। কেন থাকবে? দু-তিনশো টাকার মাছ বেরিয়ে যাবে সে খবরটা রেখেছ কি? এ টাকাটা কি চাষারা দেবে?

রমেশ। চাষারা গরীব, টাকা তারা কোথায় পাবে? কথাটা একবার বুঝে দেখুন বড়দা।

বেণী। তা দেখেচি। কিন্তু নাহক এত টাকা আমরাই বা কেন লোকসান করতে যাব এ কথাটাও ত বুঝে উঠতে পারিনে রমেশ। (গোবিন্দর প্রতি) খুড়ো, এমনি করে ভায়া আমার জমিদারি রাখবেন! ওহে রমেশ, হারামজাদারা সকাল থেকে এতক্ষণ আমার ওখানে পড়েই মড়া-কান্না কাঁদছিল,—আমি জানি সব। বলি, তোমার সদরে কি দারোয়ান নেই? তার পায়ে নাগরা জুতো নেই? যাও ঘরে গিয়ে সেই ব্যবস্থা করগে, জল আপনি নিকেশ হয়ে যাবে।

[এই বলিয়া নিজের রসিকতায় গোবিন্দর সহিত
একযোগে হিঃ হিঃ হাঃ হাঃ—করিয়া হাসিতে লাগিল]

রমেশ। কিন্তু ভেবে দেখুন বড়দা, আমাদের তিন ঘরের দু’শো টাকা মাত্র লোকসান বাঁচাতে গিয়ে গরীবদের সারা বছরের অন্ন মারা যাবে। যেমন করে হোক তাদের পাঁচ-সাত হাজার টাকা ক্ষতি হবেই।

বেণী। হল হলই। তাদের পাঁচ হাজারই যাক আর পঞ্চাশ হাজারই যাক, এই গোটা সদরটা খুঁড়ে ফেললেও ত পাঁচটা পয়সা বার হবে না ভায়া, যে, ও-শালাদের জন্যে দু-দু’শ টাকা উড়িয়ে দিতে হবে?

রমেশ। এরা সারা বছর খাবে কি?

বেণী। (হাসিয়া, মাথা নাড়িয়া, থুথু ফেলিয়া, অবশেষে স্থির হইয়া) খাবে কি? দেখবে ব্যাটারা যে-যার জমি বন্ধক রেখে আমাদের কাছেই টাকা ধার করতে ছুটে আসবে। ভায়া, মাথাটা একটু ঠাণ্ডা কোরে চল। কর্তারা এমনি কোরেই বাড়িয়ে গুছিয়ে এই যে এক-আধ টুকরো উচ্ছিষ্ট ফেলে রেখে গেছেন, এই আমাদের নেড়ে-চেড়ে, গুছিয়ে-গাছিয়ে, খেয়েদেয়ে আবার ছেলেদের জন্যে রেখে যেতে হবে। ওরা খাবে কি? ধার-কর্জ করে খাবে। নইলে আর ব্যাটাদের ছোটলোক বলেচে কেন?

গোবিন্দ। এ যে মুনি-ঋষিদের শাস্ত্রবাক্য বাবাজী, এ ত আর তোমার আমার কথা নয়!

রমেশ। বড়দা, আপনি যখন কিছুই করবেন না স্থির করেচেন তখন তর্ক কোরে আর লাভ নেই।

বেণী। না নেই। (রমার প্রতি) তোমার পীরপুরের আকবর আলি আর তার ব্যাটাদের খবর পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে রমা। (গোবিন্দর প্রতি) চল খুড়ো, আমরা ও-দিকটা একবার দেখেশুনে আসি গে। সন্ধ্যাও হল।

গোবিন্দ। চল বাবা চল!

[উভয়ের প্রস্থান]

রমেশ। হুকুম দাও রমা, ওঁর একার অমতেই এত বড় অন্যায় হতে পারে না। আমি এখুনি গিয়ে বাঁধ কাটিয়ে দেব।

রমা। কিন্তু মাছ আটকে রাখার কি বন্দোবস্ত করবেন?

রমেশ। এত জলে কোন বন্দোবস্ত হওয়াই সম্ভবপর নয়। এ ক্ষতি আমাদের স্বীকার করতেই হবে। না হলে গ্রাম মারা যায়।

[রমা নীরব]

রমেশ। তা হলে অনুমতি দিলে?

রমা। না। এত টাকা আমি লোকসান করতে পারব না। তা ছাড়া বিষয় আমার ভাইয়ের। আমি অভিভাবক মাত্র।

রমেশ। না, আমি জানি অর্ধেক তোমার।

রমা। শুধু নামে, বাবা নিশ্চয় জানতেন সমস্ত বিষয় যতীনই পাবে। তাই অর্ধেক আমার নামে দিয়ে গেছেন।

রমেশ। (মিনতির কণ্ঠে) রমা, এ ক’টা টাকা? এদিকে তোমাদের অবস্থা সকলের চেয়ে ভাল। তোমার কাছে এ ক্ষতি ক্ষতিই নয়। আমি মিনতি জানাচ্চি, এর জন্যে এত লোককে অন্নহীন কোরো না। যথার্থ বলচি, তুমি যে এত নিষ্ঠুর হতে পার আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।

রমা। নিজের ক্ষতি করতে পারিনে বলে যদি নিষ্ঠুর হই, না হয় তাই। ভাল, আপনার যদি এতই দয়া, নিজেই না হয় ক্ষতিপূরণ করে দিন না।

রমেশ। রমা, মানুষ খাঁটি কি না চেনা যায় শুধু টাকার সম্পর্কে। এই জায়গাটায় নাকি ফাঁকি চলে না, তাই এইখানেই মানুষের যথার্থ রূপ ধরা পড়ে। তোমারও আজ তাই পড়েচে। কিন্তু তোমাকে আমি কখনো এমন করে ভাবিনি। ভেবেচি, তুমি এর চেয়ে অনেক, অনেক ওপরে। কিন্তু তুমি তা নও। তোমাকে নিষ্ঠুর বলাও ভুল। তুমি অতি নীচ, অতি ছোটো।

রমা। কি আমি? কি বললেন?

রমেশ। তুমি অত্যন্ত হীন এবং নীচ। আমি যে কত ব্যাকুল হয়ে উঠেচি, সে তুমি টের পেয়েছ বলেই আমার কাছে দুঃখীর মুখের গ্রাসের দাম আদায়ের দাবী করলে। কিন্তু বড়দাও মুখ ফুটে এ কথা বলতে পারেন নি। পুরুষ হয়েও তাঁর মুখে যা বেধেছে, নারী হয়ে তোমার মুখে তা বাধেনি।—একটা কথা তোমাকে আজ বলে যাই রমা। আমি এর চেয়েও ঢের বেশি ক্ষতিপূরণ করতে পারি, কিন্তু সংসারে যত পাপ আছে, মানুষের দয়ার ওপর জুলুম করাটাই সবচেয়ে বড়। আজ তুমি তাই করে আমার কাছে টাকা আদায়ের ফন্দি করেচ।

[রমা বিহ্বল হতবুদ্ধির ন্যায় নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল]

রমেশ। আমার দুর্বলতা কোথায় সে তোমাদের অগোচর নেই বটে, কিন্তু সেখানে পাক দিয়ে আজ একবিন্দু রস পাবে না। কিন্তু কি আমি করব তাও তোমাকে জানিয়ে দিয়ে যাই। এখুনি গিয়ে নিজে জোর করে বাঁধ কাটিয়ে দেব,—তোমরা পার আটকাবার চেষ্টা করো গে।

[এই বলিয়া রমেশ চলিয়া যাইতেছিল, রমা ফিরিয়া ডাকিল]

রমা। শুনুন। আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমাকে যত অপমান করলেন, আমি তার একটারও জবাব দেব না। কিন্তু এ কাজ আপনি কিছুতেই করবার চেষ্টা করবেন না।

রমেশ। কেন?

রমা। কারণ, এত অপমানের পরেও আমার আপনার সঙ্গে বিবাদ করতে ইচ্ছে করে না। আর—

রমেশ। আর কি?

রমা। আর, আর—হয়ত, আকবর-সর্দারের দল এসে পড়েচে।

রমেশ। কারা তোমার আকবর-সর্দারের দল আমি জানিনে—জানতেও চাইনে। কলহ-বিবাদের অভিরুচি আমারও নেই, কিন্তু, তোমার সদ্ভাবের মূল্যও আর আমার কাছে কিছুমাত্র নেই।

[দ্রুতপদে প্রস্থান]

[মাসীর প্রবেশ]

মাসী। কে অমন কোরে হাঁকাহাঁকি করছিল রে রমা, যেন চেনা-গলা?

রমা। কেউ না।

মাসী। না বললেই শুনব? সন্ধ্যেটি দিয়ে আহ্নিক করতে বসেচি, যেন ষাঁড়-চেঁচানো চেঁচাচ্ছে। আহ্নিক ফেলে রেখে উঠে আসতে হোল।

রমা। সে চলে গেছে। তুমি ফিরে গিয়ে আবার আহ্নিকে বসো গে। কুমুদা!

[দাসীর প্রবেশ]

কুমুদা। কেন দিদি?

রমা। একবার জ্যাঠাইমার ওখানে যাব, আমার সঙ্গে চলো।

মাসী। সেখানে আবার কিসের জন্যে?

রমা। দেখ মাসি, সব কথাই তোমাকে জানতে হবে তার মানে নেই। চল্‌ কুমুদা।

কুমুদা। চল দিদি।

[উভয়ের প্রস্থান]

মাসী। বাপ্‌রে! যেন মারমুখী! তবু যদি না লোকে তারকেশ্বরের কথা শুনত! আমি তাই লোকের সঙ্গে ঝগড়া করে মরি!

[প্রস্থান]

[বেণী, গোবিন্দ, আহত আকবর ও তাহার
দুই পুত্র গহর ও ওস্‌মানের প্রবেশ]

আকবর। (খুঁটি ঠেস দিয়া বসিয়া পড়িল। তাহার সমস্ত মুখ রক্তে ভাসিতেছে) আল্লা!

গহর। (নিজের রক্তধারা হাত দিয়া মুছিয়া ফেলিয়া) বাপজান্‌, দরদ কি বেশি মালুম হচ্চে?

আকবর। আল্লা!

বেণী। কথা শোন্‌ আকবর। থানায় চল্‌। সাত বছর যদি না তাকে দিতে পারি ত ঘোষাল-বংশের ছেলে নই আমি।

[রমার প্রবেশ]

রমা। অ্যাঁ! এমনধারা কে করলে তোমাদের আকবর?(এই বলিয়া সে অদূরে বসিয়া পড়িল)

আকবর। (আকাশের প্রতি হাত তুলিয়া) আল্লা!

বেণী। আল্লা! আল্লা! এখানে বসে আল্লা আল্লা করলে হবে কি? বলচি থানায় চল্‌। যদি না এর শোধ দশ বচ্ছর ঠেলতে পারি ত,—রমা, তুমি চুপ করে রইলে কেন? বল না একবার থানায় যেতে।

রমা। কে তোমাকে এমন কোরে জখম করলে আকবর?

আকবর। ছোটবাবু দিদিঠাকরুন।

রমা। এ কি কখনো হতে পারে আকবর? ছোটবাবু একলা তোমাদের তিন বাপ-ব্যাটাকে জখম কোরে দিলে? এ যে তিনশো জনে পারে না!

আকবর। তাই ত হোলো দিদিঠাকরান! সাবাস! মায়ের দুধ খেয়েছিল বটে! লাঠি ধরলে বটে!

গোবিন্দ। সেই কথাই ত থানায় গিয়ে বলতে বলচি রে ব্যাটা! কার লাঠিতে তুই জখম হলি? ছোটবাবুর, না সেই হারামজাদা ভোজোর?

আকবর। সেই বেঁটে হিন্দুস্থানীটার? লাঠির সে জানে কি? কি বলিস রে গহর, তোর পয়লা চোটেই সে বসেছিল, না রে?

[গহর কথা কহিল না, মাথা নাড়িয়া সায় দিল]

আকবর। মোর হাতের চোট পেলে সে বাঁচত না। গহরের লাঠিতেই বাপ কোরে সে বসে পড়লে দিদিঠাকরান।

আকবর। তখন ছোটবাবু তার লাঠি তুলে নিয়ে বাঁধ এট্‌কে দাঁড়াল দিদিঠাকরান, তিন বাপ-ব্যাটায় মোরা হটাতে নারলাম। আঁধারে বাঘের মত তেনার চোখ জ্বলতে লাগল। কইলেন, আকবর, বুড়োমানুষ তুই সরে যা। বাঁধ কেটে না দিলে সারা গাঁয়ের লোক মারা পড়বে, তাই কেট্‌তেই হবে। তুইও ত রে চাষী, তোর আপন গাঁয়েও ত জমিজমা আছে, সমঝে দেখ্‌ রে, সব বরবাদ হয়ে গেলে তোর ক্যামন লাগে? মুই সেলাম কোরে কইলাম, আল্লার কিরে ছোটবাবু, তুমি একটিবার পথ ছাড়। দিদিঠাকরান পেঠিয়েছে মোদের, মোরা জান কবুল দিইচি। তিনি চমকে উঠে কইলেন, তোদের রমা পাঠিয়েছে আকবর, আমারে মারতে? মুই কইলাম, তবে বাঁধ এট্‌কো না ছোটবাবু, ঘরকে যাও। তোমার আড়ালে দেঁড়িয়ে ঐ যে কয় সুম্মুন্দি মুয়ে কাপড় জড়ায়ে ঝপাঝপ্‌ কোদাল মারচে ওদের শিরগুলো ফাঁক কোরে দিয়ে যাই।

বেণী। বেইমান ব্যাটারা,—তাকে সেলাম বাজিয়ে এসে এখানে চালাকি মারা হচ্চে।

আকবর। (তিন বাপ-ব্যাটায় প্রতিবাদের ভঙ্গীতে হাত তুলিয়া) খবরদার বড়বাবু! বেইমান কোয়ো না। মোরা মোছলমানের ছ্যালে সব সইতে পারি,—ও পারি না।—(হাত দিয়া কতকটা রক্ত মুছিয়া ফেলিয়া) অ্যারে বেইমান কয় দিদি? ঘরের মধ্যি বসি বেইমান কইচো বড়বাবু, চোখে দ্যেখলি জানতে পারতে ছোটবাবু কি!

বেণী। (মুখ বিকৃত করিয়া) ছোটবাবু কি! তাই থানায় গিয়ে জানিয়ে আয় না? বলবি, তোরা বাঁধ পাহারা দিচ্ছিলি, ছোটবাবু চড়াও হয়ে তোদের মেরেচে।

আকবর। (জিভ কাটিয়া) তোবা! তোবা! দিনকে রাত করতি বল বড়বাবু?

বেণী। না হয় আর কিছু বলবি। আজ রাত্তিরে গিয়ে জখম দেখিয়ে আয় না,—কাল ওয়ারেন্ট বার কোরে একেবারে হাজতে পুরবো। রমা, তুমি ভাল কোরে একবার বুঝিয়ে বল না? এমন সুবিধা যে আর কখনো পাওয়া যাবে না!

[রমা নীরবে একবার আকবরের মুখের প্রতি চাহিল]

আকবর।(মাথা নাড়িয়া) না দিদিঠাকরান, ও পারব না।

বেণী।(ধমক দিয়া) পারবি নে কেন শুনি?

আকবর।(ক্রুদ্ধকণ্ঠে) কি কও বড়বাবু, সরম নেই মোর? পাঁচখানা গাঁয়ের লোকে মোরে সর্দার কয় না? দিদিঠাকরান, তুমি হুকুম দিলে আসামী হয়ে জ্যাল যাতি পারি, ফৈরিদি হব কোন্‌ কালামুয়ে?

রমা। সত্যিই পারবে না আকবর?

আকবর। না, দিদিঠাকরান, আর সব পারি, সদরে গিয়ে গায়ের চোট দেখাতে না পারি। ওঠ্‌ রে গহর, এইবার ঘরকে যাই। মোরা নালিশ করতি পারব না।

[এই বলিয়া তাহারা উঠিয়া দাঁড়াইল ও চলিয়া যাইতে লাগিল]

গোবিন্দ। সত্যিই যে চলে যায় বড়বাবু? কিছুই যে হোলো না?

বেণী ! বারণ কর না রমা, এমন সুযোগ ফসকালে যে আর কখনো মিলবে না।

[রমা অধোমুখে নির্বাক হইয়া রহিল; আকবর ও তাহার
দুই পুত্র লাঠিতে ভর দিয়া কোনমতে বাহির হইয়া গেল]

বেণী। ও—বোঝা গেছে সমস্ত।

গোবিন্দ। হুঁ, যা শোনা গেল তা মিথ্যে নয় দেখচি।

[উভয়ের দ্রুতপদে প্রস্থান]

রমা। রমেশদা, এ যে তুমি পারো, এত শক্তি যে তোমার ছিল এ কথা ত আমি স্বপ্নেও ভাবিনি!

পঞ্চম দৃশ্য

[গ্রামের একাংশ। কয়েকটা ভাঙ্গা মন্দিরের কিছু-কিছু দেখা যাইতেছে। বৃক্ষ-লতা-গুল্মে সমস্ত স্থান সমাকীর্ণ। মনে হয় এদিকে কদাচিৎ কখনো কেহ আসে মাত্র]

[বেণী ও গোবিন্দর প্রবেশ]

গোবিন্দ। (সচকিতে ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত করিয়া) কে জানে কোন্‌ শালা আবার কোথা দিয়ে শুনবে। যে জাল বিস্তার করে দড়িটি ধরে বসে আছি বাবা, একটুখানি টান দিয়েচি অমনি ঝুপ করে পড়েচে।

বেণী। কাজ হাঁসিল ত?

গোবিন্দ। নইলে কি আর তোমাকে এই বনের মধ্যে নাহক ডেকে এনেচি বাবা! তুই শালা ভৈরব আচায্যি,—তোর নেই এক কড়ার মুরোদ, তুই যাস আমাদের বিপক্ষে? তুই যাস পরকে আগলাতে? এখন বাস্তুভিটেটা বাঁচা! কি করে মেয়ের বিয়ে দিস তা একবার দেখি!

বেণী। ডিক্রি হয়েছে তাহলে?

গোবিন্দ। (দুই হাতের দশ আঙুল তুলিয়া ধরিয়া) একটি হাজার! কিন্তু শুধু কথায় চিঁড়ে ভিজবে না বাবা, আধাআধি।

বেণী। (অত্যন্ত খুশী হইয়া) আধাআধি কেন খুড়ো, দশ-আনা ছ’-আনা।

গোবিন্দ। ভ্যালা মোর বাপ্‌ রে! শুধু এই নয় বাবা। সুমুখে পূজো। যদু মুখুয্যের কন্যা এবার মাকে কি করে আনেন তা দেখতে হবে। আসচে ফাগুনে ঘটা করে ভাইয়ের পৈতেটি কি করে দেন তাও একবার নেড়ে-চেড়ে পাঁচজনকে দেখাব,—তবে আমার নাম গোবিন্দ গাঙ্গুলী।

বেণী। তারকেশ্বরের কাণ্ডটা তা হলে সত্যি বল?

গোবিন্দ। সত্যি নয়? শালা নটবর কি কিছু বলতে চায়? বকশিশ কোবলে, পিঠে হাত বুলিয়ে কিছুতেই কিছু হয় না। ব্যাটা আর ভাঙ্গে না। তখন ফস করে পায়ের ধুলো মাথায় দিয়ে বললাম, বাবা, রমার চাকরই হও আর যাই হও,—শুদ্দুর ছাড়া আর কিছু নও, ছেলেপুলে নিয়ে ঘর কর, বামুনের পায়ের ধূলো মাথায় করে যদি মিথ্যে বল, তে-রাত্তির পোয়াবে না, সর্পাঘাত হবে। ব্যাটা যেন কাঁদো-কাঁদো হয়ে গেল। সাহস দিয়ে বললাম, নটবর, চাকরি গেলে আবার ঢের হবে, কিন্তু প্রাণ গেলে আর হবে না। তখন ফড়্‌ফড়্‌ করে আগাগোড়া ব্যাপারটা বলে ফেললে।—ঠাকরুনের ছ’টার গাড়িতে আর বাড়ি আসা হলো না। বাবু রাত্তিরে বাসায় রইলেন, খাওয়া-দাওয়া, হাসি-গল্প—যাক, পরচর্চায় কাজ নেই—ঘটনাটা সত্যি৷

বেণী। দেখলে না খুড়ো, কিছুতেই আকবরকে থানায় যেতে দিলে না!

গোবিন্দ। দেবে কি করে? দেওয়া কি যায় বাবা? যায় না।

বেণী। হুঁ। অন্ধকার হয়ে আসচে, যাওয়া যাক চল।

গোবিন্দ। চল। (হঠাৎ বেণীর হাতটা ধরিয়া ফেলিয়া) কিন্তু বাবা, ভাইপোটা যে অর্ধেক বিষয় টেনে নেবে তা চলবে না বলে রাখচি। সামলাতে হবে।

বেণী। নির্ভয়ে থাকো খুড়ো, আমি বেঁচে থাকতে তা হবে না।

গোবিন্দ। হাটের অংশটা এবার ছেড়ে দিতে রমা পথ পাবে না তাও তোমাকে বলে রাখলাম বড়বাবু। কিন্তু চেপে। ব্যাপারটা হঠাৎ চাউর করে ফেলো না।

বেণী। (ঈষৎ হাসিয়া) দেখা যাক।

[উভয়ের প্রস্থান]

ষষ্ঠ দৃশ্য

[রমেশের বাটীর অন্তঃপুর। তাহার শয়নকক্ষে বসিয়া রমেশ গভীর রাত্রি পর্যন্ত লেখাপড়া করিতেছিল। অকস্মাৎ নেপথ্যে কাহার ক্রন্দনের শব্দ শুনা গেল, এবং পরক্ষণে ভৈরব আচার্য গোপাল সরকারের গলা জড়াইয়া মড়াকান্না কাঁদিতে কাঁদিতে প্রবেশ করিল। রমেশ ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল]

ভৈরব। (সরোদনে) বাবু, আমি ধনেপ্রাণে মারা গেছি।

রমেশ। ব্যাপার কি সরকারমশাই?

গোপাল সরকার। কাজ সেরে শুতে যাচ্ছিলেম বাবু, হঠাৎ কোথা থেকে ছুটে এসে আচায্যিমশাই গলা জড়িয়ে ধরেছে। গলাও ছাড়ে না, কান্নাও থামায় না।

রমেশ। কি হলো আচায্যিমশাই?

ভৈরব। বাবু গো, আমি এক্কেবারে গেছি! ছেলেপুলের হাত ধরে এবার গাছতলায় শুতে হবে।

রমেশ। গাছতলায় কেন? ঘর কি হলো?

ভৈরব। আর নেই,—নিলেম করে নিয়েচে।

রমেশ। এই ত সকালেও ছিল। এরই মধ্যে কে নিলেম করে নিলে?

ভৈরব। কে এক সনৎ মুখুয্যে বাবু, গোবিন্দ গাঙ্গুলীর খুড়শ্বশুর। (ক্রন্দন)

গোপাল। আরে, আমার গলা ছাড়ুন না। বাবুকে সমস্ত বুঝিয়ে বলুন,—কে নিলে, কেন নিলে, খামোকা আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকলে কি হবে? ছাড়ুন।

ভৈরব। (গলা ছাড়িয়া) এক হাজার সাতাশ টাকা পাঁচ আনা ছ’ পাই,—বাবু গো, ধনেপ্রাণে গেলাম।

গোপাল। টাকা কর্জ নিয়েছিলেন?

ভৈরব। না, এক পয়সা না সরকারমশাই। দেনা মিথ্যে, খত মিথ্যে―কবে নালিশ হলো, কবে সমন হলো, কবে ডিক্রি হয়ে বাড়ি-ঘরদোর নিলাম হয়ে গেল―কিছুই জানিনে বাবু। কাল কানাঘুষো খবর পেয়ে সদরে গিয়ে টের পেলাম—ছেলেপুলে নিয়ে আমাকে গাছতলায় শুতে হবে। এক হাজার সাতাশ টাকা পাঁচ আনা ছ’ পাই—

রমেশ। এমন ভয়ানক কথা ত কখনো শুনিনি সরকারমশাই?

গোপাল। পাড়াগাঁয়ে এমন অনেক হয় বাবু। যারা গরীব, বড়লোকের কোপে পড়ে তারা সত্যিই ধনেপ্রাণে মারা যায়, এ সমস্তই বেণীবাবু আর গাঙ্গুলীমশায়ের কাজ―আচায্যিমশাই বরাবর আমাদের দিকে আছেন বলেই তাঁর এই বিপদ।

ভৈরব। হাঁ বাবু, তাই। তাই আমার এই বিপদ।

রমেশ। কিন্তু এর উপায় সরকারমশাই?

গোপাল। অনেক টাকার ব্যাপার। এ ঋণ মিথ্যে, দলিল মিথ্যে, সাক্ষী মিথ্যে,—কে হয়ত ওঁর নাম লিখে সমন নিয়েচে, কে হয়ত আদালতে গিয়ে কবুল জবাব দিয়েচে, সদরে গিয়ে সমস্ত তদন্ত না করে ত কিছুই বলবার জো নেই।

রমেশ। তাই আপনি যান। সমস্ত খবর নিয়ে যত টাকা লাগে এর প্রতিকার করুন। এমন করুন যেন এতবড় অত্যাচার করতে আর কেউ না সাহস করে।

ভৈরব। (অকস্মাৎ রমেশের পা জড়াইয়া ধরিয়া) বাবু গো, আপনি চিরজীবী হোন। ধনেপুত্রে লক্ষ্মীলাভ করে আপনি রাজা হোন। ভগবান আপনাকে যেন—

রমেশ। (পা ছাড়াইয়া লইয়া) আপনি বাড়ি যান আচায্যিমশাই, যা করা উচিত আমি করব।

ভৈরব। ভগবান যেন আপনাকে―

রমেশ। রাত অনেক হলো আচায্যিমশাই, আজ আমি বড় শ্রান্ত।

ভৈরব। ভগবান যেন আপনাকে দীর্ঘজীবী করেন, ভগবান যেন আপনাকে রাজা করেন―

[ইত্যাদি বলিতে বলিতে ভৈরবের প্রস্থান]

রমেশ। (দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া) সরকারমশাই, এই আমাদের গর্বের ধন। এই আমাদের শুদ্ধশান্ত ন্যায়নিষ্ঠ বাঙলার পল্লীসমাজ।

গোপাল। হাঁ, এই। সবাই জানবে এ কাজ বেণীবাবুর, সবাই গোপনে জল্পনা করে বেড়াবে, কিন্তু মুখ ফুটে কেউ এ অত্যাচারের প্রতিবাদ করবে না। সেবার গাঙ্গুলীমশাই বিধবা বড়ভাজকে মেরে বাড়ি থেকে বার করে দিলে, কিন্তু বেণীবাবু সহায় বলে সবাই চুপ করে রইল। সে কেঁদে সকলকে জানালে, সকলেই বললে, আমরা কি কোরব। ভগবানকে জানাও তিনিই এর বিচার করবেন।

রমেশ। তার পরে?

গোপাল। তার পরে সেই গাঙ্গুলীমশাই-ই সকলের জাত মেরে বেড়াচ্চেন। মৃত পল্লীসমাজ কথাটি বলবার সাহস রাখে না। অথচ, আমিই ছেলেবেলায় দেখেচি বাবু, এমন ধারা ছিল না। বিধবা বড়ভাজের গায়ে হাত দিয়ে কেউ সহজে নিস্তার পেত না। তখন সমাজ দণ্ড দিত, এবং সে দণ্ড অপরাধীকে মাথা পেতে নিতে হতো।

রমেশ। তবে কি পল্লীসমাজ বলে কিছুই আর নেই?

গোপাল। যা আছে সে ত এসে পর্যন্ত স্বচক্ষেই দেখচেন। যা আর্তকে রক্ষে করে না, দুঃখীকে শুধু দুঃখের পথেই ঠেলে দেয়, তাকেই সমাজ বলে কল্পনা করার মহাপাপ। আমাদের নিয়ত রসাতলের দিকেই টেনে নিয়ে যাচ্চে।

রমেশ। (আশ্চর্য হইয়া) সরকারমশাই, এ-সকল কথা আপনি জানলেন কার কাছে?

গোপাল। আমার স্বর্গীয় মনিবের কাছে। এইমাত্র যে ভৈরবকে উদ্ধার করতে চাইলেন, এ শক্তি আপনি পেলেন কোথায়? এ তাঁরই দয়া। এমনি কোরে বিপন্নকে উদ্ধার করতে তাঁকে যে আমি বহুবার দেখেচি ছোটবাবু।

রমেশ। (দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া) বাবা—

গোপাল। রাত প্রায় শেষ হয়ে এল বাবু, আপনি একটু শোন।

রমেশ। হাঁ শুই। আপনি বাড়ি যান সরকারমশাই।

[গোপাল সরকার প্রস্থান করিলেন। রমেশ শয়নের আয়োজন করিতেছিল,
সহসা দ্বারের কাছে কি একটা দেখিতে পাইয়া চমকিয়া প্রশ্ন করিল—]

রমেশ। কে? কে দাঁড়িয়ে?

[যতীন দ্বারের কাছে মুখ বাড়াইয়া]

যতীন। ছোড়দা, আমি।

রমেশ। (কাছে গিয়া) যতীন? এত রাত্রে? আমায় ডাকচ?

যতীন। হাঁ, আপনাকে।

রমেশ। আমাকে ছোড়দা বলতে তোমাকে কে বলে দিলে?

যতীন। দিদি।

রমেশ। রমা! তিনি কি তোমাকে কিছু বলতে পাঠিয়েছেন?

যতীন। না। দিদি বললেন, আমাকে সঙ্গে কোরে তোর ছোড়দার বাড়িতে নিয়ে চল্‌। ঐ যে ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন।

[এই বলিয়া সে দরজার বাহিরে চাহিল]

রমেশ। (ব্যস্ত হইয়া সরিয়া আসিয়া) আজ আমার একি সৌভাগ্য! কিন্তু আমাকে ডেকে না পাঠিয়ে এত রাত্রে নিজে এলে কেন? এস, ঘরে এস।

[রমা অত্যন্ত দ্বিধাভরে ভিতরে প্রবেশ করিয়া দ্বারের অনতিদূরে মেঝের উপর বসিয়া পড়িল। যতীন দিদির কাছে আসিয়া বসিতে যাইতেছিল, কিন্তু রমেশ তাহাকে একটি আরাম-কেদারায় আনিয়া শোয়াইয়া দিল]

রমা। রাত আর নেই, ভোর হয়ে এসেছে, (অধোমুখে) শুধু একটি জিনিস আপনার কাছে ভিক্ষে চেয়ে নেবো বলে আপনার বাড়িতে এসেচি। দেবেন বলুন?

রমেশ। আমার কাছে ভিক্ষে চাইতে? আশ্চর্য! কি চাই বল?

রমা। (মুখ তুলিয়া ক্ষণকাল অপলক-চক্ষে রমেশের মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল) আগে কথা দিন।

রমেশ। (মাথা নাড়িয়া) তা পারিনে। তোমাকে কোন প্রশ্ন না করেই কথা দেবার শক্তি যে তুমি নিজের হাতেই ভেঙ্গে দিয়েচ রমা।

রমা। আমি ভেঙ্গে দিয়েচি?

রমেশ। তুমিই। তুমি ছাড়া এ শক্তি সংসারে আর কারু ছিল না। রমা, আজ তোমাকে একটা সত্যি কথা বলব।—ইচ্ছে হয় বিশ্বাস কোরো, ইচ্ছে না হয় কোরো না। কিন্তু জিনিসটা যদি না মরে একেবারে নিঃশেষ হয়ে যেতো, হয়ত এ কথা তোমাকে কোনদিন শোনাতে পারতাম না। কিন্তু আজ নাকি আর কোন পক্ষেই লেশমাত্র ক্ষতির সম্ভাবনা নেই, তাই আজ জানাচ্চি, সেদিন পর্যন্তও তোমাকে অদেয় আমার কিছুই ছিল না। কিন্তু কেন জানো?

রমা। (মাথা নাড়িয়া জানাইল) না।

রমেশ। কিন্তু শুনে রাগ কোরো না। লজ্জাও পেয়ো না। মনে করো এ কোন পুরাকালের একটা গল্প শুনচ মাত্র। তোমাকে ভালবাসতাম রমা। মনে হয়, তেমন ভালবাসা বোধ হয় কেউ কখনো বাসেনি। ছেলেবেলায় মা’র মুখে শুনেছিলাম আমাদের বিয়ে হবে। তারপরে, যেদিন সমস্ত ভেঙ্গে গেল, সেদিন—কত বছর কেটে গেল, তবু মনে হয় সে বুঝি কালকের কথা।

[রমা তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া পলকের জন্য শিহরিয়া
আবার স্তব্ধ অধোমুখে নিশ্চল হইয়া রহিল]

রমেশ। তুমি ভাবছ তোমাকে এ-সব কাহিনী শোনানো অন্যায়। আমার মনেও এ সন্দেহ ছিল বোলেই সেদিন তারকেশ্বরে যখন একটি দিনের সমাদরে আমার সমস্ত জীবনের ধারা বদলে দিয়ে গেলে, সেদিনও চুপ করেই ছিলাম। চুপ করেই ছিলাম, কিন্তু সে নীরবতার ব্যথা মাপবার মানদণ্ড হয়ত শুধু অন্তর্যামীর হাতেই আছে।

রমা। (কিছুতেই যেন আর সহিতে পারিল না) যা তাঁর হাতে আছে তা তাঁর হাতেই থাক না রমেশদা।

রমেশ। তাই ত আছে রমা।

রমা। তবে—তবে, আজকেই বা বাড়িতে পেয়ে আমাকে অপমান করচেন কেন?

রমেশ। অপমান! কিছুমাত্র না। এর মধ্যে মান-অপমানের কথাই নেই। এ যাদের কাহিনী শুনচো, সে রমাও তুমি কোনদিন ছিলে না, সে রমেশও আর আমি নেই।

রমা। রমেশদা, আপনার নিজের কথাই বলুন। রমার কথা আমি আপনার চেয়ে বেশী জানি।

রমেশ। যাই হোক শোন। কেন জানিনে, সেদিন আমার অসংশয়ে বিশ্বাস হয়েছিল, তুমি যা ইচ্ছে বল, যা খুশি কর, কিন্তু আমার সত্যিকার অকল্যাণ তুমি কিছুতে সইতে পারবে না। বোধ করি ভেবেছিলাম, সেই যে ছেলেবেলায় একদিন ভালবেসেছিলে, সেই যে হাতে কোরে চোখ মুছিয়ে দিয়েছিলে, হয়ত তা আজও একেবারে ভুলতে পারনি। তাই মনে করেছিলাম কোন কথা তোমাকে না জানিয়ে তোমারি ছাওয়ায় বসে সমস্ত জীবনের কাজগুলো আমার ধীরে ধীরে কোরে যাব। কিন্তু সে রাত্রে আকবরের নিজের মুখে যখন শুনতে পেলাম তুমি নিজে—ও কি? বাইরে এত গোলমাল কিসের?

[দ্রুতবেগে গোপাল সরকারের প্রবেশ]

গোপাল। ছোটবাবু! (অকস্মাৎ রমাকে দেখিয়া স্তব্ধ হইয়া থামিল)

রমেশ। কি হয়েচে সরকারমশাই?

গোপাল। পুলিশের লোক ভজুয়াকে গ্রেপ্তার করেচে।

রমেশ। ভজুয়াকে? কেন?

গোপাল। সেদিন রাধাপুরের ডাকাতিতে সে নাকি ছিল।

রমেশ। আচ্ছা, আমি যাচ্চি। আপনি বাইরে যান।

[গোপাল সরকার প্রস্থান করিল]

রমেশ। যতীন ঘুমিয়ে পড়েচে, সে থাক। কিন্তু তুমি আর একমুহূর্ত থেকো না রমা, খিড়কি দিয়ে বেরিয়ে যাও। পুলিশ খানাতল্লাশি করতে ছাড়বে না।

রমা। (উঠিয়া দাঁড়াইয়া ভীতকণ্ঠে) তোমার নিজের ত কোন ভয় নেই?

রমেশ। বলতে পারিনে রমা। কতদূর কি দাঁড়িয়েচে সে ত এখনো জানিনে।

রমা। তোমাকেও ত গ্রেপ্তার করতে পারে?

রমেশ। তা পারে।

রমা। পীড়ন করতেও ত পারে?

রমেশ। অসম্ভব নয়।

রমা। (সহসা কাঁদিয়া উঠিয়া) আমি যাব না রমেশদা।

রমেশ। (সভয়ে) যাবে না কি-রকম?

রমা। তোমাকে অপমান করবে, তোমাকে পীড়ন করবে—আমি কিছুতেই যাব না রমেশদা।

রমেশ। (ব্যাকুল-কণ্ঠে) ছি ছি, এখানে থাকতে নেই। তুমি কি পাগল হয়ে গেলে রানী!

[এই বলিয়া দুই হাত ধরিয়া জোর করিয়া তাহাকে বাহির করিয়া দিল।
ওদিকে বহু লোকের পদশব্দ ও গোলমাল স্পষ্টতর হইয়া উঠিতে লাগিল]

তৃতীয় অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

বিশ্বেশ্বরীর গৃহ। জ্যাঠাইমা ও রমেশ

জ্যাঠাইমা। হাঁরে রমেশ, তুই নাকি তোর পীরপুরের নতুন ইস্কুল নিয়েই মেতে রয়েছিস, আমাদের ইস্কুলে আর পড়াতে যাসনে?

রমেশ। না। যেখানে পরিশ্রম শুধু পণ্ডশ্রম, যেখানে কেউ কারো ভালো দেখতে পারে না, সেখানে খেটে মরায় কোন লাভ নেই। শুধু মাঝে থেকে নিজেরই শত্রু বেড়ে ওঠে। বরঞ্চ, যাদের মঙ্গলের চেষ্টায় দেশের সত্যকার মঙ্গল হবে, সেই-সব মুসলমান আর হিন্দুর ছোটজাতেদের মধ্যেই পরিশ্রম করব।

জ্যাঠাইমা। এ কথা ত নতুন নয় রমেশ। পৃথিবীতে ভাল করবার ভার যে-কেউ নিজের ওপরে নিয়েচে চিরদিনই তার শত্রুসংখ্যা বেড়ে উঠেচে। সেই ভয়ে যারা পেছিয়ে দাঁড়ায়, তুইও যদি তাদেরি দলে গিয়ে মিশিস তা হলে ত চলবে না বাবা। এ গুরুভার ভগবান তোকেই বইতে দিয়েচেন, তোকেই বয়ে বেড়াতে হবে। কিন্তু হ্যাঁরে, তুই নাকি ওদের হাতে জল খাস?

রমেশ। (হাসিয়া) এই দেখ, এরই মধ্যে তোমার কানে উঠেচে। কিন্তু আমি ত তোমাদের জাতভেদ মানিনে জ্যাঠাইমা।

জ্যাঠাইমা। মানিস নে কি রে? এ কি মিছে কথা, না, জাতভেদ নেই যে তুই মানবি নে?

রমেশ। আছে তা মানি, কিন্তু ভাল বলে মানিনে। এর থেকে কত মনোমালিন্য, কত হানাহানি—মানুষকে ছোট করে অপমান করবার ফল কি তুমি দেখতে পাও না জ্যাঠাইমা? সেদিন অর্থাভাবে দ্বারিক ঠাকুরের প্রায়শ্চিত্ত হয়নি বলে তার মৃতদেহ কেউ স্পর্শ করতে চায়নি, এ কথা কি তুমি জানো না?

জ্যাঠাইমা। জানি বাবা, সব জানি। কিন্তু এর আসল কারণ জাতিভেদ নয়। যা সবচেয়ে বড় কারণ তা এই যে, যাকে যথার্থ ধর্ম বলে, একদিন যা এখানে ছিল, আজ তা পল্লীগ্রাম থেকে একেবারে লোপ পেয়েচে। আছে শুধু কতকগুলো অর্থহীন আচারের কুসংস্কার, আর তার থেকে নিরর্থক দলাদলি।

রমেশ। এর কি কোন প্রতিকার নেই জ্যাঠাইমা?

জ্যাঠাইমা। আছে বৈ কি বাবা। প্রতিকার আছে শুধু জ্ঞানে। যে পথে তুই পা দিয়েচিস শুধু সেই পথে। তাই ত তোকে বার বার বলি বাবা, তুই যেন তোর জন্মভূমিকে ত্যাগ করে কিছুতে যাসনে। তোর মত বাইরে থেকে যারা বড় হতে পেরেচে, তারা যদি তোরই মত গ্রামে ফিরে আসত, সমস্ত সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করে চলে না যেত, পল্লীগ্রামের এতবড় দুর্গতি হোত না। তারা কখনো গোবিন্দকে মাথায় নিয়ে তোরে দূরে সরাতো না।

রমেশ। দূরে যেতে আর আমার দুঃখ নেই জ্যাঠাইমা।

জ্যাঠাইমা। কিন্তু এই দুঃখই যে সবচেয়ে বড় দুঃখ রমেশ। কিন্তু আজ যদি কাজের মাঝখানেই সব ছেড়ে দিয়ে চলে যাস বাবা, তোর জন্মভূমি তোকে ক্ষমা করবে না।

রমেশ। জন্মভূমি ত শুধু একা আমার নয় জ্যাঠাইমা!

জ্যাঠাইমা। তোর একার বৈ কি বাবা, শুধু তোরই মা। দেখতে পাসনে মা মুখ ফুটে সন্তানের কাছে কোনদিন কিছুই দাবী করেন না। তাই এত লোক থাকতে কারো কানেই তাঁর কান্না গিয়ে পৌঁছয় নি, কিন্তু তুই আসামাত্রই শুনতে পেয়েচিস।

রমেশ। (ক্ষণকাল নতমুখে নীরবে থাকিয়া) একটা কথা তোমাকে জিজ্ঞাসা করব জ্যাঠাইমা?

জ্যাঠাইমা। কি কথা রমেশ?

রমেশ। আমি ত তোমাদের জাতভেদ মানিনে, কিন্তু তুমি ত মানো?

জ্যাঠাইমা। তুই মানিস নে বলে আমি মানব না রে?

রমেশ। কিন্তু আমি ত সকলের ছোঁয়া খাই—আমার হাতে ত তুমি খেতে পারবে না জ্যাঠাইমা?

জ্যাঠাইমা। পারব না কিরে? তুই আমার বাবা—তাই কি ছোটখাটো? মস্ত বড় বাবা। মেয়ে হয়ে এতবড় আস্পর্ধার কথা কি আমি মুখে আনতে পারি রে?

রমেশ। (তৎক্ষণাৎ হেঁট হইয়া তাঁহার পায়ের ধূলা মাথায় লইয়া) এই আশীর্বাদ আমাকে তুমি কর জ্যাঠাইমা, তোমাকে যেন আমি চিনতে পারি।

জ্যাঠাইমা। (তাহার চিবুক স্পর্শ করিয়া চুম্বন করিয়া) হয়েচে, হয়েচে। কিন্তু আমার যে এখনো আহ্নিক সারা হয়নি বাবা, একটুখানি বসবি?

রমেশ। না জ্যাঠাইমা, আমার ইস্কুলের বেলা হয়ে যাচ্ছে।

জ্যাঠাইমা। তালে যখনি সময় পাবি আসিস রমেশ।

[রমেশ ও জ্যাঠাইমার প্রস্থান]

[একদিক দিয়া রমা ও অপর দিক দিয়া দাসীর প্রবেশ]

রমা। জ্যাঠাইমা কোথায় রাধা?

দাসী। এইমাত্র পূজো করতে গেলেন। দেরি হবে না দিদি, একটু বসো না?

[বেণী প্রবেশ করিল, এবং তাহাকেই দেখিয়া দাসী সরিয়া গেল]

বেণী। তোমাকে আসতে দেখেই এলাম রমা। অনেক কথা আছে। মা বুঝি পূজো করতে গেলেন?

রমা। তাই ত রাধা বললে।

বেণী।অনেক চাল ভেবে কাজ করতে হয় দিদি, নইলে শত্রুকে জব্দ করা যায় না। সেদিন মনিবের হুকুমে যে ভজুয়া লাঠি-হাতে বাড়ি চড়াও হয়ে মাছ আদায় করতে এসেছিল সে কথা তুমি যদি না থানায় লিখিয়ে দিতে, আজ কি ব্যাটাকে এমন হাজতে পোরা যেত? অমনি ঐ সঙ্গে রমেশের নামটাও যদি দু’কথা বাড়িয়ে-গুছিয়ে লিখিয়ে দিতিস বোন! আমার কথাটায় তখন তোরা ত কেউ কান দিলিনে। না না না, তোমাকে সাক্ষী দিতে যেতে হবে না। আর তাই যদি হয়, তাতেই বা কি! জমিদারি রাখতে গেলে কিছুতে হটলে চলে না।—কিন্তু রমেশও কষ্ট দিতে আমাদের ছাড়বে না, দাদামশায়ের লাখো টাকা মেরেচে,—পীরপুরে খুলেচে ইস্কুল। এমনিই ত মুসলমান প্রজারা জমিদার বলে মানতে চায় না, তার উপর লেখাপড়া শিখলে জমিদারি রাখা না-রাখা আমাদের সমান হবে তা এখন থেকে বলে রাখচি।

রমা। আচ্ছা বড়দা, বিষয়-সম্পত্তি যদি নষ্ট হয়েই যায় তাতে রমেশদার নিজের ক্ষতিও কি কম?

বেণী। (ঈষৎ চিন্তা করিয়া) হুঁ। কি জানো রমা, এতে নিজের ক্ষতি ভাববার বিষয়ই নয়। আমরা দু’জনে জব্দ হলেই ও খুশী। দেখচ না, এসে পর্যন্ত কিরকম টাকা ছড়াচ্চে? ছোটলোকদের মধ্যে ‘ ছোটবাবু’ ‘ছোটবাবু’ একটা সাড়া পড়ে গেছে। যেন ওই একটা মানুষ আর আমরা দু’ঘর কিছুই নয়। কিন্তু বেশী দিন এ চলবে না। এই যে তাকে পুলিসের নজরে তুমি খাড়া কোরে দিয়েচ বোন, এতেই তাকে শেষ হতে হবে।

রমা। আমি লিখিয়ে দিয়েছিলাম রমেশদা জানতে পেরেচেন?

বেণী। ঠিক জানিনে। কিন্তু জানতে পারবেই। ভজুয়ার মামলায় সব কথাই উঠবে কিনা।

রমা। (ক্ষণকাল নিস্তব্ধ থাকিয়া) আচ্ছা বড়দা, আজকাল ওঁর নামই বুঝি সকলের মুখে মুখে?

বেণী। হুঁ। তা একরকম তাই বটে। কিন্তু আমিও অল্পে ছাড়ব না রমা। সে যে লেখাপড়া শিখিয়ে সমস্ত প্রজা বিগড়ে তুলবে, আর জমিদার হয়ে আমি মুখ বুজে সইব তা যেন কেউ স্বপ্নেও না ভাবে। এই ব্যাটা ভৈরব আচায্যি ভজুয়ার হয়ে সাক্ষী দিয়ে কি কোরে মেয়ের বিয়ে দেয়, তা একবার দেখতে হবে।

রমা। বল কি বড়দা?

বেণী। তা একবার নেড়েচেড়ে দেখতে হবে না? আমার বিপক্ষে আদালতে দাঁড়িয়ে কি কোরে ছেলেপুলে নিয়ে গাঁয়ে বাস করে তার খবর নিতে হবে না?—আর আচায্যি ত চুনো-পুঁটি; রুই-কাতলাও আছে। দেখি গোবিন্দখুড়ো কি বলে! দেশে ডাকাতি ত লেগেই আছে, এবার চাকরকে যদি জেলে পুরতে পারি ত মনিবকে পুরতেও বেশী বেগ পেতে হবে না।

রমা। (অতি বিস্ময়ে তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া) বল কি বড়দা, রমেশদাকে দেবে তুমি জেলে?

বেণী। কেন, সে কি পীর প্যাগম্বর? বাগে পেলে তাকে ছাড়তে হবে নাকি? তুই বলিস কি?

রমা। (মৃদুকণ্ঠে) রমেশদা যদি জেলেই যান, সে কি আমাদেরই কলঙ্ক নয়?

বেণী। কেন? কেন শুনি?

রমা। আমাদেরই আত্মীয়, আমরা না বাঁচালে লোকে ত আমাদেরই ছি ছি করবে।

বেণী। যে যেমন কাজ করবে সে তার তেমন ফল ভুগবে। আমাদের কি?

রমা। রমেশদা ত সত্যিই আর চুরি-ডাকাতি কোরে বেড়ান না। বরঞ্চ পরের ভালোর জন্যেই নিজের সর্বস্ব দিচ্চেন সে কথা ত কারো কাছে চাপা নেই। তার পরে আমাদেরও ত গাঁয়ে মুখ দেখাতে হবে।

বেণী। তোর হলো কি বল ত বোন?

রমা। গাঁয়ের লোকে ভয়ে মুখের সামনে কিছু না বলুক আড়ালে বলবেই। তুমি বলবে আড়ালে রাজার মাকেও ডাইনি বলে। কিন্তু ভগবান ত আছেন? নিরপরাধীকে মিছে কোরে শাস্তি দেওয়ালে তিনি ত রেহাই দেবেন না!

বেণী। হা রে কপাল! সে ছোঁড়া বুঝি ঠাকুর-দেবতা কিছু মানে? শিবের মন্দিরটা ভেঙ্গে পড়চে—মেরামত করবার জন্যে তার কাছে লোক পাঠাতে সে হাঁকিয়ে দিয়ে বলেছিল, যারা তোমাদের পাঠিয়েচে তাদের বল গে বাজে খরচ করবার টাকা নেই আমার। শোন কথা! এটা হলো বাজে খরচ, আর কাজের খরচ হচ্চে ছোটলোকদের ইস্কুল করে দেওয়া! তা ছাড়া বামুনের ছেলে সন্ধ্যা-আহ্নিক কিছুই করে না, শুনি মোছলমানের হাতে পর্যন্ত জল খায়! দু’পাতা ইংরেজি পড়ে আর কি তার জাতজন্ম আছে দিদি, কিছুই নেই। শাস্তি তার গেছে কোথা? সমস্তই তোলা আছে, তা একদিন সবাই দেখবে।

[রমা নীরব]

বেণী। এখন যাই, সময় মত আর একবার দেখা করব। বাইরে বোধ করি এতক্ষণে গোবিন্দখুড়ো এসে বসে আছে।

রমা। আমিও এখন যাই বড়দা।

[উভয়ের প্রস্থান ]

[রমেশের প্রবেশ]

রমেশ। রাধা, রাধা!

[দাসীর প্রবেশ]

রাধা। কেন ছোটবাবু?

রমেশ। জ্যাঠাইমা কি পূজোর ঘর থেকে বেরিয়েচেন? তখন একটা কথা তাঁকে বলতে ভুলেছিলাম।

রাধা। এখনো বেরোন নি। ডেকে দেব?

রমেশ। না না, থাক। বিকেলে আসবো তাঁকে বোলো।

রাধা। আচ্ছা।

[দাসীর প্রস্থান]

[দ্রুতপদে গোপাল সরকারের প্রবেশ]

রমেশ। আপনি এখানে যে?

গোপাল। অপেক্ষা করবার সময় নেই ছোটবাবু, আপনাকে চতুর্দিকে খুঁজে বেড়াচ্চি। শুনেচেন ভৈরব আচায্যির কাণ্ড? শুনেচেন, কি সর্বনাশ আমাদের সে করেচে?

রমেশ। কে না।

গোপাল। কর্তা স্বর্গীয় হলেন, শোকে-দুঃখে ভাবলাম আর না, এবারে শান্তি হব। কিন্তু হোতে দিলে না। আপনি কিন্তু আমাকে বাধা দিতে পারবেন না ছোটবাবু, আচায্যিকে আমি শাস্তি দেবো, দেবো, দেবো! এর প্রতিশোধ নেবো, নেবো, নেবো! আমি আজই যাচ্চি সদরে।

রমেশ। ব্যাপার কি সরকারমশাই? আপনার মত শান্ত মানুষে এতখানি উতলা হয়ে উঠেচে, কি করলেন আচায্যিমশাই?

গোপাল। কি করলেন? নেমকহারাম, শয়তান! তখনি মনে হয়েছিল, যাক ওর ভিটেমাটি বিক্রি হয়ে, আমরা এতে মাথা দেব না। কিন্তু তখনি ভয় হোলো কর্তা হয়ত স্বর্গে থেকে দুঃখ পাবেন। জানি ত তাঁর স্বভাব। তাই আপনাকে নিষেধ করতে পারলাম না।

রমেশ। তবুও যে কিছুই বুঝলাম না সরকারমশাই?

গোপাল। সেদিন আপনার আদেশ-মত সদরে গিয়ে ওর ডিক্রির টাকাটা জমা দিয়ে মকদ্দমার সমস্ত ব্যবস্থা স্থির কোরে এলাম, আর আজ এইমাত্র খবর পেলাম—পরশু ভৈরব আচায্যি নিজে গিয়ে দরখাস্ত কোরে মামলা তুলে নিয়েছে। দেনা স্বীকার করেচে।

রমেশ। তার মানে?

গোপাল। তার মানে জমা দেওয়া অতগুলো টাকা আমাদের গেল। আমাদের মাথায় কাঁটাল ভেঙ্গে তিনজনে এখন বখরা করে খাবে। গোবিন্দ গাঙ্গুলী, বড়বাবু, আর ও নিজে। শোনেন নি সকাল থেকে আচায্যিবাড়িতে রোশনচৌকির সানাইয়ের বাদ্যি? ঘটা কোরে হবে দৌহিত্রের অন্নপ্রাশন, ওই টাকায় দেশসুদ্ধ বামুনের দল ফলার করে বাঁচবে। অথচ আপনার স্থান নেই,—স্থান হয়েচে গোবিন্দ গাঙ্গুলীদের। আপনাকে করেছে তারা ‘ একঘরে’।

রমেশ। ভৈরব আচায্যি? পারলে করতে সে?

গোপাল। পারলে বৈ কি। পাড়াগাঁয়ের লোকে পারে না কি তাই শুধু আমার জানতে বাকী। আমি চললাম। ৬০

রমেশ। যান। আমি শুধু ভাবি, এ মহাপাতকের প্রায়শ্চিত্ত হবে কিসে?

গোপাল। আমার সাক্ষী আছে, আদালত খোলা আছে, আমি তাকে সহজে ছাড়ব না ছোটবাবু।

[প্রস্থান]

রমেশ। জানিনে আইনে কি বলে। জানিনে কৃতঘ্নতার দণ্ড আদালতে হয় কি না। কিন্তু থাক সে! আমি নিলাম আজ নিজের হাতে এই ভার। কেবল সহ্য করে যাওয়াই জগতে পরম ধর্ম নয়।

দ্বিতীয় দৃশ্য

[ভৈরব আচার্যের বহির্বাটী। দৌহিত্রের অন্নপ্রাশন-উপলক্ষে দ্বারে মঙ্গলঘট স্থাপিত হইয়াছে। আম্রপল্লবের মালা গাঁথিয়া সম্মুখে ঝুলাইয়া দেওয়া হইয়াছে। প্রাঙ্গণের একপ্রান্তে রোশনচৌকি বাদ্যকরের দল উপবিষ্ট। সম্মুখের বারান্দায় বসিয়া গোবিন্দ গাঙ্গুলী, বেণী ঘোষাল প্রভৃতি ভদ্রলোক। কেহ হাসিতেছে, কেহ ধূমপান করিতেছে। একজন বৈষ্ণব ও তাহার বৈষ্ণবী কীর্তন গাহিতেছিল, এবং তাহাই সকলে পরমানন্দে শ্রবণ করিতেছে। গান শেষ হইলে দীনু ভট্টাচার্য হুঁকা রাখিয়া বাহিরে যাইতেছিল, এমনি সময়ে রমেশ আসিয়া প্রবেশ করিল। দেখিলেই বুঝা যায় সে অতিশয় উত্তেজিত হইয়া আসিয়াছে। তাহার অপ্রত্যাশিত আবির্ভাবে উপস্থিত সকলেই চঞ্চল হইয়া উঠিল]

গান

শ্রীমতী করিছে বেশ।

ভুলাতে নাগর

শ্যাম নটবর

নানা ছাঁদে বাঁধে কেশ।

(আহা) শ্রীমতী করিছে বেশ।

হেরিয়া মুকুরে
চাঁচর চিকুরে

বিনায়ে বিনায়ে বিনোদ গোখুরে

রাধা বাঁধিল কবরী কত

কেহ হল নাক মনোমত (হায় রে),

ফণি–গঞ্জিত বেণী বিনোদিনী

দুলাইয়া দিল শেষ

(আহা) শ্রীমতী করিছে বেশ।

বেণী গেল ছুটি

লঙ্ঘিয়া কটি

পরশি মেখলা নিতম্বে লুটি

চুম্বিলা পাদদেশ।

উজ্জ্বল দু’টি নয়নপ্রান্তে কজ্জল দিল টানি

ফুলধনু জিনি ভ্রূযুগ মাঝে দীপসম টিপখানি।

ভরিয়া দু’ করে স্বর্ণবিন্দু

মার্জিল ধনী বদন ইন্দু

নন্দিতে শ্যামসুন্দর-হৃদি—বন্দিতে কমলেশ।

রমেশ। আচায্যিমশাই কৈ?

দীনু। (কাছে আসিয়া) চল, বাবা চল, বাড়ি ফিরে চল। তুমি যে উপকার আচায্যির করেচো সে ওর বাবা করতো না। কিন্তু উপায় ত নেই। কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে সকলকেই ঘর করতে হয়, তোমাকে নেমন্তন্ন করতে গেলে,—বুঝলে না বাবা,—ভৈরবকে নেহাত দোষ দেওয়াও যায় না। তোমরা সব আজকালকার শহরের ছেলে, জাত-টাত ত তেমন মানো না—তাতেই বুঝলে না বাবা,—দু’দিন পরে ওর ছোট মেয়েটা বছর বারোর হলো ত,—পার করতেও ত হবে,—আমাদের সমাজের ব্যাপার বুঝলে না বাবা—

রমেশ। আজ্ঞে হাঁ বুঝেচি। তিনি কৈ?

দীনু। আছে আছে, বাড়িতেই আছে। কিন্তু বামুনকেই বা দোষ দিই কি করে? (সকলের দিকে চাহিয়া) আমাদের বুড়োমানুষের পরকালের ভয়ও ত একটা—

রমেশ। সে ত ঠিক কথা। কিন্তু ভৈরব কোথায়?

[ভৈরবের প্রবেশ]

ভৈরব। (সবিস্ময়ে বেণীবাবুর উদ্দেশ্যে) দেখুন বড়বাবু, আপনার পাছে কষ্ট হয়—

[অকস্মাৎ সম্মুখে রমেশকে দেখিয়া সে বজ্রাহতের ন্যায় স্তব্ধ হইয়া গেল]

রমেশ। (দ্রুতপদে অগ্রসর হইয়া তাহার একটা হাত সবলে চাপিয়া ধরিয়া) কেন এমন করলেন? আজ আমি—

ভৈরব। বড়বাবু—গোবিন্দ গাঙ্গুলীমশাই—দেখুন না একবার—

রমেশ। (ভৈরবকে সজোরে একটা ঝাঁকুনি দিয়া) বড়বাবু, গোবিন্দ—আজি আমি সবাইকে দেখাবো! বলুন কেন এ কাজ করলেন?

[বেণী প্রভৃতি সকলের দ্রুতবেগে পলায়ন]

ভৈরব। (কাঁদিয়া উঠিয়া) লক্ষ্মী রে, পুলিশে খবর দে রে! মেরে ফেললে রে—

রমেশ। চুপ! বলুন, কিসের জন্যে এ কাজ করলেন?

ভৈরব। মেরে ফেললে রে! বাবা রে!

রমেশ। মেরেই ফেলবো। আজ তোমাকে খুন করে তবে বাড়ি যাবো।

[এই বলিয়া সে পুনঃ পুনঃ ঝাঁকুনি দিতে লাগিল। লক্ষ্মী আসিয়া পড়িয়া আর্তনাদ করিতে লাগিল। ইতিমধ্যে বহু লোক সমবেত হইয়া চারিদিক হইতে উঁকিঝুঁকি মারিতে লাগিল]

[দ্রুতবেগে রমার প্রবেশ]

রমা। (রমেশের হাত চাপিয়া ধরিয়া) হয়েচে,—এবার ছেড়ে দাও।

রমেশ। কেন শুনি?

রমা। এই লোকটার গায়ে তুমি হাত দেবে?

রমেশ। একে আমি কিছুতেই ছাড়বো না।

রমা। (জোর করিয়া হাত ছাড়াইয়া দিয়া) এত লোকের মাঝখানে এই লোকটার গায়ে হাত দিতে তোমার লজ্জা করচে না, কিন্তু আমি যে লজ্জায় মরে যাই রমেশদা! বাড়ি যাও।

রমেশ। মুহূর্তকাল বিহ্বল-চক্ষে তাহার প্রতি চাহিয়া থাকিয়া) আচ্ছা। বাড়িই চললাম।

[রমেশ ধীরে ধীরে প্রস্থান করিতে বেণী, গোবিন্দ প্রভৃতি সকলে ভিড় করিয়া আসিয়া পড়িল। ভৈরব বসিয়া পড়িয়া দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজিয়া কাঁদিতে লাগিল]

গোবিন্দ। বাড়ি চড়াও হয়ে যে আধমরা করে গেল, এর কি করবে এখন সেই পরামর্শ করো।

বেণী। আমিও ত তাই বলি।

রমা। কিন্তু এ পক্ষের দোষও ত কম নয় বড়দা? তা ছাড়া হয়েচেই বা কি যে এই নিয়ে হৈচৈ করতে হবে?

বেণী। বল কি রমা, এ কি সোজা ব্যাপার হোলো? আমরা সবাই না থাকলে ত সে খুন করে যেতো।

রমা। করলেও তোমরা আটকাতে পারতে না বড়দা। পালালে কেন?

বেণী। পালালাম?

গোবিন্দ। পালাবো আমরা? আমরা শুধু আড়াল থেকে দেখছিলাম ওর দৌড় কত?

লক্ষ্মী। তুমি ত ওর হয়ে বলবেই রমাদিদি। তোমার বাপকে কেউ ঘরে ঢুকে মেরে গেলে কি করতে বল ত?

রমা। আমার বাপ ও তোমার বাপে অনেক তফাত লক্ষ্মী, তুমি সে তুলনা কোরো না। কিন্তু আমি কারও হয়েই কথা বলিনি, ভালোর জন্যই বলেচি।

লক্ষ্মী। বটে! ওর হয়ে কোঁদল করতে তোমার লজ্জা করে না? বড়লোকের মেয়ে বলে কেউ ভয়ে কথা বলে না, নইলে কে না শুনেচে? তুমি বলে তাই মুখ দেখাও, আর কেউ হলে গলায় দড়ি দিতো।

বেণী। (লক্ষ্মীকে তাড়া দিয়া) তুই থাম না লক্ষ্মী—কাজ কি ও-সব কথায়?

লক্ষ্মী। কাজ নেই কেন? যার জন্যে বাবাকে এত দুঃখ পেতে হোলো তার হয়েই উনি কোঁদল করবেন? বাবা যদি আজ মারা যেতেন?

রমা। (লক্ষ্মীর প্রতি) লক্ষ্মী, ওঁর মত লোকের হাতে মরতে পাওয়া ভাগ্যের কথা। আজ মারা পড়লে তোমার বাবা স্বর্গে যেতে পারতো।

লক্ষ্মী। তাতেই বুঝি তুমি মরেচো রমাদিদি?

রমা। (ক্ষণকাল নীরবে তাহার প্রতি চাহিয়া থাকিয়া মুখ ফিরাইয়া লইল) কিন্তু কথাটা কি তুমিই বল ত বড়দা?

বেণী। কি করে জানবো বোন! লোকে কত কথা বলে—তাতে কান দিলে ত চলে না।

রমা। লোকে কি বলে?

বেণী। বললেই বা রমা। লোকের কথাতে ত গায়ে ফোস্কা পড়ে না। বলুক না।

রমা। তোমার গায়ে হয়ত কিছুতেই ফোস্কা পড়ে না, কিন্তু সকলের গায়ে ত গণ্ডারের চামড়া নেই? কিন্তু লোককে এ কথা বলাচ্চে কে? তুমি?

বেণী। আমি?

রমা। তুমি ছাড়া আর কেউ নয়। পৃথিবীতে কোন দুষ্কর্মই ত তোমার বাকি নেই,—জাল, জোচ্চুরি, চুরি, ঘরে আগুন দেওয়া সবই হয়ে গেছে, এটাই বা বাকী থাকে কেন? মেয়েমানুষের এতবড় সর্বনাশ যে আর নেই সে বোঝবার তোমার শক্তি নেই। কিন্তু জিজ্ঞেসা করি কিসের জন্য এ শত্রুতা তুমি করে বেড়াচ্চো? এ কলঙ্ক রটিয়ে তোমার লাভ কি?

বেণী। আমার লাভ কি হবে? লোকে যদি তোমাকে রাত্রে রমেশের বাড়ি থেকে বার হতে দেখে,—আমি করব কি?

রমা। এত লোকের সামনে আর সব কথা আমি বলতে চাইনে, কিন্তু তুমি মনে করো না বড়দা, তোমার মনের ভাব আমি টের পাইনি। কিন্তু তুমি নিশ্চয় জেনো,—আমি রমা। যদি মরি, তোমাকেও জ্যান্ত রেখে যাবো না।

[দ্রুতবেগে প্রস্থান]

গোবিন্দ। অ্যাঁ? এ হোলো কি বড়বাবু? তোমাকেও চোখ রাঙ্গিয়ে যায়,—মেয়েমানুষ হয়ে? আমি বেঁচে থেকে এও চোখে দেখতে হবে?

বেণী। (নিজের ললাট স্পর্শ করিয়া) কারও দোষ নয় খুড়ো, দোষ এর। কলিকাল,—এরই নাম কাল-মাহাত্ম্য। ভালো ছাড়া কখনো কারো মন্দ করিনে, মন্দ করার কথা ভাবতে পারিনে। জগতে আমার এমন হবে না ত হবে কার? বিদ্যেসাগরের কি হয়েছিল? গল্প শুনেচো ত!

গোবিন্দ। তা আর শুনিনি!

বেণী। তবে তাই! দোষ দেবো আর কাকে? (ভৈরবকে দেখাইয়া) এঁকে রক্ষে করতে না যেতাম ত কোন কথাই হতো না! কিন্তু সে ত আর আমি প্রাণ থাকতে পারিনে!

তৃতীয় দৃশ্য

বনাকীর্ণ নির্জন গ্রাম্যপথ

[রমেশ দ্রুতপদে প্রবেশ করিল। রমা অন্তরাল হইতে ডাকিল—রমেশদা? এবং পরক্ষণেই সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল]

রমেশ। রমা! এত দূরে এই নির্জন পথে তুমি?

রমা। আমি জানি পীরপুরের ইস্কুলের কাজ সেরে এই পথে আপনি নিত্য যান।

রমেশ। তা যাই। কিন্তু তুমি কেন?

রমা। শুনেছিলাম এখানে আর আপনার শরীর ভাল থাকচে না। এখন কেমন আছেন?

রমেশ। ভালো নয়। মনে হয় রোজ রাত্রেই যেন জ্বর হয়।

রমা। তা হলে কিছুদিন বাইরে ঘুরে এলে ত ভাল হয়!

রমেশ। (হাসিয়া) ভাল ত হয় জানি, কিন্তু যাই কি কোরে?

রমা। হাসলেন যে বড়? আপনি বলবেন আপনার অনেক কাজ, কিন্তু এমন কাজ কি আছে যা নিজের শরীরের চেয়েও বড়?

রমেশ। নিজের শরীরটা যে ছোট জিনিস তা আমি বলিনে। কিন্তু এমন কাজ মানুষের আছে যা এই দেহটার চেয়েও বড়। কিন্তু সে ত তুমি বুঝবে না রমা।

রমা। আমি বুঝতেও চাইনে। কিন্তু আপনাকে আর কোথাও যেতেই হবে। সরকারমশায়কে বলে দিয়ে যান আমি তাঁর কাজকর্ম দেখবো।

রমেশ। তুমি দেখবে আমার কাজকর্ম?

রমা। কেন, পারবো না?

রমেশ। পারবে। হয়ত আমার নিজের চেয়েও ভাল পারবে, কিন্তু পেরে কাজ নেই। আমি তোমাকে বিশ্বাস করবো কি করে?

রমা। রমেশদা, ইতরে বিশ্বাস করতে পারে না। কিন্তু আপনি পারবেন। না পারলে সংসারে বিশ্বাস করার কথাটা উঠে যাবে। আমাকে এই ভারটুকু আপনি দিয়ে যান।

রমেশ। (ক্ষণকাল নীরবে তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া) আচ্ছা, ভেবে দেখি।

রমা। কিন্তু ভাববার ত সময় নেই। আজই আপনাকে আর কোথাও যেতে হবে। না গেলে

রমেশ। (পুনশ্চ তাহার মুখের প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া) তোমার কথার ভাবে মনে হয়, না গেলে আমার বিপদের সম্ভাবনা। ভালো, যাই-ই যদি তাতে তোমার লাভ কি? আমাকে বিপদে ফেলতে তুমি নিজেও ত কম চেষ্টা করোনি যে, আজ আর একটা বিপদে সতর্ক করতে এসেচো। সে-সব কাণ্ড এত পুরোনো হয়নি যে তোমার মনে নেই। বরঞ্চ খুলে বলো আমি চলে গেলে তোমার নিজের কি সুবিধে হয়,—হয়ত তোমার জন্যে আমি রাজী হতেও পারি।

রমা। (এই কঠিন আঘাতে রমার মুখ বিবর্ণ হইয়া উঠিল, কিন্তু আপনাকে সে সামলাইয়া লইল) আচ্ছা, খুলেই বলচি। আপনি গেলে আমার লাভ কিছুই নেই, কিন্তু না গেলে অনেক ক্ষতি। আমাকে সাক্ষী দিতে হবে।

রমেশ। এই? মাত্র এইটুকু? কিন্তু সাক্ষী না দিলে?

রমা। না দিলে আমার মহামায়ার পূজোয় কেউ আসবে না, আমার যতীনের উপনয়নে কেউ খাবে না, আমার বারব্রত, ধর্মকর্ম,—না রমেশদা, আপনি যান আমি মিনতি করচি। থেকে, সব দিক দিয়ে আমাকে নষ্ট করবেন না।

রমেশ। (একমুহূর্ত মৌন থাকিয়া) বেশ, আমি যাবো। আমার আরব্ধ কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই যাবো,—কিন্তু নিজের কাছে নিজেকে কি জবাব দেব?

রমা। জবাব নেই। আর কেউ হলে জবাবের অভাব ছিল না, কিন্তু এক অতি ক্ষুদ্র নারীর অখণ্ড স্বার্থপরতার উত্তর আপনি কোথায় খুঁজে পাবেন রমেশদা! আপনাকে নিরুত্তরেই যেতে হবে।

রমেশ। বেশ, তাই হবে। কিন্তু আজ আমার সাধ্য নেই।

রমা। সত্যিই সাধ্য নেই?

রমেশ। না। তোমার সঙ্গে কে আছে তাকে ডাকো।

রমা। সঙ্গে আমার কেউ নেই। আমি একাই এসেচি।

রমেশ। একা এসেছো? সে কি কথা রানী,—একলা এলে কোন্‌ সাহসে?

রমা। সাহস এই ছিল যে, আমি নিশ্চয় জানতাম এই পথে আপনার দেখা পাবো। তার পরে আর আমার ভয় কিসের?

রমেশ। ভালো করোনি রমা, সঙ্গে অন্ততঃ তোমার দাসীকেও আনা উচিত ছিল। এই নিস্তব্ধ জনহীন পথে আমাকেও ত তোমার ভয় করা কর্তব্য।

রমা। তোমাকে? ভয় করবো আমি তোমাকে?

রমেশ। নয় কেন?

রমা। (মাথা নাড়িয়া) না, কোনমতেই না। আর যা খুশি উপদেশ দাও রমেশদা, সে আমি শুনবো। কিন্তু তোমাকে ভয় করবার ভয় আমাকে দেখিয়ো না।

রমেশ। আমাকে তোমার এতই অবহেলা?

রমা। হাঁ, এতই অবহেলা। বলছিলে, দাসীকে সঙ্গে না এনে ভালো করিনি। কিন্তু কিসের জন্যে শুনি? ভেবেচো তোমার হাত থেকে বাঁচবার জন্যে দাসীর শরণাপন্ন হবো? রমার চেয়ে তোমার কাছে সে-ই হবে বড়? (রমেশ নিঃশব্দে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল) মনে নেই সকালের কথা? সেখানে লোকের অভাব ছিল না। তবু সেই মূর্তি দেখে সবাই যখন পালিয়ে গেল, তখন কে রক্ষে করেছিল ভৈরব আচায্যিকে? সে রমা। দাসী-চাকরের তখন প্রয়োজন হয়নি, এখনও হবে না। বরঞ্চ আজ থেকে তুমিই রমাকে ভয় কোরো। আর এই কথাটাই বলবার জন্যে আজ এসেছিলাম।

রমেশ। তা হলে নিরর্থক এসেচো রমা। ভেবেছিলাম তোমার নিজের কল্যাণের জন্যই আমাকে চলে যেতে বলচো। কিন্তু তা যখন নয়, তখন আমাকে সতর্ক করবার প্রয়োজন দেখতে পাইনে।

রমা। সমস্ত প্রয়োজনই কি সংসারের চোখে দেখা যায় রমেশদা!

রমেশ। যা যায় না তা আমি স্বীকার করিনে। চললাম।

[প্রস্থান]

রমা। (অকস্মাৎ কাঁদিয়া ফেলিয়া) যে অন্ধ তাকে আমি দেখাবো কি দিয়ে!

চতুর্থ অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

[রমার পূজার দালানের একাংশ। দুর্গা-প্রতিমা স্পষ্ট দেখা যায় না বটে, কিন্তু পূজার যাবতীয় আয়োজন বিদ্যমান। সময় অপরাহ্ণ-প্রায়। এ-বেলার মত পূজার কার্য সম্পন্ন হইয়া গেছে। একধারে রমা স্থির হইয়া বসিয়া ছিল, তাহার বাটীর সরকার প্রবেশ করিয়া কহিল]

সরকার। মা, বেলা ত যায়, কিন্তু শূদ্দুররা ত কেউ এলো না। একবার ঘুরে দেখে আসবো কি?

রমা। কেউ এলো না?

সরকার। কৈ না।

[বেণী ঘোষালের প্রবেশ]

বেণী। ইস্‌! এত খাবার-দাবার নষ্ট কোরে দিতে বসেচে দেশের ছোটলোকের দল! এত বড় আস্পর্ধা! কিন্তু ব্যাটাদের শেখাবো, শেখাবো, শেখাবো! চাল কেটে যদি না তুলে দিই ত আমি—

[রমা তাহার মুখোপানে চাহিয়া শুধু একটুখানি হাসিল। কিছুই বলিল না]

না না, এ হাসির কথা নয় রমা, বড় সর্বনেশে কথা! একবার যখন জানবো এর মূলে কে তখন এই এমনি কোরে ছিঁড়ে ফেলব। আরে হারামজাদা ব্যাটারা এ বুঝিস নে যে, যার জোরে তোরা জোর করিস, সেই রমেশবাবু যে নিজে জেলের ঘানি টেনে মরচেন! তোদের মারতে কতটুকু সময় লাগে? ভৈরব আচায্যিকে ছুরি মারতে ঢুকেছিল,—হাতে এত বড় ভোজালি স্পষ্ট প্রমাণ করে দিলাম। কৈ, কোন্‌ শালা আটকাতে পারলে? আর মনে করি যদি ত রাতকে দিন, দিনকে রাত করে দিতে পারি যে! আচ্ছা—আরো খানিকটা দেখি, তার পরে—শাস্তরে বলেছে যথা ধর্ম স্তথা জয়ঃ। শূদ্দুর হয়ে বামুনবাড়ির ধর্মকর্মের ওপর আড়ি? আচ্ছা—

[প্রস্থান]

[ধীরে ধীরে বিশ্বেশ্বরীর প্রবেশ]

বিশ্বেশ্বরী। রমা!

রমা। কেন মা?

বিশ্বেশ্বরী। চুপটি কোরে বসে আছিস মা, কে বলবে মানুষ। ঠিক যেন কে মাটির মূর্তি গড়ে রেখেচে। (ধীরে ধীরে তাহার পাশে আসিয়া বসিলেন) সে হাসি নেই, সে উল্লাস নেই,—যেন কোথায় কোন্‌ বহুদূরে চলে গেছিস।

রমা। (ঈষৎ হাসিয়া) বাড়ির ভেতরে এতক্ষণ কি করছিলে জ্যাঠাইমা?

বিশ্বেশ্বরী। তোমার যজ্ঞিবাড়িতে ত কাজ কম নেই মা। অন্ন-ব্যঞ্জনের যেন পাহাড় জমিয়ে তুলেচ।

রমা। এবারে কিন্তু সমস্ত মিছে। বোধ করি একজন চাষাও আমার বাড়িতে মায়ের প্রসাদ পেতে আসবে না। কিন্তু অন্যান্য বারের কথা জানো ত জ্যাঠাইমা, এই সপ্তমীর দিনে প্রজাদের ভিড় ঠেলে বাড়িতে ঢুকতে পারা যেত না।

বিশ্বেশ্বরী। এখনো বলা যায় না রমা। হয়ত সন্ধ্যের পরেই সবাই আসবে।

রমা। না, আসবে না জ্যাঠাইমা।

জ্যাঠাইমা। সবাই ওই কথাই বলচে। বেণী, গোবিন্দঠাকুরপো রাগে দাপাদাপি করে বেড়াচ্চে, ভেতরে তোর মাসীর গালাগালির জ্বালায় কান পাতবার জো নেই, কেবল তোর মুখেতেই নালিশ নেই। সে রাগ নেই, অভিমান নেই,—তোর চোখের পানে চাইলে মনে হয় যেন ওর নীচে কান্নার সমুদ্র চাপা আছে। কেমন কোরে এমন বদলে গেলি মা?

রমা। রাগ করব কাদের ওপর জ্যাঠাইমা? প্রজাদের ওপরে? গরীব বলে কি তাদের সম্ভ্রমবোধ নেই? তারা আমার মত পাপিষ্ঠার অন্ন গ্রহণ করবে কেন?

বিশ্বেশ্বরী। তোমাকে পাপিষ্ঠা বলে সাধ্য কার মা?

রমা। বললেও ত অন্যায় হয় না। তারা জানে আমরা তাদের ভালোবাসিনে, আমরা তাদের আপনার জন নই। আমরা ত আদর কোরে আহ্বান করিনে মা, আমরা জোর কোরে হুকুম করি দুটো খেয়ে যাবার জন্যে। তাই তাদের না আসায় আমরা রাগে ক্ষেপে উঠি।—কিন্তু আদর যে কি, সে স্বাদ তারা পেয়েচে, ভালোবাসা যে কি, সে তারা রমেশদার কাছে জেনেচে। তাদের সেই বন্ধুকেই আমরা যখন মিথ্যে মামলায়, মিথ্যে সাক্ষী দিয়ে জেলে পুরে এলাম, এ দুঃখ তারা ভুলবে কি করে জ্যাঠাইমা?

বিশ্বেশ্বরী। কিন্তু তুমি ত মিথ্যে সাক্ষী দাওনি মা?

রমা। দিইনি আমি? তাদের বড় আশা ছিল, আর যেই কেননা মিথ্যে বলুক, আমি বলতে পারব না। কিন্তু বলতে ত পারলাম। মুখে ত বাধল না! আচায্যিমশায়ের কত বড় অপরাধ, কত বড় কৃতঘ্নতা যে রমেশদাকে আত্মবিস্মৃত করেছিল, সে ত আমি জানি। আমি ত জানি তাঁর হাতে একটা তৃণ পর্যন্ত ছিল না, তবু আদালতে দাঁড়িয়ে স্মরণ করতেই পারলাম না, হাতে তাঁর ছুরি-ছোরা ছিল কি না!

বিশ্বেশ্বরী। রমা—

রমা। জ্যাঠাইমা, তুমি বলছিলে মিথ্যে ত আমি বলিনি। এখানকার আদালতে হলফ কোরে মিথ্যে হয়ত আমি বলিনি, কিন্তু যে আদালতে হলফ করার বিধি নেই, সেখানে আমি কি জবাব দেবো? উঃ—ভগবান! সত্য-গোপনের যে এতবড় বোঝা এ আমাকে তুমি আগে জানতে দাওনি কেন?

বিশ্বেশ্বরী। কিন্তু আমি তোমাকে বলচি মা, শাস্তি তার হয়েচে সত্যি, কিন্তু অকল্যাণ তার কখনো হবে না।

রমা। হবে কি কোরে জ্যাঠাইমা, আজ সমস্ত অকল্যাণের ভার এসে পড়েচে যে আমার মাথার ওপর।

বিশ্বেশ্বরী। একলা তোমার মাথায় পড়েনি মা, আমরা সবাই মিলে তাকে ভাগ কোরে নিয়েচি। অসত্যাচারী সমাজের যে কাপুরুষের দল মিথ্যে দুর্নামের ভয় দেখিয়ে তোমাকে ছোট করেচে, এ পাপের ভারে তাদের মাথা আজ পথের ধূলায়। বেণীর মা আমি, আমার মাথা মাটিতে লুটোচ্চে রমা, কখনও আর তুলতে পারব না।

রমা। অমন কথা তুমি বোলো না জ্যাঠাইমা। কিন্তু আমি কি করেছিলাম জানো? জনশূন্য অন্ধকার-পথে একলা দেখা কোরে সেধেছিলাম, রমেশদা, তুমি যাও,—যাও এখান থেকে। বিশ্বাস করলেন না, বললেন, আমি চলে গেলে তোমার লাভ কি? আমার লাভ? হঠাৎ ব্যথার ভারে যেন পাগল হয়ে গেলাম। বললাম, লাভ কিছুই নেই,—কিন্তু না গেলে আমার অনেক ক্ষতি। আমার মহামায়ার পূজোয় কেউ আসবে না, আমার যতীনের উপনয়নে কেউ খাবে না,—তুমি দেশে থেকে আমাকে সকল দিক দিয়ে নষ্ট কোরো না। কিন্তু এতবড় মিথ্যে আমি কোথায় পেলাম জ্যাঠাইমা? রাগ কোরে বললেন, এই? এইমাত্র? না, এর জন্যে আমার কাজ ছেড়ে আমি কোনমতেই যাব না। অভিমানে ভাবলাম, তবে হোক একটা শিক্ষা। বিশ্বাস ছিল, সামান্য কিছু একটা জরিমানা হবে। কিন্তু সে শাস্তি যে এমনি কোরে আসবে,—তাঁর রোগশীর্ণ মুখের পানে চেয়েও বিচারকের দয়া হবে না,—তাঁকে জেলে দেবে এ কথা আমার অতিবড় দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি জ্যাঠাইমা।

বিশ্বেশ্বরী। সে জানি মা।

রমা। শুনলাম, আদালতে তিনি কেবল আমার পানেই চেয়েছিলেন। তাঁর গোপাল সরকার চাইলেন আপিল করতে, তিনি বললেন, না। সারা জীবন যদি জেলের মধ্যে বাস করতে হয় সেও ঢের ভাল, কিন্তু আপিল করে খালাস পেতে চাইনে। এ শাস্তি আমার কত বড় বল ত জ্যাঠাইমা?

বিশ্বেশ্বরী। কিন্তু তার মিয়াদের কালও পূর্ণ হয়ে এলো। মুক্তি পেতে আর বেশী দিন নেই।

রমা। তাঁর মুক্তি হবে, কিন্তু তাঁর সেই নিবিড় ঘৃণা থেকে ইহজীবনে আমার ত মুক্তি নেই মা!

[বৃদ্ধ সনাতন হাজরাকে লইয়া বেণীর প্রবেশ]

বেণী। এই আমাদের তিনপুরুষের প্রজা। সুমুখে দিয়ে যাচ্ছিলেন, ডাকতে তবে বাড়ি ঢুকলেন। হাঁ রে সনাতন, এত অহঙ্কার কবে থেকে হোল রে? বলি, তোদের ঘাড়ে কি আর একটা কোরে মাথা গজিয়েচে রে?

সনাতন। দুটো করে মাথা আর কার থাকে বড়বাবু? আপনাদেরই থাকে না ত আমাদের মত গরীবের!

বেণী। কি বললি রে হারামজাদা?

সনাতন। দুটো মাথা কারো থাকে না বড়বাবু, সেই কথাই বলেচি,—আর কিছু নয়।

[গোবিন্দ গাঙ্গুলীর প্রবেশ]

গোবিন্দ। তোদের বুকের পাটা শুধু দেখচি আমরা। মায়ের প্রসাদ পেতেও কেউ তোরা এলিনে, বলি, কেন বল ত রে?

সনাতন। (হাসিয়া) আর বুকের পাটা? যা করবার সে ত আমার করেচেন। সে যাক। কিন্তু মায়ের প্রসাদই বলুন আর যাই বলুন, কোন কৈবর্তই আর বামুনবাড়িতে পাত পাতবে না। এত পাপ যে মা বসুমাতা কেমন করে সইচেন, তাই আমরা কেবল বলাবলি করি। (নিশ্বাস ফেলিয়া রমার প্রতি চাহিয়া) একটু সাবধানে থেকো দিদিঠাকরুন, পীরপুরের ছোঁড়ার দলটা একেবারে ক্ষেপে রয়েচে। এর মধ্যেই দু’তিনবার তারা বড়বাবুর বাড়ির চারপাশে ঘুরে গেছে—সামনে পায়নি তাই রক্ষে। (বেণীর প্রতি) একটু সামলে-সুমলে থাকবেন বড়বাবু, রাতবিরেতে বার হবেন না।

[বেণী কি-একটা বলিতে গেল কিন্তু ভয়ে তাহার মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না]

রমা। (স্নেহার্দ্র-কণ্ঠে) সনাতন, ছোটবাবুর জন্যেই বুঝি তোমাদের সব রাগ এত?

সনাতন। মিথ্যে বোলে আর নরকে যাব না দিদিঠাকরুন, তাই বটে। তবে, পীরপুরের লোকগুলোর রাগটাই সবচেয়ে বেশি। তারা ছোটবাবুকে দেব্‌তা মনে করে।

রমা। (আনন্দোজ্জ্বল মুখে) তাই নাকি সনাতন?

বেণী। (সনাতনের হাত চাপিয়া ধরিয়া) তোকে একবার দারোগার কাছে গিয়ে বলতে হবে সনাতন। তুই যা চাইবি তাই দেব। তোর সেই সাবেক দু’বিঘে জমি ছাড়িয়ে নিতে চাস ত তাই পাবি। ঠাকুরঘরে বসে দিব্বি করচি সনাতন, বামুনের কথাটা রাখ।

সনাতন। সে দিনকাল আর নেই বড়বাবু,—সে দিনকাল আর নেই। ছোটবাবু সব উল্টে দিয়ে গেছেন।

গোবিন্দ। বামুনের কথা তা হলে রাখবি নে বল?

সনাতন। (মাথা নাড়িয়া) না। বললে তুমি রাগ করবে গাঙ্গুলীমশাই, কিন্তু সেদিন পীরপুরের নূতন ইস্কুলঘরে ছোটবাবু বলেছিলেন, গলায় গাছকতক সুতো ঝোলানো থাকলেই বামুন হয় না। আমি ত আজকের নই ঠাকুর, সব জানি। যা কোরে তোমরা বেড়াও সে কি বামুনের কাজ? তোমাকেই জিজ্ঞেসা করচি দিদিঠাকরুন, তুমিই বল দিকি?

[রমা নিরুত্তরে মাথা হেঁট করিল]

সনাতন। (মনের আক্রোশ মিটাইয়া বলিতে লাগিল) বিশেষ কোরে ছোঁড়াদের দল। এই দুটো গাঁয়ের যত ছোকরা সন্ধ্যের পরে সবাই গিয়ে জোটে মোড়লের বাড়িতে। তারা ত স্পষ্ট বলে বেড়াচ্চে জমিদার’ত ছোটবাবু! আর সব চোর-ডাকাত। তা ছাড়া খাজনা দিয়ে বাস করব, ভয় কারুকে করব না। আর বামুনের মত থাকে ত বামুন, নইলে, আমরাও যা তারাও তাই।

বেণী। (আতঙ্কে পরিপূর্ণ হইয়া) সনাতন, আমার ওপরেই কেন এত রাগ বলতে পারিস?

সনাতন। তা আর পারিনে বড়বাবু? আপনিই যে সকল নষ্টের গোড়া তা কারও জানতে বাকী নেই।

[বেণী চুপ করিয়া রহিল, ভয়ে বুকের ভিতর তাহার টিপটিপ করিতেছিল]

বিশ্বেশ্বরী। গাঙ্গুলী-ঠাকুরপো, ছোটলোকের মুখে এত আস্পর্ধার কথা শুনেও যে বড় চুপ করে আছ?

[বেণী বক্রচক্ষে মায়ের প্রতি ক্রুদ্ধ দৃষ্টিপাত করিয়াও নীরব হইয়া রহিল]

গোবিন্দ। হাঁ সনাতন, বিপিন মোড়লের বাড়িতেই তা হলে আড্ডা বল? সেখানে কি করে তারা বলতে পারিস?

সনাতন। কি করে তা জানিনে। কিন্তু ভাল চাও ত ও-মতলব কোরো না ঠাকুর। তারা ছোট-বড় সবাই ভাই-সম্পর্ক পাতিয়েচে। এক মন, এক প্রাণ। ছোটবাবুর জেল হওয়া থেকে সব রাগে বারুদ হয়ে আছে, তার মধ্যে গিয়ে চকমকি ঠুকে আগুন জ্বালতে যেয়ো না গাঙ্গুলীমশাই। এই তোমাদের সাবধান করে দিয়ে গেলাম।

[প্রস্থান]

[সনাতন প্রস্থান করিলে সকলেই কিছুক্ষণ নীরবে থাকিয়া]

বেণী। ব্যাপার শুনলে রমা?

[রমা মুচকিয়া হাসিল, কথা কহিল না। হাসি দেখিয়া বেণীর গা জ্বলিয়া গেল]

বেণী। শালা ভৈরবের জন্যেই এত কাণ্ড। আর তুমি না যাবে সেখানে, না তাকে ছাড়িয়ে দেবে তো এ—সব কিছুই হয় না। খেতো শালা মার,—তোমার কি!

[রমা পুনরায় একটু হাসিল, জবাব দিল না]

বেণী। তুমি ত হাসবেই রমা। মেয়েমানুষ, বাড়ির বার হতে ত হয় না,—কিন্তু আমাদের উপায় কি হবে বল ত? সত্যি সত্যিই যদি একদিন মাথা ফাটিয়ে দেয়? মেয়েমানুষদের সঙ্গে কাজ করতে গেলেই এই দশা হয়।

[রমা বিস্মিত-মুখে শুধু তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল]

বেণী। গোবিন্দখুড়ো, চুপ করে বসে থাকলে কি হবে? আমার দরোয়ান আর চাকর দু’জনকে একবার ডেকে পাঠাও না? গোটা দুই আলো যেন সঙ্গে কোরে আনে।

গোবিন্দ। এস না, বাইরে গিয়ে ডাকতে পাঠাই। আর ভয়টা কিসের? না হয়, আমি নিজে গিয়ে তোমাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসব।

[উভয়ের প্রস্থান]

দ্বিতীয় দৃশ্য

পথ
[জগন্নাথ ও নরোত্তমের প্রবেশ। জগন্নাথের হাতে একগাছা মোটা লাঠি]

নরোত্তম। এই পথ, এইখান দিয়ে যাবে। জগা, এখনো বল, সাহস হবে ত?

জগন্নাথ। সাহস হবে না কি রে! শাস্তি নিতে রাজী হয়েই ত শাস্তি দিতে দাঁড়িয়েচি। অনেক দুঃখু দিয়েচে। মা দুর্গা! শুধু এই করো, আজ যেন একটা কাজের মত কাজ করে যেতে পারি। যেন হাত না কাঁপে।

নরোত্তম। হাত কাঁপবে কি রে?

জগন্নাথ। তা পারে। বাপ-পিতামোর কাল থেকে মার খাওয়াটাই অভ্যাস হয়ে আছে কিনা! তাই শেষ পর্যন্ত হাত যদি না ওঠে ত হাতের দোষ, আমার নয়।

নরোত্তম। তবে লাঠিগাছটা আমার হাতে দিয়ে তুই সরে দাঁড়া। দেখি আমি কি করতে পারি।

জগন্নাথ। অমন কথা তুই বলিস নে নরু। তোর ছেলেপুলে আছে, কিন্তু আমার নেই। এই আমার সময়। ছোটবাবু ফিরে এলে আর হবে না, তিনি হাত চেপে ধরবেন। তাই তাঁর জেল থেকে বেরোবার আগেই তার শোধ নিয়ে আমি জেলে গিয়ে ঢুকবো। তুই ঘরে যা।

নরোত্তম। ঘরে যাব না, কাছেই থাকব জগা।

[নরোত্তমের প্রস্থান। অপর দিক দিয়া গোবিন্দ,
বেণী ও দরোয়ানের প্রবেশ। হাতে তাহার লণ্ঠন]

বেণী। (চমকিয়া) দাঁড়িয়ে কে রে?

জগন্নাথ। আমি জগন্নাথ।

গোবিন্দ। পথে দাঁড়িয়ে লোক ভাঙ্গান হচ্চে, কেউ না খেতে যায়! না রে হারামজাদা?

জগন্নাথ। গাল দিয়ো না বলচি গাঙ্গুলীমশাই।

বেণী। গাল দেবে না হারামজাদা—শালা! কাল চাল কেটে ভিটেয় সরষে বুনে দেব জানিস?

জগন্নাথ। অনেকের দিয়েচ জানি, কিন্তু আর না দিতে পার আমি তার ব্যবস্থা কোরে যাব।

বেণী। কি ব্যবস্থা করবি রে হারামজাদা? শুনি?

[এই বলিয়া সে অগ্রসর হইয়া গেল]

জগন্নাথ। এই যে ব্যবস্থা!

[এই বলিয়া সে বেণীর মাথায় সজোরে আঘাত করিল]

বেণী। (বসিয়া পড়িয়া) বাবা রে! গেছি রে বাবা!
[গোবিন্দ ও দরোয়ান চীৎকার করিয়া দ্রুতপদে পলায়ন করিল।

বেণী। তোর পায়ে পড়ি বাবা, জগন্নাথ, ব্রহ্মহত্যা করিস নে। দোহাই বাবা, তোকে দশ বিঘে জমি দেব।

জগন্নাথ। জমি তোমার চাইনে—সে তোমার থাক। ব্রহ্মহত্যাও করব না!

বেণী। আজ থেকে তোর সঙ্গে বাপ-ব্যাটা সম্পর্ক জগন্নাথ—যা চাইবি তুই—

জগন্নাথ। কিছুই চাইব না। কিন্তু বাপ-ব্যাটার সম্পর্ক তোমার সঙ্গে? ছিঃ! আর সাবধান করে দিচ্চি বড়বাবু, এই মারই তোমার শেষ মার নয়। বাবু বোলে, বামুন বোলে যতই সয়েচি, ততই অত্যাচার বেড়ে গেছে। আর আমরা সইব না। দেখি তোমরা সিধে হও কিনা!

[প্রস্থান]

বেণী। বাবা রে, মরে গেছি রে! সব শালা পালাল রে!

[গোবিন্দ ও দরোয়ানের প্রবেশ]

গোবিন্দ। (হাঁপাইতে হাঁপাইতে) পালাবো কেন বাবা, পালাই নি। ছুটে লোক ডাকতে গিয়েছিলাম। জগা শালা কি-রকম গুণ্ডা জান ত? শালাকে ডাকাতির চার্জে পাঁচ বচ্ছর ঠেলে দেবো—তবে আমার নাম গোবিন্দ গাঙ্গুলী!

দরোয়ান। (হাঁপাইতে হাঁপাইতে) হাঁথ মে একঠো হাথিয়ার রহতা!

বেণী। দূর হ শালা সুমুখ থেকে। মেরে তক্তা বানিয়ে দিলে—(মাথায় হাত দিয়া দেখিয়া) বাবা গো! কি রক্ত পড়চে গো,—আর আমি বাঁচব না।

[বেণী শুইয়া পড়িল]

গোবিন্দ। (ধরিয়া তুলিবার চেষ্টা করিয়া) বাঁচবে, বাঁচবে। আমি নিজে তোমাকে কলকাতার হাসপাতালে নিয়ে যাব। (দরোয়ানের প্রতি) ধর না শালা ছাতুখোর। শালা ভয়ে শিয়ালের মত ছুটে পালাল।

দরোয়ান। কেয়া করে বাবুজি, বিন্‌ হাথিয়ার—

[উভয়ে বেণীকে তুলিয়া লইয়া প্রস্থান করিল]

তৃতীয় দৃশ্য

[রমার শয়নকক্ষ। পীড়িত রমা শয্যায় শায়িত। সম্মুখে প্রাতঃসূর্যালোক খোলা জানালার ভিতর দিয়া মেঝের উপর ছড়াইয়া পড়িয়াছে। বিশ্বেশ্বরী প্রবেশ করিলেন]

বিশ্বেশ্বরী। (অশ্রুভরা কণ্ঠে) আজ কেমন আছিস মা, রমা?

রমা। (একটুখানি হাসিয়া) ভাল আছি জ্যাঠাইমা!

বিশ্বেশ্বরী। রাত্রে জ্বরটা কি ছেড়েছিল?

রমা। না। কিন্তু বোধ হয় শিগগির একদিন ছেড়ে যাবে।

বিশ্বেশ্বরী। কাশিটা?

রমা। কাশিটা বোধ করি তেমনি আছে।

বিশ্বেশ্বরী। তবু বলিস ভাল আছিস মা! (রমা নিঃশব্দে হাসিল, বিশ্বেশ্বরী তাহার শিয়রে গিয়া বসিলেন এবং মাথায় হাত বুলাইয়া দিতে দিতে কহিলেন) তোর হাসি দেখলে মনে হয় মা, যেন গাছ থেকে ছেঁড়াফুল দেবতার পায়ের কাছে পড়ে হাসছে! রমা?

রমা। কেন জ্যাঠাইমা?

বিশ্বেশ্বরী। আমি ত তোর মায়ের মত রমা—

রমা। মত কেন জ্যাঠাইমা, তুমিই ত আমার মা।

বিশ্বেশ্বরী। (হেঁট হইয়া রমার ললাট চুম্বন করিলেন) তবে সত্যি করে বল দেখি মা, তোর কি হয়েছে?

রমা। অসুখ করেচে জ্যাঠাইমা।

বিশ্বেশ্বরী। (রমার রুক্ষ চুলগুলিতে হাত বুলাইয়া কহিলেন) সে ত এই দুটো চামড়ার চোখেই দেখতে পাই মা। যা এতে ধরা যায় না তেমনি যদি কিছু থাকে মায়ের কাছে লুকোস নে রমা। লুকোলে ত অসুখ সারবে না মা!

রমা। (কিছুক্ষণ জানালার বাহিরে নিঃশব্দে চাহিয়া থাকিয়া) বড়দা কেমন আছেন জ্যাঠাইমা?

বিশ্বেশ্বরী। মাথার ঘা সারতে দেরি হবে বটে, কিন্তু হাসপাতাল থেকে পাঁচ—ছয় দিনেই বাড়ি আসতে পারবে।—দুঃখ কোরো না মা, এই তার প্রয়োজন ছিল। এতে তার ভালই হবে। ভাবচো, মা হয়ে সন্তানের এতবড় দুর্ঘটনায় এ কথা বলচি কি কোরে? কিন্তু তোমাকে সত্যি বলচি রমা, এতে আমি ব্যথা বেশি পেয়েচি কি আনন্দ বেশি পেয়েচি বলতে পারিনে। অধর্মকে যারা ভয় করে না, লজ্জা যাদের নেই, প্রাণের ভয়টা যদি না তাদের তেমনি বেশি থাকে মা, সংসার ছারখার হয়ে যায়। তাই কেবলই মনে হয়, এই চাষার ছেলে বেণীর যে মঙ্গল করে দিয়ে গেল পৃথিবীতে কোন আত্মীয়বন্ধুই তার সে ভাল করতে পারতো না। কয়লাকে ধুয়ে তার রং বদলানো যায় না মা, তাকে আগুনে পোড়াতে হয়।

রমা। কিন্তু এমনধারা ত আগে ছিল না জ্যাঠাইমা! কে দেশের চাষাদের এ-রকম কোরে দিলে?

জ্যাঠাইমা। সে কি তুই নিজেই বুঝিস নি মা, কে এদের বুক এমন কোরে ভরে দিয়ে গেছে। ওরা ভাবলে তাকে যেমন কোরে হোক জেলে বন্ধ করলেই আপদ চুকল। কিন্তু এ কথা তারা ভাবলে না যে, আগুন জ্বলে উঠে শুধু শুধু নেবে না। জোর করে নেবালেও সে আশেপাশের জিনিস তাতিয়ে দিয়ে যায়।

রমা। কিন্তু এই কি ভালো জ্যাঠাইমা?

বিশ্বেশ্বরী। ভাল বৈ কি মা। একদিকে প্রবলের অত্যাচার করবার অখণ্ড স্পর্ধা, অন্য দিকে নিরুপায়ের সহ্য করবার তেমনি অবিচ্ছিন্ন ভীরুতা,—এই দুইই যদি সে খর্ব করে থাকে মা, বেণীর কথা মনে করে আমি কোনদিন দীর্ঘশ্বাস ফেলব না। বরঞ্চ এই প্রার্থনাই করব, সে আবার ফিরে এসে দীর্ঘজীবী হয়ে যেন এমনি কোরেই কাজ করতে পারে। রমা, এক সন্তান যে কি সে শুধু মায়েই জানে। বেণীকে যখন তারা রক্তমাখা অবস্থায় পালকিতে করে হাসপাতালে নিয়ে গেল, তখন যে আমার কি হয়েছিল তোমাকে বোঝাতে পারব না। কিন্তু তবুও কারুকে আমি অভিশাপ দিতে পারিনি। এ কথা ত ভুলতে পারিনি মা, যে, ধর্মের শাসন মায়ের মুখ চেয়ে থাকে না।

রমা। তোমার সঙ্গে তর্ক করচি নে জ্যাঠাইমা, কিন্তু এই যদি সত্যি হয়, তবে রমেশদা কোন্‌ পাপে এ দুঃখ ভোগ করচেন? আমরা যা কোরে তাঁকে জেলে দিয়েছি এ কথা ত কারও অগোচর নেই।

বিশ্বেশ্বরী। নেই বলেই ত বেণী আজ হাসপাতালে। আর তোমার—কি জানিস মা, কোন কাজই কোনদিন শুধু শুধু শূন্যে মিলিয়ে যায় না। তার শক্তি কোথাও-না-কোথাও গিয়ে কাজ করেই। কিন্তু কি কোরে করে তা সকল সময় ধরা পড়ে না বলেই আজ পর্যন্ত এ সমস্যার মীমাংসা হোলো না, কেন একের পাপে অন্যে প্রায়শ্চিত্ত করে। কিন্তু করতে যে হয় রমা, তাতে ত সংশয় নেই।

[রমা নীরবে দীর্ঘশ্বাস মোচন করিল]

বিশ্বেশ্বরী। এর থেকে আমারও চোখ ফুটেচে মা, ভাল করব বললেই সংসারে ভাল করা যায় না। গোড়ার ছোট—বড় অনেকগুলো সিঁড়ি উত্তীর্ণ হবার ধৈর্য থাকা চাই। একদিন রমেশ হতাশ হয়ে যখন চলে যেতে চেয়েছিল তখন আমিই যেন তাকে যেতে দিইনি। তাই তার জেলের খবর শুনে মনে হয়েছিল আমিই যেন তাকে জেলে পাঠালাম। তখন ত জানিনি মা,—বাইরে থেকে ছুটে এসে ভাল করতে যাওয়ার বিড়ম্বনা এত। সে কাজ এত কঠিন।

রমা। কেন জ্যাঠাইমা?

বিশ্বেশ্বরী। আগে যে দেশের সঙ্গে এক হয়ে মিলতে হয়, সে কথা ত তখনও মনেও ভাবিনি। প্রথম থেকেই সে তার মস্ত জোর, মস্ত প্রাণ নিয়ে এতই উঁচুতে এসে দাঁড়াল যে কেউ তার নাগালই পেলে না। কিন্তু এখন ভাবি তাকে নাবিয়ে এনে ভগবান মঙ্গল করেছেন।

রমা। ভগবান নয় জ্যাঠাইমা—আমরা। কিন্তু আমাদের অধর্ম তাঁকে কেন নাবিয়ে আনবে?

বিশ্বেশ্বরী। আনবে বৈ কি মা, নইলে পাপ আর এত ভয়ঙ্কর কেন? উপকারের প্রত্যুপকার কেউ যদি না-ই করে, এমন কি উলটে অপকার করে, তাতেই বা কি আসে-যায় মা, মানুষের কৃতঘ্নতায় যদি না দাতাকে নাবিয়ে আনে। তুই বলচিস রমা, কিন্তু তোদের গ্রাম কি আর রমেশকে ঠিক তেমনিটি ফিরে পাবে? তোরা স্পষ্ট দেখতে পাবি, সে যে হাত দিয়ে দশের কল্যাণ করে বেড়াত, তার সেই হাতটাই ভৈরব আচায্যি—আর একা ভৈরব কেন, তোদের সবাই মিলে মুচড়ে ভেঙ্গে দিয়েচে। কে জানে, হয়ত ভালই হয়েচে। তার বলিষ্ঠ সমগ্র হাতের অপর্যাপ্ত দান গ্রহণ করবার শক্তি যখন লোকের ছিল না, তখন এই ভাঙ্গা হাতটাই তাদের সত্যিকার কাজে লাগবে।

[এই বলিয়া তিনি গভীর নিশ্বাস ত্যাগ করিলেন। তাঁহার হাতখানি
রমা নীরবে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করিয়া নিজেও দীর্ঘশ্বাস মোচন করিল]

রমা। জ্যাঠাইমা?

বিশ্বেশ্বরী। কেন মা?

রমা। লাঞ্ছনা-গঞ্জনা আর আমার গায়ে লাগে না, মা। মিথ্যে সাক্ষী দিয়ে যেদিন তাঁকে জেলে দিয়েচি, সেদিন থেকে জগতে সমস্ত ব্যথা কেবল পরিহাস হয়ে গেছে।

বিশ্বেশ্বরী। এমনিই হয় মা।

রমা। সকলে বলতে লাগলেন শত্রুকে যেমন কোরে হোক নিপাত করতে দোষ নেই। তাঁরা তাই করেচেন। কিন্তু, আমার ত সে কৈফিয়ত নেই জ্যাঠাইমা!

বিশ্বেশ্বরী। তোমারই বা নেই কেন?

রমা। না মা, নেই।—একটা কথা আজ তোমার কাছে স্বীকার করব জ্যাঠাইমা। মোড়লদের বাড়িতে ছেলেরা জড় হয়ে রমেশদার কথামত সৎ আলোচনাই করত।

বদমাইশের দল ব’লে তাদের পুলিশে ধরিয়ে দেবার একটা মতলব চলছিল। আমি লোক পাঠিয়ে তাদের সাবধান করে দিই। কারণ, পুলিশ ত এই চায়। একবার তাদের হাতে পেলে ত আর রক্ষে রাখত না।

বিশ্বেশ্বরী। (শিহরিয়া) বলিস কি রে? নিজের গ্রামের মধ্যে পুলিশের উৎপাত বেণী মিথ্যে কোরে ডেকে আনতে চেয়েছিল?

রমা। মনে হয় বড়দার এই শাস্তি তারই ফল। আমাকে মাপ করতে পারবে জ্যাঠাইমা?

বিশ্বেশ্বরী। তার মা হয়ে এ যদি না ক্ষমা করতে পারি, কে পারবে রমা? আমি আশীর্বাদ করি এর পুরস্কার ভগবান তোমাকে যেন দেন।

রমা। (হাত দিয়া অশ্রু মুছিয়া ফেলিল) আমার এই একটা সান্ত্বনা, তিনি ফিরে এসে দেখবেন তাঁর আনন্দের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে আছে। যা তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর সেই দেশের দীন-দুঃখীরা এবার ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসেচে। তাঁকে চিনেচে, তাঁকে ভালোবেসেচে। এই ভালবাসার আনন্দে আমার অপরাধ কি তিনি ভুলতে পারবেন না?—জ্যাঠাইমা, শুধু একটি জায়গায় আমরা দূরে যেতে পারিনি। তোমাকে আমরা দু’জনেই ভালোবেসেছিলাম।

[বিশ্বেশ্বরী নিঃশব্দে তাহার চিবুক স্পর্শ করিয়া চুম্বন করিলেন]

রমা। সেই জোরে একটি দাবী তোমার কাছে আজ রেখে যাব। যখন আমি আর থাকব না, তখনও যদি আমাকে তিনি ক্ষমা করতে না পারেন, শুধু এই কথাটি আমার হয়ে তাঁকে বোলো, যত মন্দ বলে আমাকে তিনি জানতেন, তত মন্দ আমি ছিলাম না। আর যত দুঃখ তাঁকে দিয়েচি, তার অনেক বেশী দুঃখ যে আমি নিজেও সয়েচি,—তোমার মুখের এই কথাটি হয়ত তিনি অবিশ্বাস করবেন না।

বিশ্বেশ্বরী। তবে, চল মা আমরা কোন তীর্থস্থানে গিয়ে থাকি। যেখানে রমেশ নেই, বেণী নেই, যেখানে চোখ তুললেই ভগবানের মন্দিরের চুড়ো চোখে পড়ে, সেইখানেই যাই। আমি সমস্ত বুঝতে পেরেচি রমা। যদি যাবার দিনই তোর এগিয়ে এসে থাকে মা, তবে এ বিষ বুকের মধ্যে নিয়ে আর যাব না—সমস্ত এইখানেই নিঃশেষ করে ফেলে রেখে যাব। কেমন, পারবি ত মা?

রমা। (বিশ্বেশ্বরীর জানুর উপর মুখ লুকাইয়া আকুল হইয়া কাঁদিয়া ফেলিল, কহিল) আমি আর পারিনে জ্যাঠাইমা, আমাকে এখান থেকে তুমি নিয়ে চল।

চতুর্থ দৃশ্য

কারা-প্রাচীরের সম্মুখের পথ

[এক দিক দিয়া রমেশ প্রবেশ করিল ও অপর দিক দিয়া বেণী—তাহার মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা—স্কুলের হেডমাস্টার বনমালী ও কয়েকজন ছাত্র। পশ্চাতে বেণীর অনুগত আরও দুই—চারিজন লোক]

বেণী। (রমেশকে আলিঙ্গন করিয়া) রমেশ, ভাই রে, নাড়ীর টান যে এমন টান এবার তা টের পেয়েচি। রমা যে আচায্যি হারামজাদাকে হাত কোরে এত শত্রুতা করবে, লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে নিজে এসে মিথ্যে সাক্ষী দিয়ে এত দুঃখ দেবে, সে কথা জেনেও যে জানিনি, ভগবান তার শাস্তি আমাকে দিয়েচেন। জেলের মধ্যে তুই বরং ছিলি ভাল ভাই, বাইরে থেকে এই ক’টা মাস আমি যে তুষের আগুনে জ্বলে-পুড়ে গেছি।

[রমেশ হতবুদ্ধির মত কি যে করিবে ভাবিয়া পাইল না।
বনমালী ও ছেলেরা অগ্রসর হইয়া তাহার পায়ের ধূলা লইল]

বেণী। (কাঁদিয়া ফেলিয়া) দাদার ওপর অভিমান রাখিস নে ভাই, বাড়ি চল্‌। মা কেঁদে কেঁদে দু’চক্ষু অন্ধ করবার যোগাড় করেচেন। আমরা শুধু প্রাণে বেঁচে আছি রমেশ।

রমেশ। (বেণীর মাথার ব্যান্ডেজটা হাত দিয়া দেখাইয়া) এ কি বড়দা, মাথা ভাঙলো কি করে?

বেণী। শুনে আর কি হবে ভাই, আমি কাউকে দোষ দিইনে। এ আমার নিজেরই কর্মফল,—আমারই পাপের শাস্তি।—জানিস ত রমেশ, এই আমার জন্মগত দোষ যে মনে এক, মুখে আর কিছুতে করতে পারিনে। মনের ভাব আর পাঁচজনের মত ঢেকে রাখতে পারিনে বলে কত শাস্তিই যে ভোগ করতে হয়,—কিন্তু তবু ত আমার চৈতন্য হয় না। দোষের মধ্যে সেদিন কাঁদতে কাঁদতে বলে ফেলেছিলাম, রমা, আমরা তোর কাছে কি অপরাধ করেচি যে ভাইকে আমার জেলে দিলি! জেল হয়েচে শুনলে মা যে একেবারে প্রাণ বিসর্জন করবেন। আমরা ভায়ে ভায়ে সম্পত্তি নিয়ে ঝগড়া করি, যা করি, তবু ত সে আমার ভাই। তুই একটি আঘাতে আমার ভাইকে মারলি,—আমার মাকে মারলি!—রমেশ, সেদিন রমার সে উগ্রমূর্তি মনে হলে আজও হৃদ্‌কম্প হয়। বললে, রমেশের বাপ আমার বাপকে জেলে দিতে যায়নি? পারলে ছেড়ে দিত বুঝি?

রমেশ। হাঁ, রমার মাসীর মুখেও একথা শুনছিলাম।

বেণী। এই হোলো তার জাতক্রোধ। কিন্তু মেয়েমানুষের এত দর্প আমারও সহ্য হল না। আমিও রেগে বলে ফেললাম, আচ্ছা, ফিরে আসুক সে, তার পরে এর বিচার হবে। কিন্তু খুন করা যে তার অভ্যেস ভাই। তোমাকে খুন করতে আকবর লেঠেলকে পাঠিয়েছিল মনে নেই? কিন্তু তোমার কাছে ত চালাকি খাটেনি—তুমিই উলটে শিখিয়ে দিয়েছিলে! কিন্তু আমাকে খুন করা আর শক্ত কি?

রমেশ। তার পরে?

বেণী। তার পরে কি আর মনে আছে ভাই? কে কিসে করে যে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল, সেখানে কি হল, কে দেখলে কিছুই জানিনে। এ যাত্রা যে রক্ষে পেয়েচি সে কেবল মায়ের পুণ্যে। এমন মা কি আর আছে রমেশ!

[রমেশের মুখে ও মনের মধ্যে কত কি যে হইতে লাগিল
তাহার নির্দেশ নাই,—কিন্তু সে একটা কথাও কহিল না]

বেণী। গাড়ি তৈরি ভাই। আর দেরি নয়,—বাড়ি চল্‌। মায়ের কাছে তোরে একবার পৌঁছে দিয়ে আমি বাঁচি।

রমেশ। চলুন। জেলের মধ্যেই শুনেছিলাম রমা নাকি বড় পীড়িত?

বেণী। ভগবানের দণ্ড রমেশ—এ যে তাঁরই রাজ্য, এ কি সবাই মনে রাখে? জগদীশ্বর! চল ভাই, ঘরে চল।

পঞ্চম দৃশ্য

রমার কক্ষ

[রমেশ প্রবেশ করিয়া রমাকে দেখিয়া চমকিয়া গেল]

রমেশ। তোমার এত অসুখ করেচে তা ত আমি ভাবিনি!

[রমা শয্যা হইতে কোনমতে উঠিয়া রমেশের পায়ের কাছে প্রণাম করিল ]

রমেশ। এখন কেমন আছ রানী?

রমা। আমাকে আপনি রমা বলেই ডাকবেন।

রমেশ। বেশ তাই। শুনেছিলাম তুমি অসুস্থ ছিলে। এখন কেমন আছ এই খবরটাই জানতে চাচ্ছিলাম। নইলে, নাম তোমার যাই হোক, সে ধরে ডাকবার আমার ইচ্ছেও নেই, আবশ্যকও নেই।

রমা। এখন আমি ভাল আছি। আমি ডেকে পাঠিয়েচি বলে আপনি হয়ত খুব আশ্চর্য হয়েচেন, কিন্তু—

রমেশ। না, হইনি। তোমার কোন কাজে আশ্চর্য হবার দিন আমার কেটে গেছে। কিন্তু ডেকে পাঠিয়েচ কেন শুনি?

রমা। (ক্ষণকাল অধোমুখে নিরুত্তর হইয়া থাকিয়া) রমেশদা, আজ দুটি কাজের জন্যে তোমাকে কষ্ট দিয়ে ডেকে এনেচি। কত যে অপরাধ করেচি সে ত জানি, তবুও আমি নিশ্চয় জানতাম তুমি আসবেই। আর আমার এই শেষ অনুরোধ-দুটিও অস্বীকার করবে না।

[বলিতে বলিতে অশ্রুভারে গলা তাহার ভাঙ্গিয়া আসিল]

রমেশ। কি তোমার অনুরোধ?

রমা। (চকিতের ন্যায় মুখ তুলিয়াই পুনরায় আনত করিল) পীরপুরের যে বিষয়টা বড়দা তোমার সাহায্যে দখল করতে চাচ্ছেন সেটা আমার নিজের। বাবা বিশেষ করে আমাকেই সেটা দিয়ে গেছেন। তার পোনর-আনা আমার, এক আনা তোমাদের। সেইটেই তোমাকে আমি দিয়ে যেতে চাই।

রমেশ। তোমার ভয় নেই, বড়দা যাই কেন না আমাকে বলুন, আমি চুরি করতে পূর্বেও কখনো কাউকে সাহায্য করিনি, এখনো করব না। আর যদি দান করতেই চাও, তার জন্যে অন্য লোক আছে। আমি দান গ্রহণ করিনে।

রমা। আমি জানি রমেশদা, তুমি চুরি করতে সাহায্য করবে না। আর নিলেও যে তুমি নিজের জন্যে নেবে না সেও আমি জানি। কিন্তু তা ত নয়। দোষ করলে শাস্তি হয়। আমি যত অপরাধ করেচি, এটা তারই দণ্ড বলে কেন গ্রহণ কর না?

রমেশ। তোমার দ্বিতীয় অনুরোধ?

রমা। আমার যতীনকে আমি তোমার হাতে দিয়ে গেলাম—

রমেশ। দিয়ে গেলাম মানে?

রমা। (রমেশের মুখের প্রতি চাহিয়া) একদিন কোন মানেই তোমার কাছে গোপন থাকবে না রমেশদা,—তাই, আমার যতীনকে আমি তোমাকেই দিয়ে যাব। তাকে তোমার মত করেই মানুষ কোরো। বড় হয়ে সে যেন তোমারি মত স্বার্থত্যাগ করতে পারে। (আঁচলে চোখ মুছিয়া) এ আমার চোখে দেখে যাবার সময় হবে না। কিন্তু শেখালে হয়ত সেও একদিন তোমারি মত মাথা উঁচু কোরে দাঁড়াবে।

[রমেশ চুপ করিয়া রহিল]

রমা। চুপ কোরে থাকলে ত আজ তোমাকে ছাড়ব না রমেশদা।

রমেশ। দেখ, এ-সকলের মধ্যে আর আমাকে টেনো না। আমি অনেক দুঃখের পরে একটুখানি আলোর শিখা জ্বালতে পেরেচি, তাই কেবলই ভয় হয়, পাছে একটুতেই তা নিবে যায়।

রমা। তোমার ভয় নেই রমেশদা, এ আলো আর নিববে না। জ্যাঠাইমা বলছিলেন, তুমি দূর থেকে এসে বড় উঁচুতে বসে কাজ করতে চেয়েছিলে বলেই এত বাধা পেয়েচ।তখন পরের মত তুমি গ্রাম্য-সমাজের অতীত ছিলে, এখন হয়েচ তাদেরই একজন। তখন তোমার দেওয়া ছিল বিদেশীর দান, আজ হয়েচে তা আত্মীয়ের স্নেহের উপহার। দুঃখ পেয়ে দুঃখ সয়ে সে তুমি আর নেই। তাই এ আলো আর ম্লান হবে না,—এখন প্রতিদিনই উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।

রমেশ। ঠিক জান রমা, আমার এই দীপের শিখাটুকু আর নিববে না?

রমা। ঠিক জানি। যিনি সব জানেন, এ সেই জ্যাঠাইমার কথা। এ কাজ তোমারি। আমার যতীনকে তুমি হাতে তুলে নিয়ে, আমার সকল অপরাধ ক্ষমা কোরে, আজ আশীর্বাদ কর যেন নিশ্চিন্ত হয়ে আমি যেতে পারি।

রমেশ। কিন্তু যাবার কথাই বা তুমি কেন ভাবচ রমা,—আমি বলচি তুমি আবার ভাল হয়ে যাবে।

রমা। ভাল হবার কথা ত ভাবচি নে রমেশদা, শুধু ভাবচি আমার যাবার কথা। কিন্তু আরও একটি অনুরোধ তোমাকে রাখতে হবে। আমার কথা নিয়ে বড়দার সঙ্গে তুমি কোনদিন বিবাদ করো না।

রমেশ। এ কথার মানে?

রমা। মানে যদি কখনো শুনতে পাও, সেদিন কেবল এই কথাটি মনে কোরো, আমি কেমন কোরে নিঃশব্দে সহ্য করে চলে গেছি—একটি কথারও প্রতিবাদ করিনি। একদিন যখন অসহ্য মনে হয়েছিল, সেদিন জ্যাঠাইমা এসে বলেছিলেন,—মা, মিথ্যেকে ঘাঁটাঘাঁটি করে জাগিয়ে তুললেই তার পরমায়ু বেড়ে ওঠে। নিজের অসহিষ্ণুতায় তার আয়ু বাড়িয়ে তোলার মত পাপ আর নেই। তাঁর এই উপদেশটি তুমিও কখনো ভুলো না রমেশদা।

[রমেশ নীরবে তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল]

রমা। আজ আমাকে তুমি ক্ষমা করতে পারচ না ভেবে দুঃখ পেয়ো না রমেশদা। আমি ঠিক জানি আজ যা কঠিন মনে হচ্ছে, একদিন তাই সোজা হয়ে যাবে। সেদিন আমার সকল অপরাধ তুমি সহজেই ক্ষমা করবে জেনে মনের মধ্যে আর আমার ক্লেশ নেই।—কাল সকালেই আমি যাচ্চি।

রমেশ। কাল সকালেই? কোথায় যাবে কাল?

রমা। জ্যাঠাইমা যেখানে নিয়ে যাবেন আমি সেইখানেই যাব।

রমেশ। কিন্তু তিনি ত আর আসবেন না শুনচি।

রমা। আমিও না। আমিও তোমার পায়ে আজ জন্মের মতই বিদায় নিলাম।

[এই বলিয়া রমা মাটিতে মাথা ঠেকাইয়া প্রণাম করিল]

রমেশ। আচ্ছা যাও। কিন্তু অকস্মাৎ কেন বিদায় নিলে তাও কি জানতে পারব না?

[রমা মৌন হইয়া রহিল]

রমেশ। কেন যে তোমার সমস্ত কথাই লুকিয়ে রেখে চলে গেলে সে তুমিই জান। কিন্তু আমিও কায়মনে প্রার্থনা করি, একদিন যেন তোমাকে সর্বান্তঃকরণে ক্ষমা করতে পারি। তোমাকে ক্ষমা করতে না পারায় যে আমার কি ব্যথা, সে শুধু আমিই জানি।

[এই সময়ে বিশ্বেশ্বরী প্রবেশ করিয়া ডাকিলেন—]

বিশ্বেশ্বরী। রমা!

রমেশ। জ্যাঠাইমা! কি অপরাধে আমাদের এত শীঘ্র ত্যাগ করে চললে?

বিশ্বেশ্বরী। অপরাধ? অপরাধের কথা বলতে গেলে ত শেষ হবে না বাবা। তাতে কাজ নেই। কিন্তু আমার নিজের কথাটা তুই জেনে রাখ্‌। এখানে যদি মরি রমেশ, বেণী আমার মুখে আগুন দেবে। সে হলে ত মুক্তি পাব না বাবা। ইহকালটা ত জ্বলে-জ্বলেই গেল, পাছে পরকালটাও এমনি জ্বলে-পুড়ে মরি, আমি সেই ভয়েই পালাচ্চি রমেশ।

রমেশ। জ্যাঠাইমা, ছেলের অপরাধ যে তোমার বুকে এমন কোরে বেজেছিল সে ত কোনদিন জানতে দাওনি? কিন্তু সমস্ত ছেড়ে রমা কেন বিদায় নিতে চায়? তাকে তুমি কোথায় নিয়ে যাবে?

রমা। আমি আসচি জ্যাঠাইমা।

[প্রস্থান]

বিশ্বেশ্বরী। জিজ্ঞেসা করছিলি রমা কেন বিদায় নিতে চায়? কোথায় তাকে আমি নিয়ে যেতে চাই? সংসারে আর তার স্থান হোল না রমেশ, তাই তাকে এবার ভগবানের পায়ের নীচে নিয়ে যাব। সেখানে গিয়েও সে বাঁচে কিনা জানিনে, কিন্তু যদি বাঁচে, বাকি জীবনটা এই অতি-কঠিন প্রশ্নের মীমাংসা করতে বলব, কেন ভগবান তাকে এত রূপ, এত গুণ, এতবড় একটা মহাপ্রাণ দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন, আর কেনই বা বিনা দোষে দুঃখের বোঝা মাথায় দিয়ে আবার সংসারের বাইরে ফেলে দিলেন। এ কি তাঁরই অভিপ্রায়, না এ শুধু আমাদের সমাজের খেয়ালের খেলা! ওরে রমেশ, তার মত দুঃখিনী বুঝি আর পৃথিবীতে নেই।

[বলিতে বলিতে তাঁহার গলা ভাঙ্গিয়া পড়িল। রমেশ নীরবে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল]

বিশ্বেশ্বরী। কিন্তু তোর ওপর আমার এই আদেশ রইল রমেশ, তাকে যেন তুই ভুল বুঝিস নে। যাবার সময় আমি কারও বিরুদ্ধে কোন নালিশ করে যেতে চাইনে, শুধু এই কথাটা আমার তুই ভুলেও কখনো অবিশ্বাস করিস নে যে, তার বড় মঙ্গলাকাঙ্ক্ষিনী তোর আর নেই।

রমেশ। কিন্তু জ্যাঠাইমা

বিশ্বেশ্বরী। এর মধ্যে কোন ‘কিন্তু’ নেই রমেশ। তুই যা শুনেচিস সব মিথ্যে, যা জেনেচিস সব ভুল, কিন্তু এ অভিযোগের এইখানেই যেন শেষ হয়। তোর কল্যাণের কাজ যেন বন্যার মত সমস্ত দ্বেষ-হিংসা ভাসিয়ে নিয়ে বয়ে যেতে পারে, তোর ওপর এই তার শেষ প্রার্থনা। এই জন্যেই সে মুখ বুজে সমস্ত সহ্য করেছে। প্রাণ দিতে বসেচে রমেশ, তবু কথা কয়নি।

রমেশ। তাকে বোলো জ্যাঠাইমা—

বিশ্বেশ্বরী। পারিস ত নিজেই তাকে বলিস রমেশ, আমার আর সময় নেই।

[প্রস্থান]

[যতীনকে সঙ্গে লইয়া রমা প্রবেশ করিল। তাহার পরিধানে
দূরে বাহিরে যাইবার পরিচ্ছদ]

রমেশ। (সবিস্ময়ে) এ কি! এত রাত্রে এ বেশ কেন?

রমা। যাত্রা করে বেরিয়ে এলাম রমেশদা, রাত আর নেই। যাবার আগে দুটি কাজ বাকী ছিল। এক তোমার শেষ পায়ের ধুলো নেওয়া, আর যতীনকে তোমার হাতে তুলে দেওয়া।

রমেশ। এ ভার আমাকেই দিয়ে যাবে রমা?

রমা। রমা ত নয়,—রানী। তার সবচেয়ে আদরের ধন এই ছোট ভাইটি। তাকে তুমি ছাড়া আর কে নিতে পারে রমেশদা?

রমেশ। কিন্তু এর কতবড় দায়িত্ব—এ অনুরোধ রমা—

রমা। এখনো রমা—? কিন্তু এ ত অনুরোধ নয়, এ তার দাবী! এই দাবী নিয়েই সে সংসারে একদিন এসেছিল, এই দাবী নিয়েই সে সংসার থেকে যাবে। এ দাবীর ত অন্ত নেই রমেশদা,—একে তুমি ফাঁকি দেবে কি কোরে? এই নাও।

[এই বলিয়া সে যতীনকে তাহার হাতে দিয়া
পায়ের নীচে গড় হইয়া প্রণাম করিল]

ষোড়শী

নাট্যোল্লিখিত ব্যক্তিগণ

পুরুষ

জীবানন্দ চৌধুরী: চণ্ডীগড়ের জমিদার
প্রফুল্ল রায়: জীবানন্দের সেক্রেটারি
এককড়ি নন্দী: ঐ গোমস্তা
জনার্দন রায়: মহাজন
নির্মল বসু: ঐ জামাতা ও ব্যারিস্টার
শিরোমণি: ব্রাহ্মণ পণ্ডিত
তারাদাস চক্রবর্তী: ষোড়শীর পিতা
সাগর সর্দার: ষোড়শীর অনুচর
পূজারী, ম্যাজিস্ট্রেট, ইন্‌স্‌পেক্টার, সাব-ইন্‌স্‌পেক্টার, বল্লভ ডাক্তার, ফকির, হরিহর, বিশ্বম্ভর, ভিক্ষুকদ্বয়, মহাবীর, বেহারা, ভৃত্য, পথিক, গাড়োয়ান, পাইকগণ ইত্যাদি।

স্ত্রী

ষোড়শী: গড়চণ্ডীর ভৈরবী
হৈমবতী: জনার্দনের কন্যা ও নির্মলের স্ত্রী

ভিক্ষুক-কন্যা, নারীগণ ইত্যাদি।

প্রথম অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

চণ্ডীগড়—গ্রাম্যপথ

[বেলা অপরাহ্নপ্রায়। চণ্ডীগড়ের সঙ্কীর্ণ গ্রাম্যপথের পরে সন্ধ্যার ধূসর ছায়া নামিয়া আসিতেছে। অদূরে বীজগাঁ’র জমিদারী কাছারিবাটীর ফটকের কিয়দংশ দেখা যাইতেছে। জন-দুই পথিক দ্রুতপদে চলিয়া গেল, তাঁহাদেরই পিছনে একজন কৃষক মাঠের কর্ম শেষ করিয়া গৃহে ফিরিতেছিল, তাহার বাঁ-কাঁধে লাঙ্গল, ডান হাতে ছড়ি, অগ্রবর্তী অদৃশ্য বলদযুগলের উদ্দেশে হাঁকিয়া বলিতে বলিতে গেল, “ধলা, সিধে চ’ বাবা, সিধে চল! কেলো, আবার আবার! আবার পরের গাছপালায় মুখ দেয়!”

কাছারির গোমস্তা এককড়ি নন্দী ধীরে ধীরে প্রবেশ করিল এবং উৎকণ্ঠিত শঙ্কায় পথের একদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় গলা বাড়াইয়া কিছু একটা দেখিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। তাহার পিছনের পথ দিয়া দ্রুতপথে বিশ্বম্ভর প্রবেশ করিল। সে কাছারির বড় পিয়াদা, তাগাদায় গিয়াছিল, অকস্মাৎ সংবাদ পাইয়াছে বীরগাঁ’র নবীন জমিদার জীবানন্দ চৌধুরী চণ্ডীগড়ে আসিতেছেন। ক্রোশ-দুই দূরে তাঁহার পালকি নামাইয়া বাহকেরা ক্ষণকালের জন্য বিশ্রাম লইতেছিল, আসিয়া পড়িল বলিয়া]

বিশ্বম্ভর। নন্দীমশাই, দাঁড়িয়ে করতেছ কি? হুজুর আসছেন যে!

এককড়ি। (চমকিয়া মুখ ফিরাইল। এ দুঃসংবাদ ঘণ্টা-খানেক পূর্বে তাহার কানে পৌঁছিয়াছে। উদাস-কণ্ঠে কহিল) হুঁ।

বিশ্বম্ভর। হুঁ কি গো? স্বয়ং হুজুর আসছেন যে!

এককড়ি। (বিকৃত-স্বরে) আসছেন ত আমি করব কি? খবর নেই, এত্তালা নেই—হুজুর আসছেন। হুজুর বলে ত আর মাথা কেটে নিতে পারবে না!

বিশ্বম্ভর। (এই আকস্মিক উত্তেজনার অর্থ উপলব্ধি না করিতে পারিয়া একমুহূর্ত মৌন থাকিয়া শুধু কহিল) আরে, তুমি কি মরিয়া হয়ে গেলে নাকি?

এককড়ি। মরিয়া কিসের! মামার বিষয় পেয়েছে বৈ ত কেউ আর বাপের বিষয় বলবে না! তুই জানিস বিশু, কালীমোহনবাবু ওকে দূর করে দিয়েছিল, বাড়ি ঢুকতে পর্যন্ত দিত না। তেজ্যপুত্তুরের সমস্ত ঠিকঠাক, হঠাৎ খামকা মরে গেল বলেই ত জমিদার! নইলে থাকতেন আজ কোথায়? আমি জানি নে কি?

বিশ্বম্ভর। কিন্তু জেনে সুবিধেটা কি হচ্চে শুনি? এ মামা নয়, ভাগ্নে। ও-কথা ঘুণাগ্রে কানে গেলে ভিটেয় তোমার সন্ধ্যে দিতেও কাউকে বাকি রাখবে না। ধরবে আর দুম করে গুলি করে মারবে। এমন কত গণ্ডা এরই মধ্যে মেরে পুঁতে ফেলেছে জানো? ভয়ে কেউ কথাটি পর্যন্ত কয় না।

এককড়ি। হাঁ:—কথা কয় না! মগের মুল্লুক কিনা!

বিশ্বম্ভর। আরে মাতাল যে! তার কি হুঁশ পবন আছে, না দয়া-মায়া আছে! বন্দুক-পিস্তল-ছুরি-ছোরা ছাড়া এক পা কোথাও ফেলে না। মেরে ফেললে তখন করবে কি শুনি?

এককড়ি। তুই ত সেদিন সদরে গিয়েছিলি—দেখেচিস তাকে?

বিশ্বম্ভর। না, ঠিক দেখিনি বটে, তবে সে দেখাই। ইয়া গালপাট্টা, ইয়া গোঁফ, ইয়া বুকের ছাতি, জবাফুলের মত চোখ ভাঁটার মত বন্‌বন্‌ করে ঘুরচে—

এককড়ি। বিশু, তবে পালাই চ’।

বিশ্বম্ভর। আরে পালিয়ে ক’দিন তার কাছে বাঁচবে নন্দীমশাই? চুলের ঝুঁটি ধরে টেনে এনে খাল খুঁড়ে পুঁতে ফেলবে।

এককড়ি। কি তবে হবে বল? মাতালটা যদি বলে বসে শান্তিকুঞ্জেই থাকব?

বিশ্বম্ভর। কতবার ত বলেছি নন্দীমশাই, এ কাজ করো না, করো না, করো না। বছরের পর বছর খাতায় কেবল শান্তিকুঞ্জের মিথ্যে মেরামতি খরচই লিখে গেলে, গরীবের কথায় ত আর কান দিলে না।

এককড়ি। তুইও ত কাছারির বড় সর্দার, তুইও ত—

বিশ্বম্ভর। দেখ, ও-সব শয়তানি ফন্দি করো না বলচি! আমার ওপর দোষ চাপিয়েছ কি—ওগো, ওই যে একটা পালকি দেখা যায়! [নেপথ্যে বাহকদিগের কণ্ঠধ্বনি শুনা গেল। বিশ্বম্ভর পলায়নোদ্যত এককড়ির হাতটা ধরিয়া ফেলিতেই সে নিজেকে মুক্ত করিবার চেষ্টা করিতে করিতে]

এককড়ি। ছাড়্‌না হারামজাদা।

বিশ্বম্ভর। (অনুচ্চ চাপাকণ্ঠে) পালাচ্চো কোথায়? ধরলে গুলি করে মারবে যে!

[এমনি সময় পালকি সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইতে উভয়ে স্থির হইয়া দাঁড়াইল। পালকির অভ্যন্তরে জমিদার জীবানন্দ চৌধুরী বসিয়াছিলেন, তিনি ঈষৎ একটুখানি মুখ বাহির করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন]

জীবানন্দ। ওহে, এ গ্রামে জমিদারের কাছারি বাড়িটা কোথায় তোমরা কেউ বলে দিতে পার?

এককড়ি। (করজোড়ে) সমস্তই ত হুজুরের রাজ্য।

জীবানন্দ। রাজ্যের খবর জানতে চাইনি। কাছারিটার খবর জানো?

এককড়ি। জানি হুজুর। ওই যে।

জীবানন্দ। তুমি কে?

[এককড়ি ও বিশ্বম্ভর উভয়ে হাঁটু গাড়িয়া ভূমিষ্ঠ প্রণাম করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল]

এককড়ি। হুজুরের নফর এককড়ি নন্দী।

জীবানন্দ। ওহো, তুমিই এককড়ি—চণ্ডীগড়-সাম্রাজ্যের বড়কর্তা? কিন্তু দেখ এককড়ি, একটা কথা বলে রাখি তোমাকে। চাটুবাক্য অপছন্দ করিনে সত্যি, কিন্তু তার একটা কাণ্ডজ্ঞান থাকাটাও পছন্দ করি! এটা ভুলো না। তোমার কাছারির তসিল কত?

এককড়ি। আজ্ঞে, চণ্ডীগড় তালুকের আয় প্রায় হাজার-পাঁচেক টাকা।

জীবানন্দ। হাজার-পাঁচেক?—বেশ।

[বাহকেরা পালকি নীচে নামাইল। জীবানন্দ অবতরণ করিলেন না, শুধু পা-দুটা বাহির করিয়া ভূমিতলে রাখিয়া সোজা হইয়া বসিয়া কহিলেন]

বেশ। আমি এখানে দিন পাঁচ-ছয় আছি, কিন্তু এরই মধ্যে আমার হাজার-দশেক টাকা চাই এককড়ি। তুমি সমস্ত প্রজাদের খবর দাও যেন কাল তারা এসে কাছারিতে হাজির হয়।

এককড়ি। যে আজ্ঞে। হুজুরের আদেশে কেউ গরহাজির থাকবে না।

জীবানন্দ। এ গাঁয়ে দুষ্টু বজ্জাত প্রজা কেউ আছে জানো?

এককড়ি। আজ্ঞে, না তা এমন কেউ—শুধু তারাদাস চক্কোত্তি—তা সে আবার হুজুরের প্রজা নয়।

জীবানন্দ। তারাদাসটা কে?

এককড়ি। গড়চণ্ডীর সেবায়েত।

জীবানন্দ। এই লোকটাই কি বছর-দুই পূর্বে একটা প্রজা-উৎখাতের মামলায় মামার বিপক্ষে সাক্ষী দিয়েছিল?

এককড়ি। (মাথা নাড়িয়া) হুজুরের নজর থেকে কিছুই এড়ায় না। আজ্ঞে, এই সেই তারাদাস।

জীবানন্দ। হুঁ। সেবার অনেক টাকার ফেরে ফেলে দিয়েছিল। এ কতখানি জমি ভোগ করে?

এককড়ি। (মনে মনে হিসাব করিয়া) ষাট-সত্তর বিঘের কম নয়।

জীবানন্দ। একে তুমি আজই কাছারিতে ডেকে আনিয়ে জানিয়ে দাও যে, বিঘেপ্রতি আমার দশ টাকা নজর চাই।

এককড়ি। (সঙ্কুচিত হইয়া) আজ্ঞে, সে যে নিষ্কর দেবোত্তর, হুজুর।

জীবানন্দ। না, দেবোত্তর এ গাঁয়ে একফোঁটা নেই। সেলামি না পেলে সমস্ত বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে।

এককড়ি। আজই তাকে হুকুম জানাচ্ছি।

জীবানন্দ। শুধু হুকুম জানানো নয়, টাকা তাকে দু’দিনের মধ্যে দিতে হবে।

এককড়ি। কিন্তু হুজুর—

জীবানন্দ। কিন্তু থাক এককড়ি। এই সোজা বারুইয়ের তীরে আমার শান্তিকুঞ্জ, না? —মহাবীর, পালকি তুলতে বল।

[বাহকেরা পালকি লইয়া প্রস্থান করিল

এককড়ি। যা ভেবেচি তাই যে ঘটল রে বিশু! এ যে গিয়ে সোজা শান্তিকুঞ্জেই ঢুকতে চায়।

বিশ্বম্ভর। নয় ত কি তোমার কাছারির খোঁয়াড়ে গিয়ে ঢুকতে চাইবে?

এককড়ি। সেখানে হয়ত ঢোকবার পথ নেই। হয়ত দোর-জানালা সব চোরে চুরি করে নিয়ে গেছে, হয়ত বা ঘরে ঘরে বাঘ-ভালুকে বসবাস করে আছে—সেখানে কি যে আছে আর কি যে নেই, কিছুই যে জানিনে বিশ্বম্ভর।

বিশ্বম্ভর। আমি কি জানি নাকি তোমার দোর-জানালার খবর? আর বাঘ-ভালুকের কাছে ত আমি খাজনা আদায়ে যাইনি গো!

এককড়ি। এই রাত্তিরে কোথায় আলো, কোথায় লোকজন, কোথায় খাবার-দাবার—

বিশ্বম্ভর। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদলে লোকজন জুটতে পারে, কিন্তু আলো আর খাবার-দাবার—

এককড়ি। তোর কি! তুই ত বলবিই রে নচ্ছার পাজী ব্যাটা হারামজাদা—

[প্রস্থান

দ্বিতীয় দৃশ্য

শান্তিকুঞ্জ

[বারুই নদীতীরে বীজগাঁ’র জমিদার ৺রাধামোহনের নির্মিত বিলাসভবন ‘শান্তিকুঞ্জ’। সংস্কারের অভাবে আজ তাহা জীর্ণ, শ্রীহীন, ভগ্নপ্রায়। তাহারই একটা কক্ষে তক্তপোশের উপর বিছানা, বিছানায় চাদরের অভাবে একটা বহুমূল্য শাল পাতা; শিয়রের দিকে একটা গোল টেবিল, তাহাতে মোটা বাঁধানো একখানা বইয়ের উপর আধপোড়া একটা মোমবাতি। তাহারই পাশে একটা পিস্তল। হাতের কাছে একটা টুল, তাহাতে সোডার বোতল, সুরাপূর্ণ গ্লাস ও মদের বোতল। বোতলটা প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে। পার্শ্বে দামী একটা সোনার ঘড়ি—ঘড়িটা ছাইয়ের আধারস্বরূপে ব্যবহৃত হইয়াছে—আধপোড়া একটা চুরুট হইতে তখনও ধূমের রেখা উঠিতেছে। সম্মুখের দেওয়ালে গোটা-দুই নেপালী কুকরী টাঙ্গানো, কোণে একটা বন্দুক ঠেস দিয়া রাখা, তাহারই অদূরে মেঝের উপর একটা শৃগালের মৃতদেহ হইতে রক্তের ধারা বহিয়া শুকাইয়া গিয়াছে। ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত কয়েকটা শূন্য মদের বোতল; একটা ডিসে উচ্ছিষ্ট ভুক্তাবশেষ তখনও পরিষ্কৃত হয় নাই, সন্নিকটে একখানা দামী ঢাকাই চাদরে হাত মুছিয়া ফেলিয়া দেওয়া হইয়াছে—সেটা মেঝেতে লুটাইতেছে। জীবানন্দ চৌধুরী বিছানায় আড় হইয়া পড়িয়া। পায়ের দিকের জানালাটা ভাঙ্গা, তাহার ফাঁক দিয়া বাহিরের একটা গাছের ডালের খানিকটা ভিতরে ঢুকিয়াছে। দুইদিকে দুইটি দরজা—দরজা ঠেলিয়া জীবানন্দের সেক্রেটারি প্রফুল্ল প্রবেশ করিল]

প্রফুল্ল। সেই লোকটা এখানেও এসেছিল দাদা।

জীবানন্দ। কে বল ত?

প্রফুল্ল। সেই মাদ্রাজী সাহেবের কর্মচারী, যিনি আখের চাষ আর চিনির কারখানার জন্যে সমস্ত দক্ষিণের মাঠটা কিনতে চান। সত্যই কি ওটা বিক্রি করে দেবেন?

জীবানন্দ। নিশ্চয়। আমার এখন ভয়ানক টাকার দরকার।

প্রফুল্ল। কিন্তু অনেক প্রজার সর্বনাশ হবে।

জীবানন্দ। তা হবে, কিন্তু আমার সর্বনাশটা বাঁচবে।

প্রফুল্ল। আর একটি লোক বাইরে বসে আছেন, তাঁর নাম জনার্দন রায়। আসতে বলব?

জীবানন্দ। না ভায়া, এখন থাক। সাধু-সন্দর্শন যখন-তখন করতে নেই—শাস্ত্রের নিষেধ আছে।

প্রফুল্ল। (হাসিয়া) লোকটা শুনেছি খুব ধনী।

জীবানন্দ। শুধু ধনী নয়, গুণী। চিঠা, খত, তমসুক, দলিল, যথা-ইচ্ছা ইনি প্রস্তুত করে দিতে পারেন—নকল নয়, অনুকরণ নয়, একেবারে অভিনব, অপূর্ব, যাকে বলে সৃষ্টি। মহাপুরুষ ব্যক্তি।

প্রফুল্ল। এ-সব লোককে প্রশ্রয় দেবেন না দাদা।

জীবানন্দ। তার প্রয়োজন নেই প্রফুল্ল, ইনি নিজের প্রতিভায় যে উচ্চে বিচরণ করেন, আমার প্রশ্রয় সেখানে নাগাল পাবে না।

প্রফুল্ল। শুনলাম সমস্ত মাঠটা আপনার একার নয়, দাদা। এ সম্বন্ধে—

জীবানন্দ। না। প্রফুল্ল, এ সম্বন্ধে তোমাকে আমি কথা কইতে দেব না। দেনায় গলা পর্যন্ত ডুবে আছি, এর পরে তোমার সৎ-অসতের ভূত ঘাড়ে চাপলে আর রসাতলে তলিয়ে যাবার দেরি হবে না।

[একপাত্র মদ পান করিয়া]

জীবানন্দ। তুমি ভাবচ রসাতলের দেরিই বা কত? দেরি নেই সে আমি জানি। আরও একটা কথা তোমার চেয়ে বেশি জানি প্রফুল্ল, এর কূল-কিনারাও নেই।

[প্রফুল্ল নিঃশব্দে মুখ তুলিয়া চাহিল]

জীবানন্দ। ওই তোমার মস্ত দোষ প্রফুল্ল, শেষ হওয়া জিনিসটাও নিঃশেষ হচ্ছে শুনলে তোমার চোখ ছলছল করে আসে। যাও ত ভায়া, এককড়িকে পাঠিয়ে দাও ত। আর দেখ, তোমাকে একবার সদরে গিয়ে মাদ্রাজী সাহেবের সঙ্গে পাকা কথা কইতে হবে। বুঝলে?

প্রফুল্ল। (মাথা নাড়িয়া) তা হলে এখনো ত বেলা আছে। আজই ত যেতে পারি। সাহেবের সঙ্গে গাড়ি আছে।

জীবানন্দ। বেশ, তা হলে এঁর গাড়িতেই যাও।

[প্রফুল্লর প্রস্থান ও এককড়ির প্রবেশ]

জীবানন্দ। টাকা আদায় হচ্চে এককড়ি?

এককড়ি। হচ্চে হুজুর।

জীবানন্দ। তারাদাস টাকা দিলে?

এককড়ি। সহজে দিতে চায়নি। শেষে কান ধরে ঘোড়দৌড়, ব্যাঙের নাচ নাচাবার প্রস্তাব করতেই দিতে রাজি হয়ে বাড়ি গেছে। আজ দেবার কথা ছিল।

জীবানন্দ। তার পরে?

এককড়ি। মহাবীর সিংকে সঙ্গে দিয়ে হুজুরের পালকি বেহারাদের পাঠিয়েছি তাকে ধরে আনতে।

জীবানন্দ। (মদ্যপান করিয়া) ঠিক হয়েছে। তোমাদের এখানে বোধ করি বিলিতি মদের দোকান নেই। তা না থাক, যা আমার সঙ্গে আছে তাতেই এ ক’টা দিন চলে যাবে। কিন্তু আরও একটা কথা আছে এককড়ি।

এককড়ি। আজ্ঞে করুন।

জীবানন্দ। দেখ এককড়ি, আমি বিবাহ—হাঁ—বিবাহ আমি করিনি—বোধ হয় কখনো করবও না। (একটু পরে) কিন্তু তাই বলে আমি ভীষ্মদেব—বলি মহাভারত পড়েচ ত? তার ভীষ্মদেব সেজেও বসিনি—শুকদেব হয়েও উঠিনি—বলি কথাটা বুঝলে ত এককড়ি? ওটা চাই।

[এককড়ি লজ্জায় মাথা হেঁট করিয়া একটুখানি ঘাড় নাড়িল]

জীবানন্দ। অপর সকলের মত যাকে-তাকে দিয়ে এ-সব কথা বলাতে আমি ভালোবাসি নে, তাতে ঠকতে হয়। আচ্ছা এখন যাও।

এককড়ি। আমি তারাদাসকে দেখি গে। সে এর মধ্যে প্রজা বিগড়ে না দেয়। (যাইতেছিল)

জীবানন্দ। প্রজা বিগড়ে দেবে? আমি উপস্থিত থাকতে?

এককড়ি। হুজুর, পারে ওরা।

জীবানন্দ। তারাদাসকেই ত জানি, আবার ‘ওরা’ এল কারা?

এককড়ি। চক্কোত্তির মেয়ে ভৈরবী। নইলে চক্কোত্তিমশাই নিজে তত লোক মন্দ নয়, কিন্তু মেয়েটাই হচ্চে আসল সর্বনাশী। দেশের যত বোম্বেটে বদমাশগুলো হয়েছে যেন একেবারে তার গোলাম।

জীবানন্দ। বটে! কত বয়স? দেখতে কেমন?

[ঘরের মধ্যে ক্রমশঃ সন্ধ্যার আবছায়া ঘনাইয়া আসিতে লাগিল]

এককড়ি। বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ হতে পারে। আর রূপের কথা যদি বলেন হুজুর ত সে যেন এক কাটখোট্টা সিপাই! না আছে মেয়েলি ছিরি, না আছে মেয়েলি ছাঁদ। যেন চূয়াড়, যেন হাতিয়ার বেঁধে লড়াই করতে চলেছে। তাতেই ত দেশের ছোটলোকগুলো মনে করে গড়ের উনিই হচ্চেন সাক্ষাৎ চণ্ডী।

জীবানন্দ। (উৎসাহ ও কৌতূহলে সোজা উঠিয়া বসিয়া) বল কি এককড়ি? ভৈরবীর ব্যাপারটা কি খুলে বল ত শুনি?

এককড়ি। ভৈরবী ত কারু নাম নয় হুজুর। গড়চণ্ডীর প্রধান সেবিকাদের ওই হলো উপাধি। বর্তমান ভৈরবীর নাম ষোড়শী, এর আগে যিনি ছিলেন তাঁর নাম ছিল মাতঙ্গিনী। মার আদেশে তাঁর সেবায়েত কখনো পুরুষ হতে পারে না, চিরদিন মেয়েরাই হয়ে আসছে।

জীবানন্দ। তাই নাকি? এ ত কখনো শুনিনি।

এককড়ি। মায়ের আদেশে বিয়ের তেরাত্রি পরে স্বামীকে আর ভৈরবীর স্পর্শ করবারও জো নেই। তাই দূরদেশ থেকে দুঃখী গরীবদের একটা ছেলে ধরে এনে বিয়ে দিয়ে পরের দিনই টাকাকড়ি দিয়ে সেই যে বিদায় করা হয়, আর কখনো কেউ তার ছায়াও দেখতে পায় না। এই নিয়ম, এই-ই চিরকাল ধরে হয়ে আসচে।

জীবানন্দ। (সহাস্যে) বল কি এককড়ি, একেবারে দেশান্তর? ভৈরবী মানুষ, রাত্রে নিরিবিলি একপাত্র সুধা ঢেলে দেওয়া—গরমমশলা দিয়ে চারটি মহাপ্রসাদ রেঁধে খাওয়ানো—একেবারে কিছুই করতে পায় না?

এককড়ি। (মাথা নাড়িয়া) না হুজুর, মায়ের ভৈরবীকে স্বামী স্পর্শ করতে নেই, কিন্তু তাই বলে কি স্বামী ছাড়া গাঁয়ে আর পুরুষ নেই? মাতু ভৈরবীকেও দেখেচি, ষোড়শী ভৈরবীকেও দেখছি। লোকগুলো কি আর খামকা—তার সাক্ষী দেখুন না—কথায় কথায় হুজুরের সঙ্গে মামলা-মকর্দমা বাধিয়ে দেয়!

জীবানন্দ। মেয়ে-মোহন্ত আর কি! তাতে দোষ নেই। এককড়ি আলোটা জ্বালো ত।

এক কড়ি। (আলো জ্বালিয়া) এখন আসি হুজুর।

জীবানন্দ। আচ্ছা যাও। বইখানা দিয়ে যাও ত।

[বই দিয়া প্রণাম করিয়া এককড়ি প্রস্থান করিল

[জীবানন্দ শুইয়া পুস্তকে মনোনিবেশ করিলেন। একটু পরে বাহিরে কাহার পায়ের শব্দ হইল।]

জীবানন্দ। কে?

সর্দার। (ষোড়শীকে লইয়া প্রবেশ করিয়া কহিল) শালা তারাদাস ভাগ্‌ গিয়া। হুজুর, উস্‌কো বেটীকো পাকড় লায়া।

জীবানন্দ। (বই ফেলিয়া ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া বসিয়া বিস্মিতভাবে) কাকে? ভৈরবীকে? (কিছুক্ষণ পরে) ঠিক হয়েছে। আচ্ছা যা।

[সর্দার অনুচর পাইকদের লইয়া প্রস্থান করিল

জীবানন্দ। তোমাদের আজ টাকা দেবার কথা। টাকা এনেচ? (ষোড়শীর কণ্ঠস্বর ফুটিল না) আনো নি জানি। কিন্তু কেন?

ষোড়শী। আমাদের নেই।

জীবানন্দ। না থাকলে সমস্ত রাত্রি তোমাকে পাইকদের ঘরে আটকে থাকতে হবে। তার মানে জানো।

[ষোড়শী দ্বারের চৌকাঠটা দুই হাতে সবলে চাপিয়া ধরিয়া চোখ বুজিয়া মূর্ছা হইতে আত্মরক্ষার চেষ্টা করিতে লাগিল; এই ভয়ানক বিবর্ণ মুখের চেহারা জীবানন্দের চোখে পড়িল, মিনিট-খানেক সে কেমন যেন আচ্ছন্নের ন্যায় বসিয়া রহিল। তারপরে বাতির আলোটা হঠাৎ হাতে তুলিয়া লইয়া ষোড়শীর কাছে গেল। আলোটা তাহার মুখের সম্মুখে ধরিয়া একদৃষ্টে ষোড়শীর গৈরিক বস্ত্র, তাহার এলায়িত রুক্ষ কেশভার, তাহার পাণ্ডুর ওষ্ঠাধর, তাহার সবল সুস্থ ঋজু দেহ, সমস্তই সে যেন দুই বিস্ফারিত চক্ষু দিয়া নিঃশব্দে গিলিতে লাগিল। এই ভাবে কিছুক্ষণ কাটিয়া গেলে পর]

জীবানন্দ। (ফিরিয়া গিয়া আলোটা রাখিয়া দিয়া মদের বোতল হইতে কয়েক পাত্র উপর্যুপরি পান করিয়া) তোমার নাম ষোড়শী, না? (ষোড়শী নীরব) তোমার বয়স কত? (কোন উত্তর না পাইয়া কঠিন-স্বরে) চুপ করে থেকে বিশেষ কোন লাভ হবে না, জবাব দাও।

ষোড়শী। (মৃদু-স্বরে) আমার বয়স আটাশ।

জীবানন্দ। বেশ। তা হলে খবর যদি সত্যি হয় ত, এই উনিশ-কুড়ি বৎসর ধরে তুমি ভৈরবীগিরি করচ; খুব সম্ভব অনেক টাকা জমিয়েছ। দিতে পারবে না কেন?

ষোড়শী। আপনাকে আগেই ত জানিয়েছি আমার টাকা নেই।

জীবানন্দ। না থাকলে আরও দশজনে যা করছে তাই কর। যাদের টাকা আছে তাদের কাছে জমি বাঁধা দিয়ে হোক, বিক্রি করে হোক দাও গে।

ষোড়শী। তারা পারে, জমি তাদের। কিন্তু দেবতার সম্পত্তি বাঁধা দেবার, বিক্রি করবার ত আমার অধিকার নেই।

জীবানন্দ। (হঠাৎ হাসিয়া) নেবার অধিকার কি ছাই আমারই আছে? এক কপর্দকও না। তবুও নিচ্চি, কেন না আমার চাই। এই চাওয়াটাই হচ্ছে সংসারের খাঁটি অধিকার, তোমারও যখন দেওয়া চাই-ই, তখন—বুঝলে? (কিছু পরে) যাক, এত রাত্রে কি একা বাড়ি যেতে পারবে? যাদের সঙ্গে তুমি এসেছিলে তাদের আর সঙ্গে দিতে চাইনে।

ষোড়শী। (সবিনয়ে) আপনার হুকুম হলেই যেতে পারি।

জীবানন্দ। (সবিস্ময়ে) একলা? এই অন্ধকার রাত্রে? ভারি কষ্ট হবে যে! (হাসিতে লাগিল)

ষোড়শী। না, আমাকে এখুনি যেতেই হবে।

জীবানন্দ। (সহাস্যে) বেশ ত, টাকা না হয় নাই দেবে ষোড়শী। তা ছাড়া আরো অনেক রকমের সুবিধে—

ষোড়শী। আপনার টাকা, আপনার সুবিধা আপনারই থাক, আমাকে যেতে দিন।

[কয়েক পা অগ্রসর হইয়া সেই পাইকদের সম্মুখে কিছুদূরে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া আপনিই থমকিয়া দাঁড়াইল]

জীবানন্দ। (মুখ অন্ধকার করিয়া কঠিন-স্বরে) তুমি মদ খাও?

ষোড়শী। না।

জীবানন্দ। তোমার কয়েকজন পুরুষ বন্ধু আছে শুনেছি। সত্যি?

ষোড়শী। (মাথা নাড়িয়া) না, মিছে কথা।

জীবানন্দ। (ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া) তোমার পূর্বেকার সকল ভৈরবীই মদ খেতেন—সত্যি? মাতঙ্গী ভৈরবীর চরিত্র ভাল ছিল না—এখনো তার সাক্ষী আছে। সত্যি, না মিছে?

ষোড়শী। (লজ্জিত মৃদুকণ্ঠে) সত্যি বলেই শুনেছি।

জীবানন্দ। শুনেছ? ভালো। তবে হঠাৎ তুমিই বা এমন দলছাড়া, গোত্রছাড়া ভাল হতে গেলে কেন? (হঠাৎ সোজা উঠিয়া বসিয়া পুরুষ-কণ্ঠস্বরে) মেয়েমানুষের সঙ্গে তর্কও আমি করিনে, তাদের মতামতও কখনো জানতে চাইনে। তুমি ভাল কি মন্দ, চুল-চিরে তার বিচার করবারও আমার সময় নেই। আমি বলি, চণ্ডীগড়ের সাবেক ভৈরবীদের যেভাবে কেটেছে তোমারও তেমনিভাবে কেটে গেলেই যথেষ্ট। আজ তুমি এই বাড়িতেই থাকবে।

[হুকুম শুনিয়া ষোড়শী বজ্রাহতের ন্যায় একেবারে কাঠ হইয়া গেল]

জীবানন্দ। তোমার সম্বন্ধে কি করে যে এতটা সহ্য করেচি জানিনে; আর কেউ এ বেয়াদপি করলে এতক্ষণ তাকে পাইকদের ঘরে পাঠিয়ে দিতুম। এমন অনেককে দিয়েচি।

ষোড়শী। (অকস্মাৎ কাঁদিয়া ফেলিয়া, গলায় আঁচল দিয়া করজোড়ে) আমার যা-কিছু আছে সব নিয়ে আজ আমাকে ছেড়ে দিন।

জীবানন্দ। কেন বল ত? এরকম কান্নাও নতুন নয়, এরকম ভিক্ষেও এই নতুন শুনচি নে! কিন্তু তাদের সব স্বামী-পুত্র ছিল—কতকটা না হয় বুঝতেও পারি। (ষোড়শী শিহরিয়া উঠিয়া) কিন্তু তোমার ত সে বালাই নেই। পনের-ষোল বছরের মধ্যে তোমার স্বামীকে তুমি ত চোখেও দেখনি। তা ছাড়া তোমাদের ত এতে দোষই নেই।

ষোড়শী। (করজোড়ে অশ্রুরুদ্ধকণ্ঠে) স্বামীকে আমার ভালো মনে নেই সত্যি, কিন্তু তিনি ত আছেন! যথার্থ বলচি আপনাকে, কখনো কোন অন্যায়ই আমি আজ পর্যন্ত করিনি। দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিন—

জীবানন্দ। (হাঁক দিয়া) মহাবীর—

ষোড়শী। (আতঙ্কে কাঁদিয়া) আমাকে আপনি মেরে ফেলতে পারবেন, কিন্তু—

জীবানন্দ। আচ্ছা, ও বাহাদুরি কর গে ওদের ঘরে গিয়ে। মহাবীর—

ষোড়শী। (মাটিতে লুটাইয়া পড়িয়া কাঁদিয়া) কারও সাধ্য নেই আমার প্রাণ থাকতে নিয়ে যেতে পারে। আমার যা কিছু দুর্দশা—যত অত্যাচার আপনার সামনেই হোক—আপনি আজও ব্রাহ্মণ, আপনি আজও ভদ্রলোক!

জীবানন্দ। (কঠিন নিষ্ঠুর হাস্য করিল) তোমার কথাগুলো শুনতে মন্দ নয়, কিন্তু কান্না দেখে আমার দয়া হয় না। আমি অনেক শুনি। মেয়েমানুষের উপর আমার এতটুকু লোভ নেই—ভাল না লাগলেই চাকরদের দিয়ে দিই। তোমাকেও দিয়ে দিতুম, শুধু এই বোধ হয় আজ প্রথম একটু মোহ জন্মেছে। ঠিক জানিনে—নেশা না কাটলে ঠাওর পাচ্ছিনে।

মহাবীর। (দ্বারপ্রান্তে আসিয়া) হুজুর!

জীবানন্দ। (সম্মুখের কবাটটায় অঙ্গুলি-নির্দেশ করিয়া) একে আজ রাত্রের মত ও-ঘরে বন্ধ করে রেখে দে। কাল আবার দেখা যাবে।

ষোড়শী। (গলদশ্রুলোচনে) আমার সর্বনাশটা একবার ভেবে দেখুন হুজুর! কাল যে আমি আর মুখ দেখাতে পারব না।

জীবানন্দ। দু’একদিন! তার পরে পারবে। সেই লিভারের ব্যথাটা আজ সকাল থেকেই টের পাচ্ছিলাম। এখন হঠাৎ ভারী বেড়ে উঠল—আর বেশী বিরক্ত করো না—যাও—

মহাবীর। (তাড়া দিয়া) আরে, উঠ্‌না মাগী—চোল্!

জীবানন্দ। (ভয়ানক ধমক দিয়া) খবরদার, শুয়োরের বাচ্ছা, ভালো করে কথা বল্‌! ফের যদি কখনো আমার হুকুম ছাড়া কোন মেয়েমানুষকে ধরে আনিস ত গুলি করে মেরে ফেলব। (মাথার বালিশটা পেটের কাছে টানিয়া লইয়া উপুড় হইয়া শুইয়া যাতনায় অস্ফুট আর্তনাদ করিয়া) আজকের মত ও-ঘরে বন্ধ থাকো, কাল তোমার সতীপনার বোঝাপড়া হবে। আঃ—এই, যা’না আমার সুমুখ থেকে একে সরিয়ে নিয়ে।

মহাবীর। (আস্তে আস্তে বলিল) চলিয়ে—

[ষোড়শী নির্দেশমত নিরুত্তরে পাশের অন্ধকার ঘরে যাইতেছিল]

জীবানন্দ। ষোড়শী, একটু দাঁড়াও, প্রফুল্ল নেই, সে সদরে গেছে—তুমি পড়তে জানো, না?

ষোড়শী। জানি।

জীবানন্দ। তা হলে একটু কাজ করে যাও। ওই যে বাক্সটা, ওর মধ্যে আর একটা কাগজের বাক্স পাবে। কয়েকটা ছোট-বড় শিশি আছে, যার গায়ে বাঙলায় ‘মরফিয়া’ লেখা তার থেকে একটুখানি ঘুমের ওষুধ দিয়ে যাও। কিন্তু খুব সাবধান, এ ভয়ানক বিষ। মহাবীর, আলোটা ধর।

[মহাবীর আলো ধরিল]

ষোড়শী। (বাতির আলোকে কম্পিত-হস্তে শিশিটা বাহির করিয়া) কতটুকু দিতে হবে?

জীবানন্দ। (তীব্র বেদনায় অব্যক্ত ধ্বনি করিয়া) ঐ ত বললুম খুব একটুখানি। আমি উঠতেও পারচি নে, আমার হাতেরও ঠিক নেই, চোখেরও ঠিক নেই। ওতেই একটা কাঁচের ঝিনুক আছে, তার অর্ধেকেরও কম। একটু বেশি হয়ে গেলে এ ঘুম তোমার চণ্ডীর বাবা এসেও ভাঙ্গাতে পারবে না।

[পরিমাণ স্থির করিতে ষোড়শীর হাত কাঁপিতে লাগিল, অবশেষে অনেক যত্নে অনেক সাবধানে নির্দেশমত ঔষধ লইয়া কাছে আসিয়া দাঁড়াইল]

জীবানন্দ। (হাত বাড়াইয়া সেই বিষ লইয়া চোখ বুজিয়া মুখে ফেলিয়া দিল) খুব কমই দিয়েচ—ফল হবে না হয়ত। আচ্ছা এই থাক।

[ষোড়শী পাশের ঘরে পা বাড়াইয়াছে, এমন সময় এককড়ি নিতান্ত ব্যস্ত ও ব্যাকুলভাবে প্রবেশ করিয়া ও এদিক-ওদিক চাহিয়া জীবানন্দের কানের কাছে চুপি চুপি কি বলিতে লাগিল। জীবানন্দের মুখের ভাবে বিশেষ পরিবর্তন দেখা গেল। ষোড়শী দ্বারপ্রান্তে স্তম্ভিতের মত দাঁড়াইয়া রহিল]

জীবানন্দ। (হাত নাড়িয়া ষোড়শীকে) তোমার ভয় নেই, কাছে এসো, (ষোড়শী আসিলে) পুলিশের লোক বাড়ি ঘিরে ফেলেছে—ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব গেটের মধ্যে ঢুকেছেন—এলেন বলে। (ষোড়শী চমকিয়া উঠিল) জেলার ম্যাজিস্ট্রেট টুরে বেরিয়ে ক্রোশ-খানেক দূরে তাঁবু ফেলেছিলেন, তোমার বাবা এই রাত্রেই তাঁর কাছে গিয়ে সমস্ত জানিয়েছেন। কেবল তাতেই এতটা হতো না, কে-সাহেবের নিজেরই আমার উপর ভারী রাগ। গত বৎসর দু’বার ফাঁদে ফেলবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পারেনি—আজ একেবারে হাতে হাতে ধরে ফেলেচে—(একটু হাসিল)

এককড়ি। (মুখ চুন করিয়া) হুজুর, এবার বোধ হয় আমাদেরও আর রক্ষা নেই।

জীবানন্দ। সম্ভব বটে। (ষোড়শীকে) শোধ নিতে চাও ত এই-ই সময়। আমাকে জেলে দিতেও পার।

ষোড়শী। এতে জেল হবে কেন?

জীবানন্দ। আইন। তা ছাড়া, কে-সাহেবের হাতে পড়েচি। বাদুড়বাগানের মেসে থাকতে এরই কাছে একবার দিন-কুড়ি হাজতবাসও হয়ে গেছে। কিছুতে জামিন দিলে না—আর জামিনই বা তখন হতো কে!

ষোড়শী। (উৎসুক-কণ্ঠে) আপনি কি কখনো বাদুড়বাগানের মেসে ছিলেন?

জীবানন্দ। হাঁ। ওই সময়ে একটা প্রণয়কাণ্ডের বৃন্দে হয়েছিলুম—ব্যাটা আয়ান ঘোষ কিছুতে ছাড়লে না—পুলিশে দিলে। যাক, সে অনেক কথা। কে আমাকে ভোলেনি, বেশ চিনে। আজও পালাতে পারতুম, কিন্তু ব্যথায় শয্যাগত হয়ে পড়েচি, নড়বার জো নেই।

ষোড়শী। (কোমল-কণ্ঠে) ব্যথাটা কি আপনার কমচে না?

জীবানন্দ। না, তা ছাড়া এ সারবার ব্যথাও নয়।

ষোড়শী। (কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া) আমাকে কি করতে হবে?

জীবানন্দ। শুধু বলতে হবে তুমি নিজের ইচ্ছায় এসেচ, নিজের ইচ্ছায় এখানে আছ। তার বদলে তোমাকে সমস্ত দেবোত্তর ছেড়ে দেব, হাজার টাকা নগদ দেব, আর নজরের টাকার ত কথাই নেই।

[এককড়ি কি বলিতে যাইয়া ষোড়শীর মুখের পানে চাহিয়া থামিয়া গেল]

ষোড়শী। (সোজা হাসিয়া) এ কথা স্বীকার করার অর্থ বোঝেন? তার পরেও কি আমার জমিতে, টাকাকড়িতে প্রয়োজন থাকতে পারে বলে আপনি বিশ্বাস করেন?

জীবানন্দ। (বিবর্ণমুখে) তাই বটে ষোড়শী, তাই বটে। জীবনে আজও ত তুমি পাপ করোনি—ও তুমি পারবে না সত্যি। (একটু হাসিয়া) টাকাকড়ির বদলে যে সম্ভ্রম বেচা যায় না—ও যেন আমি ভুলেই গেছি। তাই হোক, যা সত্যি তাই তুমি বলো—জমিদারের তরফ থেকে আর কোনো উপদ্রব তোমার ওপর হবে না।

[এককড়ি ব্যাকুল হইয়া আবার কি বলিতে গেল, কিন্তু রুদ্ধদ্বারে পুনঃ পুনঃ করাঘাতের শব্দ শুনিয়া বিবর্ণমুখে থামিয়া গেল]

জীবানন্দ। (সাড়া দিয়া) খোলা আছে, ভিতরে আসুন।

[দরজা উন্মুক্ত হইল। ম্যাজিস্ট্রেট, ইন্‌স্‌পেক্টার, কয়েকজন কনেস্টবল ও তারাদাস চক্রবর্তী প্রবেশ করিলেন]

তারাদাস। (ভিতরে ঢুকিয়াই কাঁদিয়া) ধর্মাবতার, হুজুর! এই আমার মেয়ে, মা-চণ্ডীর ভৈরবী। আপনার দয়া না হলে আজ ওকে টাকার জন্যে খুন করে ফেলত ধর্মাবতার।

ম্যাজিস্ট্রেট। (ষোড়শীর আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া) তোমারই নাম ষোড়শী? তোমাকেই বাড়ি থেকে ধরে এনে উনি বন্ধ করে রেখেছেন?

ষোড়শী। (মাথা নাড়িয়া) না, আমি নিজের ইচ্ছায় এসেচি। কেউ আমার গায়ে হাত দেয়নি।

তারাদাস। (চেঁচামেচি করিয়া উঠিল) না হুজুর, ভয়ানক মিথ্যে কথা, গ্রামসুদ্ধ সাক্ষী আছে। মা আমার ভাত রাঁধছিল, আটজন পাইক গিয়ে তাকে বাড়ি থেকে মারতে মারতে টেনে এনেছে।

ম্যাজিস্ট্রেট। (জীবানন্দের প্রতি কটাক্ষে চাহিয়া ষোড়শীকে কহিলেন) তোমার কোন ভয় নেই, তুমি সত্য কথা বল। তোমাকে বাড়ি থেকে ধরে এনেছে?

ষোড়শী। না, আমি আপনি এসেচি।

ম্যাজিস্ট্রেট। এখানে তোমার কি প্রয়োজন?

ষোড়শী। আমার কাজ ছিল।

ম্যাজিস্ট্রেট। এত রাত্রেও বাড়ি ফিরে যেতে দেরি হচ্ছিল!

তারাদাস। (চেঁচাইয়া) না হুজুর, সমস্ত মিছে—সমস্ত বানানো, আগাগোড়া শিখানো কথা।

ম্যাজিস্ট্রেট। (তাহার প্রতি লক্ষ্য না করিয়া শুধু মুখ টিপিয়া হাসিলেন এবং শিস্‌ দিতে দিতে প্রথমে বন্দুকটা এবং পরে পিস্তলটা তুলিয়া লইয়া জীবানন্দকে কেবল বলিলেন) I hope you have permission for this.

[ধীরে ধীরে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন

ম্যাজিস্ট্রেট। (নেপথ্যে) হামারা ঘোড়া লাও!

[ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনা গেল। তারাদাস হতজ্ঞানের ন্যায় স্তব্ধ অভিভূতভাবে দাঁড়াইয়া থাকিয়া]

তারাদাস। (অকস্মাৎ বুকফাটা ক্রন্দনে সকলকে সচকিত করিয়া পুলিশ-কর্মচারীর পায়ের নীচে পড়িয়া কাঁদিয়া) বাবুমশায়, আমার কি হবে! আমাকে যে এবার জমিদারের লোক জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে।

ইন্‌স্‌পেক্টার। (তিনি বয়সে প্রবীণ, শশব্যস্ত হইয়া তাহাকে চেষ্টা করিয়া হাত ধরিয়া তুলিয়া সদয়কণ্ঠে) ভয় কি ঠাকুর, তুমি যেমন ছিলে তেমনি থাকো গে। স্বয়ং ম্যজিস্ট্রেট সাহেব তোমার সহায় রইলেন—আর কেউ তোমাকে জুলুম করবে না। (কটাক্ষে জীবানন্দের দিকে চাহিলেন)

তারাদাস। (চোখ মুছিতে মুছিতে) সাহেব যে রাগ করে চলে গেলেন বাবু!

ইন্‌স্‌পেক্টার। (মুচকি হাসিয়া) না ঠাকুর, রাগ করেন নি, তবে আজকের এই ঠাট্টাটুকু তিনি সহজে ভুলতে পারবেন, এমন মনে হয় না। তা ছাড়া আমরাও মরিনি, থানাও যা হোক একটা আছে। (আড়চোখে জীবানন্দের দিকে চাহিয়া, কিছু পরে) এখন চল ঠাকুর, যাওয়া যাক। এই রাত্তিরে যেতেও ত হবে অনেকটা।

সাব-ইন্‌স্‌পেক্টার। (বয়সে তরুণ, অল্প হাসিয়া) মেয়েটি রেখে ঠাকুরটি কি তবে একাই যাবেন নাকি?

[কথাটায় সবাই হাসিল—কনস্টেবলগুলা পর্যন্ত। এককড়ি কড়িকাঠের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিল। তারাদাসের চোখের অশ্রু চোখের পলকে অগ্নিশিখায় রূপান্তরিত হইয়া গেল]

তারাদাস। (ষোড়শীর প্রতি কঠোর দৃষ্টিপাত করিয়া সগর্জনে) যেতে হয় আমি একাই যাব। আবার ওর মুখ দেখব—আবার ওকে বাড়িতে ঢুকতে দেব আপনারা ভেবেচেন?

ইন্‌স্‌পেক্টার। (সহাস্যে) মুখ তুমি না দেখতে পার কেউ মাথার দিব্যি দেবে না ঠাকুর! কিন্তু যার বাড়ি, তাকে বাড়ি ঢুকতে না দিয়ে আর যেন নতুন ফ্যাসাদে পোড়ো না।

তারাদাস। (আস্ফালন করিয়া) বাড়ি কার? বাড়ি আমার। আমিই ভৈরবী করেচি, আমিই ওকে দূর করে তাড়াব। কলকাঠি এই তারা চক্কোত্তির হাতে। (সজোরে নিজের বুক ঠুকিয়া) নইলে কে ও জানেন? শুনবেন ওর মায়ের—

ইন্‌স্‌পেক্টার। (থামাইয়া দিয়া) থামো ঠাকুর, থামো, রাগের মাথায় পুলিশের কাছে সব কথা বলে ফেলতে নেই—তাতে বিপদে পড়তে হয়। (ষোড়শীর প্রতি) তুমি যেতে চাও ত আমরা তোমাকে নিরাপদে ঘরে পৌঁছে দিতে পারি। চল, আর দেরি করো না।

[ষোড়শী অধোমুখে নিঃশব্দে দাঁড়াইয়াছিল, ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, না]

সাব-ইন্‌স্‌পেক্টার। (মুখ টিপিয়া হাসিয়া) যাবার বিলম্ব আছে বুঝি?

ষোড়শী। (মুখ তুলিয়া চাহিয়া ইন্‌স্‌পেক্টারের প্রতি) আপনারা যান, আমার যেতে এখনো দেরি আছে।

তারাদাস। (উন্মত্তের মত) দেরি আছে! হারামজাদী, তোকে যদি না খুন করি ত আমি মনোহর চক্কোত্তির ছেলে নই! (লাফাইয়া উঠিয়া ষোড়শীকে আঘাত করিতে গেল)

ইন্‌স্‌পেক্টার। (তাহাকে ধরিয়া ফেলিয়া ধমক দিয়া) ফের যদি বাড়াবাড়ি কর ত তোমাকে থানায় ধরে নিয়ে যাব। চল, ভালমানুষের মত ঘরে চল।

[তারাদাসকে টানিয়া লইয়া তিনি ও সব পুলিশ-কর্মচারী প্রস্থান করিল, এককড়িও পা টিপিয়া বাহির হইয়া গেল। দূর হইতে তারাদাসের গর্জন ও গালাগালি ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর শোনা যাইতে লাগিল]

জীবানন্দ। (ইঙ্গিতে ষোড়শীকে আরো একটু কাছে ডাকিয়া) তুমি এঁদের সঙ্গে গেলে না কেন?

ষোড়শী। এঁদের সঙ্গে ত আমি আসিনি।

জীবানন্দ। (কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকিয়া) তোমার বিষয়ের ছাড় লিখে দিতে দু’চারদিন দেরি হবে, কিন্তু টাকাটা কি তুমি আজই নিয়ে যাবে?

ষোড়শী। তাই দিন।

জীবানন্দ। (বিছানার তলা থেকে একতাড়া নোট বাহির করিল। সেইগুলা গণনা করিতে করিতে ষোড়শীর মুখের প্রতি বার বার চাহিয়া দেখিয়া একটু হাসিয়া বলিল) আমার কিছুতেই লজ্জা করে না, কিন্তু আমারও এগুলো তোমার হাতে তুলে দিতে বাধ-বাধ ঠেকছে।

ষোড়শী। (শান্ত নম্রকণ্ঠে) কিন্তু তাই ত দেবার কথা ছিল।

জীবানন্দ। কথা যাই থাক ষোড়শী, আমাকে বাঁচাতে তুমি যা খোয়ালে, তার দাম টাকায় ধার্য করচি, এ মনে করার চেয়ে বরঞ্চ আমার না বাঁচাই ছিল ভালো।

ষোড়শী। (তার মুখে স্থিরদৃষ্টে চাহিয়া) কিন্তু মেয়েমানুষের দাম ত আপনি এই দিয়েই চিরদিন ধার্য করে এসেছেন। (জীবানন্দ নিরুত্তর—কিছু পরে) বেশ, আজ যদি আপনার সে মত বদলে থাকে, টাকা না হয় রেখেই দিন, আপনাকে কিছুই দিতে হবে না। কিন্তু আমাকে কি সত্যিই এখনো চিনতে পারেন নি? ভালো করে চেয়ে দেখুন দিকি?

জীবানন্দ। (নীরবে বহুক্ষণ নিষ্পলক চাহিয়া থাকিয়া, ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়া) বোধ হয় পেরেচি। ছেলেবেলায় তোমার নাম অলকা ছিল না?

ষোড়শী। (তাহার সমস্ত মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল) আমার নাম ষোড়শী। ভৈরবী দশমহাবিদ্যার নাম ছাড়া আর কোন নাম থাকে না। কিন্তু অলকাকে আপনার মনে আছে?

জীবানন্দ। (নিরুৎসুক-কণ্ঠে) কিছু কিছু মনে আছে বৈ কি! তোমার মায়ের হোটেলে মাঝে মাঝে খেতে যেতাম। তখন তুমি ছোট ছিলে। কিন্তু আমাকে ত তুমি অনায়াসে চিনতে পেরেচ!

ষোড়শী। অনায়াসে না হলেও পেরেচি। অলকার মাকে মনে পড়ে?

জীবানন্দ। পড়ে। তিনি বেঁচে আছেন?

ষোড়শী। না—বছর-দশেক আগে তাঁর কাশীলাভ হয়েছে। আপনাকে তিনি বড় ভালোবাসতেন, না?

জীবানন্দ। (উদ্বেগে) হাঁ—একবার বিপদে পড়ে তাঁর কাছে একশ’ টাকা ধার নিয়েছিলাম, সেটা বোধ হয় আর শোধ দেওয়া হয়নি।

ষোড়শী। না, কিন্তু আপনি সেজন্য মনে কোন ক্ষোভ রাখবেন না। কারণ অলকার মা সে টাকা ধার বলে আপনাকে দেননি, জামাইকে যৌতুক বলে দিয়েছিলেন। (ক্ষণকাল চুপ করিয়া) চেষ্টা করলে এটুকু মনেও পড়তে পারে যে, সে দিনটাও ঠিক এমনি দুর্দিন ছিল। আজ ষোড়শীর ঋণটাই খুব ভারী বোধ হচ্চে, কিন্তু সেদিন ছোট্ট অলকার কুলটা মায়ের ঋণটাও কম ভারী ছিল না চৌধুরীমশাই।

জীবানন্দ। তাই মনে করতে পারতাম যদি না তিনি ঐ ক’টা টাকার জন্যে তাঁর মেয়েকে বিবাহ করতে আমাকে বাধ্য করতেন।

ষোড়শী। বিবাহ করতে তিনি বাধ্য করেন নি, বরঞ্চ করেছিলেন আপনি নিজে। কিন্তু, যাক ও-সব বিশ্রী আলোচনা। বিবাহ আপনি করেন নি, করেছিলেন শুধু একটু তামাশা। সম্প্রদানের সঙ্গে সঙ্গেই সেই যে নিরুদ্দেশ হলেন, এই বোধ হয় তার পরে আজ প্রথম দেখা।

জীবানন্দ। কিন্তু তার পরে ত তোমার সত্যিকারের বিবাহই হয়েচে শুনেচি।

ষোড়শী। তার মানে আর একজনের সঙ্গে? এই না? কিন্তু নিরুপায় বালিকার ভাগ্যে এ বিড়ম্বনা যদি ঘটেই থাকে, তবু ত আপনার সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই।

জীবানন্দ। নাই থাক, কিন্তু তোমার মা জানতেন শুধু কেবল তোমাকে তোমার বাবার হাত থেকে আলাদা রাখবার জন্যেই তিনি যা হোক একটা—

ষোড়শী। বিবাহের গণ্ডী টেনে দিয়েছিলেন? তা হবেও বা। অলকার মাও বেঁচে নেই এবং আমিই অলকা কিনা, এতকাল পরে তা নিয়েও দুশ্চিন্তা করবার আপনার দরকার নেই।

জীবানন্দ। (কিছুক্ষণ নীরবে নতমুখে থাকিয়া) কিন্তু, ধর, আসল কথা যদি তুমি প্রকাশ করে বল, তা হলে—

ষোড়শী। আসল কথাটা কি? বিবাহের কথা? কিন্তু সেই ত মিথ্যে। তা ছাড়া সে সমস্যা অলকার, আমার নয়। সারারাত এখানে কাটিয়ে গিয়ে ও-গল্প করলে ষোড়শীর সর্বনাশের পরিমাণ তাতে এতটুকু কমবে না।

জীবানন্দ। (কয়েক-মুহূর্ত নীরব থাকিয়া) ষোড়শী, আজ আমি এত নীচে নেবে গেছি যে, গৃহস্থের কুলবধূর দোহাই দিলেও তুমি মনে মনে হাসবে, কিন্তু সেদিন অলকাকে বিবাহ করে বীজগাঁ’র জমিদার বংশের বধূ বলে সমাজের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়াটাই কি ভাল কাজ হতো?

ষোড়শী। সে ঠিক জানিনে, কিন্তু সত্যি কাজ হতো এ জানি। কিন্তু আমি মিথ্যে বকচি, এখন এ-সব আর আপনার কাছে বলা নিষ্ফল। আমি চললাম—আপনি কোন কিছু দেবার চেষ্টা করে আর আমাকে অপমান করবেন না।

[এককড়ির প্রবেশ]

জীবানন্দ। (এককড়ি প্রবেশ করিতেই তাহাকে) এককড়ি, তোমাদের এখানে কোন ডাক্তার আছেন? একবার খবর দিয়ে আনতে পার? তিনি যা চাবেন আমি তাই দেব।

এককড়ি। ডাক্তার আছে বৈ কি হুজুর—আমাদের বল্লভ ডাক্তারের খাসা হাতযশ। (ষোড়শীর দিকে চাহিল)

জীবানন্দ। (ব্যগ্রকণ্ঠে) তাঁকেই আনতে পাঠাও এককড়ি, আর এক মিনিট দেরি করো না।

এককড়ি। আমি নিজেই যাচ্চি। কিন্তু হুজুরকে একলা—

জীবানন্দ। (দুঃসহ বেদনায় মুহূর্তে বিবর্ণ ও উপুড় হইয়া পড়িয়া) উঃ—আর আমি পারিনে।

ষোড়শী। তুমি বল্লভ ডাক্তারকে ডেকে আনো গে এককড়ি, এখানে যা করবার আমি করব এখন।

[এককড়ি ব্যস্তভাবে চলিয়া গেল

জীবানন্দ। (কিছুক্ষণ উপুড় হইয়া থাকিয়া মুখ তুলিয়া) ডাক্তার আসেনি? কতদূর থাকেন জানো?

ষোড়শী। কাছেই থাকেন, কিন্তু তাই বলে তিন-চার মিনিটেই কি আসা যায়?

জীবানন্দ। সবে তিন-চার মিনিট? আমি ভেবেচি আধ-ঘণ্টা—কি আরও কতক্ষণ যেন এককড়ি তাকে আনতে গেছে। (উপুড় হইয়া শুইয়া পড়িল) হয়ত তিনিও ভয়ে এখানে আসবেন না অলকা! (তাহার কণ্ঠস্বরে ও চোখের দৃষ্টিতে নিরাশ্বাসের অবধি রহিল না)

ষোড়শী। (ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া স্নিগ্ধস্বরে) ডাক্তার আসবেন বৈ কি!

জীবানন্দ। বোধ করি আমি বাঁচব না। আমার নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্চে, মনে হচ্চে, পৃথিবীতে আর বুঝি হাওয়া নেই।

ষোড়শী। আপনার কি বড্ড কষ্ট হচ্চে?

জীবানন্দ। হুঁ। অলকা, আমাকে তুমি মাপ কর। (একটু থামিয়া) আমি ঠাকুর-দেবতা মানিনে, দরকারও হয় না। কিন্তু একটু আগেই মনে মনে ডাকছিলাম। জীবনে অনেক পাপ করেচি, তার আর আদি-অন্ত নেই। আজ থেকে থেকে কেবলি মনে হচ্ছে বুঝি সব দেনা মাথায় নিয়ে যেতে হবে। (ক্ষণেক থামিয়া) মানুষ অমর নয়, মৃত্যুর বয়সও কেউ দাগ দিয়ে রাখেনি—কিন্তু এই যন্ত্রণা আর সইতে পারচি নে—উঃ—মা গো! (ব্যথার তীব্রতায় সর্বশরীর যেন আকুঞ্চিত হইয়া উঠিল)

[ষোড়শী একটু ইতস্ততঃ করিয়া শয্যাপার্শ্বে বসিয়া আঁচল দিয়া ললাটের ঘাম মুছাইয়া দিয়া, পাখার অভাবে আঁচল দিয়া বাতাস করিতে লাগিল। জীবানন্দ কোন কথা কহিল না, কেবল তাহার ডান হাতটা ধীরে ধীরে কোলের উপর টানিয়া লইল]

জীবানন্দ। (ক্ষণেক পরে) অলকা—

ষোড়শী। আপনি আমায় ষোড়শী বলে ডাকবেন।

জীবানন্দ। আর কি অলকা হতে পার না?

ষোড়শী। না।

জীবানন্দ। কোনদিন কোন কারণেই কি—

ষোড়শী। আপনি অন্য কথা বলুন। (জীবানন্দ নীরবে রহিল, ক্ষণেক পরে) কষ্টটা কি কিছুই কমেনি?

জীবানন্দ। (ঘাড় নাড়িয়া) বোধ হয় একটু কমেছে। আচ্ছা যদি বাঁচি, তোমার কি কোন উপকার করতে পারিনে?

ষোড়শী। না, আমি সন্ন্যাসিনী—আমার নিজের কোন উপকার করা কারো সম্ভব নয়।

জীবানন্দ। আচ্ছা এমন কিছুই কি নেই, যাতে সন্ন্যাসিনীও খুশি হয়?

ষোড়শী। তা হয়ত আছে, কিন্তু সেজন্যে কেন আপনি ব্যস্ত হচ্ছেন?

জীবানন্দ। (একটু ক্ষীণ হাসিয়া) আমার ঢের দোষ আছে, কিন্তু পরের উপকার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি এ দোষ আজও কেউ দেয়নি। তা ছাড়া এখন বলচি বলেই যে ভালো হয়েও বলব, তারও কোন নিশ্চয়তা নেই—এমনিই বটে! সারাজীবনে এ ছাড়া আর আমার কিছুই বোধ হয় নেই।

[ষোড়শী নীরবে তাহার কপালের ঘাম মুছাইয়া দিল]

জীবানন্দ। (হঠাৎ সেই হাতটা ধরিয়া ফেলিয়া) সন্ন্যাসিনীর কি সুখ-দুঃখ নেই? সে খুশি হয়, পৃথিবীতে এমন কি কিছুই নেই?

ষোড়শী। কিন্তু সে ত আপনার হাতের মধ্যে নয়।

জীবানন্দ। যা মানুষের হাতের মধ্যে? তেমন কিছু?

ষোড়শী। তাও আছে, কিন্তু ভালো হয়ে যদি কখনো জিজ্ঞাসা করেন তখনই জানাব।

জীবানন্দ। (তাহার হাতটাকে বুকের কাছে টানিয়া) না, না, আর ভালো হয়ে নয়—এই কঠিন অসুখের মধ্যেই আমাকে বল! মানুষকে অনেক দুঃখ দিয়েচি, আজ নিজের ব্যথার মধ্যে পরের ব্যথা, পরের আশার কথাটা একটু শুনে নিই। নিজের দুঃখের একটা সদ্গতি হোক।

[বাহিরে পদশব্দ শোনা গেল। ষোড়শী নিজের হাতটাকে ধীরে ধীরে মুক্ত করিয়া লইল]

ষোড়শী। ডাক্তারবাবু বোধ হয় এলেন।

[ডাক্তার ও এককড়ি প্রবেশ করিল। ডাক্তার ষোড়শীকে এখানে দেখিয়া একেবারে আশ্চর্য হইয়া গেলেন। কিন্তু কিছু না বলিয়া নীরবে শয্যাপ্রান্তে আসিয়া রোগ পরীক্ষা করিতে নিযুক্ত হইলেন; ষোড়শী এই সময়ে প্রস্থান করিল]

এককড়ি। যদি ভালো করতে পারেন ডাক্তারবাবু, বকশিশের কথা ছেড়েই দিন—আমরা সবাই আপনার কেনা হয়ে থাকব।

ডাক্তার। (পরীক্ষা শেষ করিয়া) অত্যাচার করে রোগ জন্মেছে। সাবধান না হলে পিলে কি লিভার পাকা অসম্ভব নয়, এবং তাতে ভয়ের কথা আছে। তবে সাবধান হলে নাও পাকতে পারে এবং তাতে ভয়ের কথাও কম। তবে এ কথা নিশ্চয় যে ওষুধ খাওয়া আবশ্যক।

জীবানন্দ। এ অবস্থায় কলকাতায় যাওয়া সম্ভব কিনা তা বলতে পারেন?

ডাক্তার। যদি যেতে পারেন তা হলেই সম্ভব, নইলে কিছুতেই সম্ভব নয়।

জীবানন্দ। এখানে থাকলে ভালো হবে কিনা বলতে পারেন?

ডাক্তার। (বিজ্ঞের মত মাথা নাড়িয়া) আজ্ঞে না হুজুর, তা বলতে পারিনে। তবে এ কথা নিশ্চয় যে এখানে থাকলেও ভালো হতে পারেন, আবার কলকাতা গিয়ে ভালো নাও হতে পারেন।

এককড়ি। হুজুরের ব্যথাটা—

ডাক্তার। এরকম ব্যথা হঠাৎ বাড়ে, আবার হঠাৎ কমে যায়। কাল সকালেই হুজুর সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। তবে এ কথা নিশ্চয় যে, আমাকে আবার আসতে হবে।

[এককড়ির কাছ থেকে ভিজিট লইয়া ডাক্তার প্রস্থান করিলেন জীবানন্দ। কি হবে এককড়ি?

এককড়ি। ভয় কি হুজুর, ওষুধ এল বলে! বল্লভ ডাক্তারের একশিশি মিক্‌চার খেলেই সব ভালো হয়ে যাবে!

জীবানন্দ। (ষোড়শী যে-দ্বারপথে একটু আগে বাহির হইয়া গেছে সেইদিকে উৎসুক-চোখে চাহিয়া) ওঁকে একবার ডেকে দিয়ে—

[এককড়ি বাহিরে গিয়া ক্ষণেক পরে পুনরায় প্রবেশ করিল]

এককড়ি। তিনি নেই, বাড়ি চলে গেছেন হুজুর। ভোর হয়ে এসেচে।

জীবানন্দ। (ব্যগ্র ব্যাকুল-কণ্ঠে) আমাকে না জানিয়ে চলে যাবেন, না। এমন হতেই পারে না এককড়ি!

এককড়ি। হাঁ হুজুর, তিনি ডাক্তারবাবু আসবার পরেই চলে গেছেন। বাইরে সর্দার বসে আছে, সে দেখেছে ভৈরবী-ঠাকরুন সোজা চলে গেলেন।

জীবানন্দ। (কিছুক্ষণ চোখের দিকে সোজা তাকাইয়া থাকিয়া) তা হলে আলোটা নিভিয়ে দিয়ে তুমিও যাও এককড়ি, আমি একটু ঘুমুব।

[এককড়ি আলো নিভাইয়া দিল। জীবানন্দ বেদনা-ম্লানমুখে পাশ ফিরিয়া শুইলেন। আলো নিভাইতেই অতি প্রত্যুষের আবছায়া আভা জানালা দিয়া ঘরে ছড়াইয়া পড়িল]

তৃতীয় দৃশ্য

৺চণ্ডী-মন্দিরের পথ। বেলা—পূর্বাহ্ন

[জনৈক ভিক্ষুক ও তাহার কন্যার প্রবেশ]

কন্যা। আর যে চলতে পারিনে বাবা, মায়ের মন্দির আর কত দূরে?

ভিক্ষুক। ঐ যে আগে কত লোক চলে যাচ্ছে মা, বোধ হয় আর বেশী দূরে নয়।

কন্যা। কে গান গাইতে গাইতে আসচে বাবা, ওকে শুধোও না?

[গান গাহিতে গাহিতে দ্বিতীয় ভিক্ষুকের প্রবেশ]

তোর পাওয়ার সময় ছিল যখন, ওরে অবোধ মন,
মরণ-খেলার নেশায় মেতে রইলি অচেতন।

প্রথম ভিক্ষুক। মায়ের মন্দির আর কত দূরে বাবা?

দ্বিতীয় ভিক্ষুক। ঐ যে—
তখন ছিল মণি, ছিল মাণিক
পথের ধারে ধারে—
এখন ডুবলো তারা দিনের শেষে
বিষম অন্ধকারে।
প্রথম ভিক্ষুক। হাঁ গা—
দ্বিতীয় ভিক্ষুক। কি গো কি?

প্রথম ভিক্ষুক। বিষ্ণু গাঁ থেকে আসছি বাবা, পথ যেন আর ফুরোয় না। শুনি যে জনার্দন রায়মশায়ের নাতির কল্যাণে আজ মায়ের পূজো। বামুন বোষ্টম ভিখারী যে যা চাইবে তাই নাকি রায়মশায়—

দ্বিতীয় ভিক্ষুক। রায়মশায় নয়, রায়মশায় নয়, তার জামাই। পশ্চিম মুল্লুকের ব্যারিস্টার—রাজা বললেই হয়। দু’ সরা চিঁড়ে মুড়কি, এক সরা সন্দেশ, আর আট-গণ্ডা পয়সা নগদ—

ভিক্ষুক-কন্যা। (পিতার প্রতি) হাঁ বাবা, তুমি যে বলেছিলে মেয়েদের একখানা করে রাঙ্গা-পেড়ে কাপড় দেবে?

দ্বিতীয় ভিক্ষুক। দেবে, দেবে। যে যা চাইবে। রায়মশায়ের মেয়ে হৈমবতী কাউকে না বলতে জানে না।

আজ মিথ্যে রে তোর খোঁজা-খুঁজি
মিথ্যে চোখের জল,
তারে কোথায় পাবি বল,
(তোর) অতল তলে তলিয়ে গেল
শেষ-সাধনার ধন।

ভিক্ষুক-কন্যা। বাবা, চাইলে হয়ত তুমিও পাবে একখানা কাপড়, না?

দ্বিতীয় ভিক্ষুক। পাবে পাবে, একটু পা চালিয়ে এসো।

তোর পাওয়ার সময় ছিল যখন,
ওরে অবোধ মন,
মরণ-খেলার নেশায় মেতে রইলি অচেতন।

[সকলের প্রস্থান

[কথা কহিতে কহিতে ষোড়শী ও ফকিরসাহেব প্রবেশ করিলেন]

ফকির। যে-সব কথা আমার কানে গেছে মা, চুপ করে থাকতে পারলাম না, চলে এলাম। কিন্তু আমি ত কিছুতেই ভেবে পাইনে ষোড়শী, সেদিন কিসের জন্য ও লোকটাকে তুমি এমন করে বাঁচিয়ে দিলে।

ষোড়শী। ঐ পীড়িত লোকটিকে জেলে পাঠানই কি উচিত হতো ফকিরসাহেব?

ফকির। সে বিবেচনার ভার ত তোমার ছিল না মা, ছিল রাজার, তাই তাঁর জেলের মধ্যেও হাসপাতাল আছে, পীড়িত অপরাধীরও তিনি চিকিৎসা করেন। কিন্তু শুধু এই যদি কারণ হয়ে থাকে ত তুমি অন্যায় করেছ বলতে হবে।

[ষোড়শী নিঃশব্দে তাঁর মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল]

ফকির। যা হবার হয়ে গেছে, কিন্তু ভবিষ্যতে এ ত্রুটি তোমাকে শুধরে নিতে হবে ষোড়শী।

ষোড়শী। তার অর্থ?

ফকির। ওই লোকটার অপরাধ ও অত্যাচারের অন্ত নেই এ তুমি জানো। শাস্তি হওয়া উচিত।

ষোড়শী। (ক্ষণেক স্তব্ধ থাকিয়া) আমি সমস্ত জানি। তাঁকে শাস্তি দেওয়াই হয়ত আপনাদের কর্তব্য, কিন্তু আমার কথা কাউকে বলবার নয়। তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে আমি কোনদিন পারব না।

ফকির। সেদিন পারো নি সত্য, কিন্তু ভবিষ্যতেও কি পারবে না?

ষোড়শী। না।

ফকির। আত্মরক্ষার জন্যেও না!

ষোড়শী। না, আত্মরক্ষার জন্যেও না।

ফকির। আশ্চর্য! (ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া) তুমি ত এখন মন্দিরে যাচ্চ ষোড়শী, আমি তা হলে চললেম।

[ষোড়শী হেঁট হইয়া নমস্কার করিল; ফকির প্রস্থান করিলেন। অন্যমনস্কের ন্যায় ষোড়শী চলিবার উপক্রম করিতেই সাগর দ্রুতবেগে আসিয়া সম্মুখে উপস্থিত হইল]

সাগর। হাঁ মা, তোমার বাবা তারাদাস ঠাকুর নাকি ঘরে ঘরে তালা বন্ধ করে তোমাকে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছে? তারা সবাই মিলে নাকি মতলব করেচে, তোমাকে চণ্ডীমন্দির থেকে বিদায় করে আবার নতুন ভৈরবী আনবে? সে হবে না, সাগর সর্দার বেঁচে থাকতে তা হবে না বলে দিচ্চি।

ষোড়শী। এ খবর তুই কোথায় শুনলি সাগর?

সাগর। শুনেছি মা, এইমাত্র শুনতে পেয়ে তোমার কাছে জানতে ছুটে এসেছি। তুমি মেয়েমানুষ, তোমাকে একলা পেয়ে যদি জমিদারের লোক বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে থাকে সে কি তোমার অপরাধ? অপরাধ সমস্ত গ্রামের। অপরাধ এই সাগরের, যে কুটুম-বাড়িতে গিয়ে আমোদে মেতেছিল—মায়ের খবর রাখতে পারেনি। অপরাধ তার খুড়ো হরিহর সর্দারের, যে গাঁয়ের মধ্যে উপস্থিত থেকেও এতবড় অপমানের শোধ নিতে পারেনি।

ষোড়শী। কিন্তু এই যদি সত্যি হয়ে থাকে সাগর, তোরা দুজন খুড়ো-ভাইপোতে উপস্থিত থাকলেই বা কি করতিস বল ত? জমিদারের কত লোকজন একবার ভেবে দেখ দিকি!

সাগর। তাও দেখেচি মা। তাঁর ঢের লোক, ঢের পাইক-পিয়াদা। গরীব বলে আমাদের দুঃখ দিতেও তারা কম করে না। কিন্তু দিক আমাদের দুঃখ, আমরা ছোটলোক বৈ ত না। কিন্তু তোমার হুকুম পেলে মা, ভৈরবীর গায়ে হাত দেবার একবার শোধ দিতে পারি। গলায় দড়ি বেঁধে টেনে এনে ওই হুজুরকেই রাতারাতি মায়ের স্থানে বলি দিতে পারি মা, কোন শালা আটকাতে পারবে না।

ষোড়শী। (শিহরিয়া) বলিস কি সাগর, তোরা কি এত নিষ্ঠুর, এমন ভয়ঙ্কর হতে পারিস? এইটুকুর জন্যে একটা মানুষ খুন করবার ইচ্ছে হয় তোদের?

সাগর। এইটুকু? তোমার গায়ে হাত দেওয়াকে তুমি এইটুকু বল মা? তারাদাস ঠাকুরকেও আমরা মাপ করতে পারি, জনার্দন রায়কেও হয়ত পারি, কিন্তু সুবিধে পেলে জমিদারকে আমরা সহজে ছাড়ব না। (ক্ষণেক থামিয়া) কিন্তু ওরা যে সব বলাবলি করে মা, তুমি নাকি ওঁকেই সে-রাত্রে হাকিমের হাত থেকে রক্ষে করেছ? নাকি বলেছ, তোমাকে ধরে নিয়ে কেউ যায় নি, নিজে ইচ্ছে করেই গিয়েছিলে?

ষোড়শী। এমন ত হতে পারে সাগর, আমি সত্য কথাই বলেছিলাম।

সাগর। তাই ত বিষম খটকা লেগেছে মা, তোমার মুখ দিয়ে ত কখনো মিছে কথা বার হয় না। তবে এ কি! কিন্তু সে যাই হোক, যাই কেন না গ্রামসুদ্ধ লোকে বলে বেড়াক, আমরা ক’ ঘর ছোটজাত তোমার ভূমিজ প্রজারা তোমাকেই মা বলে জেনেছি; যদি চণ্ডীগড় ছেড়ে চলে যাও মা, আমরাও তোমার সঙ্গে যাব, কিন্তু যাবার আগে একবার জানিয়ে দিয়ে যাব যে কারা গেল!

[দ্রুতপদে প্রস্থান

ষোড়শী। সাগর! একটা কথা তোকে বলতে পারলেম না বাবা, তোদের দায়িত্ব হয়ত আর বইতে পারব না।

[এককড়ির প্রবেশ]

ষোড়শী। কে, এককড়ি?

এককড়ি। (সসম্ভ্রমে) আপনার কাছেই এলাম। হুজুর একবার আপনাকে স্মরণ করেছেন।

ষোড়শী। কোথায়?

এককড়ি। কাছারিতে বসে প্রজাদের নালিশ শুনছেন। যদি অনুমতি করেন ত পালকি আনতে পাঠাই।

ষোড়শী। পালকি? এটি তাঁর প্রস্তাব, না তোমার সুবিবেচনা এককড়ি?

এককড়ি। আজ্ঞে, আমি ত চাকর, এ স্বয়ং হুজুরের আদেশ।

ষোড়শী। (হাসিয়া) তোমার হুজুরের বিবেচনা আছে তা মানি, কিন্তু সম্প্রতি পালকি চড়বার আমার ফুরসত নেই
এককড়ি। হুজুরকে বলো আমার অনেক কাজ।

এককড়ি। ও-বেলায় কিংবা কাল সকালেও কি সময় হবে না?

ষোড়শী। না।

এককড়ি। কিন্তু হলে ভাল হতো। আরও দশজন প্রজার নালিশ আছে কিনা।

ষোড়শী। (কঠোর-স্বরে) তাঁকে বলো এককড়ি, বিচার করার মত বুদ্ধি থাকে ত তাঁর নিজের প্রজাদের করুন গে। আমি তাঁর প্রজা নই, আমার বিচার করবার জন্যে রাজার আদালত আছে।

[ষোড়শী দ্রুতপদে প্রস্থান করিল এবং এককড়ি কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে থাকিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেল। অপর দিক দিয়া হৈম ও নির্মল প্রবেশ করিল। হৈমর হাতে পূজার উপকরণ]

হৈম। যে দয়ালু লোকটি তোমাকে সেদিন অন্ধকার রাতে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলেন, সত্যি বল ত তিনি কে? তাঁকে আমি চিনেছি।

নির্মল। চিনেছ? কে বল ত তিনি?

হৈম। আমাদের ভৈরবী। কিন্তু তুমি তাঁকে পেলে কোথায়, তাই শুধু আমি ঠাউরে উঠতে পারিনি!

নির্মল। পারোনি? পেয়েছিলাম তাঁকে অনেক দূরে। তোমাদের ফকিরসাহেবের সম্বন্ধে অনেক আশ্চর্য কথা শুনে ভারী কৌতূহল হয়েছিল তাঁকে দেখবার। খুঁজে খুঁজে চলে গেলাম। নদীর পারে তাঁর আশ্রম, সেখানে গিয়ে দেখি তোমাদের ভৈরবী আছেন বসে।

হৈম। তার কারণ, ফকিরকে তিনি গুরুর মত ভক্তি-শ্রদ্ধা করেন। কিন্তু সত্যিই কি তোমাকে একেবারে হাত ধরে অন্ধকারে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেলেন?

নির্মল। সত্যিই তাই। যে মুহূর্তে তিনি নিশ্চয় বুঝলেন প্রচণ্ড ঝড়জলের মধ্যে ভয়ঙ্কর অন্ধকার অজানা পথে আমি অন্ধের সমান, নারী হয়েও তিনি অসঙ্কোচে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আমার হাত ধরে আসুন। কিন্তু পরের জন্য এ কাজ তুমি পারতে না হৈম।

হৈম। না।

নির্মল। তা জানি। (ক্ষণেক থামিয়া) দেখ হৈম, তোমাদের দেবীর এই ভৈরবীটিকে আমি চিনতে পারিনি সত্যি, কিন্তু এটুকু নিশ্চয় বুঝেচি এঁর সম্বন্ধে বিচার করার ঠিক সাধারণ নিয়ম খাটে না। হয়, সতীত্ব জিনিসটা এঁর কাছে নিতান্তই বাহুল্য বস্তু—তোমাদের মত তার যথার্থ রূপটা ইনি চেনেন না, না হয় সুনাম-দুর্নাম এঁকে স্পর্শ পর্যন্তও করতে পারে না।

হৈম। তুমি কি সেইদিনের জমিদারের ঘটনা মনে করেই এই-সব বলচ?

নির্মল। আশ্চর্য নয়। শাস্ত্রে বলে সাত পা একসঙ্গে গেলেই বন্ধুত্ব হয়। অতবড় পথটায় ওই দুর্ভেদ্য আঁধারে একমাত্র তাঁকেই আশ্রয় করে অনেক পা গুটিগুটি একসঙ্গে গেলাম, একটি একটি করে অনেক প্রশ্নই তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, কিন্তু পূর্বেও যে রহস্যে ঢাকা ছিলেন পরেও ঠিক তেমনি রহস্যেই গা ঢাকা দিয়ে মিলিয়ে গেলেন—কিছুই তাঁর হদিস পেলাম না।

হৈম। তোমার জেরাও মানলেন না, বন্ধুত্বও স্বীকার করলেন না?

নির্মল। না গো, না, কোনটাই না।

হৈম। (হাসিয়া ফেলিল) একটুও না? তোমার দিক থেকেও না?

নির্মল। এতবড় কথাটা কেবল ফাঁকি দিয়েই বার করে নিতে চাও নাকি? কিন্তু নিজেকে জানতেও যে দেরি লাগে হৈম।

হৈম। দেরি লাগুক তবু পুরুষের হয়। কিন্তু মেয়েমানুষের এমনি অভিশাপ, আমরণ নিজের অদৃষ্ট বুঝতেই তার কেটে যায়।

নির্মল। (হৈমর হাত ধরিয়া) তুমি কি পাগল হয়েছ হৈম? চল, আমরা একটু তাড়াতাড়ি যাই, হয়ত পূজোর বিলম্ব হয়ে যাবে।

[উভয়ের প্রস্থান

 

চতুর্থ দৃশ্য

নাটমন্দির

[গড়চণ্ডীর মন্দির ও সংলগ্ন প্রশস্ত অলিন্দ। সম্মুখে দীর্ঘ প্রাকারবেষ্টিত বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণ। প্রাঙ্গণে নাটমন্দিরের কিয়দংশ দেখা যাইতেছে। মন্দিরের দ্বার উন্মুক্ত। দক্ষিণদিকে প্রাঙ্গণে প্রবেশ করিবার পথ। সকালে কাঁচা রোদের আলো চারিদিকে পড়িয়াছে; মন্দিরের অলিন্দে ও প্রাঙ্গণে উপস্থিত জনার্দন রায়, শিরোমণি ঠাকুর, নির্মল বসু, ষোড়শী, হৈম এবং আরও কয়েকজন নরনারী]

শিরোমণি। (ষোড়শীকে) আজ হৈমবতী তাঁর পুত্রের কল্যাণে যে পূজা দিতেছেন তাতে তোমার কোন অধিকার থাকবে না, তাঁর এই সঙ্কল্প তিনি আমাদের জানিয়েছেন। তাঁর আশঙ্কা তোমাকে দিয়ে তাঁর কার্য সুসিদ্ধ হবে না।

ষোড়শী। (পাণ্ডুর-মুখে) বেশ, তাঁর কাজ যাতে সুসিদ্ধ হয় তিনি তাই করুন।

শিরোমণি। কেবল এইটুকুই ত নয়! আমরা গ্রামস্থ ভদ্রমণ্ডলী আজ স্থির-সিদ্ধান্তে উপস্থিত হয়েচি যে, দেবীর কাজ আর তোমাকে দিয়ে হবে না। মায়ের ভৈরবী তোমাকে রাখলে আর চলবে না। কে আছ, একবার তারাদাস ঠাকুরকে ডাক ত।

[একজন ডাকিতে গেল

ষোড়শী। কেন চলবে না?

জনৈক ব্যক্তি। সে তোমার বাবার মুখেই শুনতে পাবে।

জনার্দন। আগামী চৈত্রসংক্রান্তিতে নতুন ভৈরবীর অভিষেক হবে, আমরা স্থির করেছি।

[তারাদাস একটি দশ বছরের মেয়ে সঙ্গে করিয়া প্রবেশ করিল]

হৈম। (তারাদাসের দিকে চাহিয়া) যা সমস্ত শুনচি বাবা, তাতে কি ওঁর কথাই সত্যি বলে মেনে নিতে হবে?

জনার্দন। নয়ই বা কেন শুনি?

হৈম। (ছোট মেয়েটিকে দেখাইয়া) ঐটিকে যখন উনি যোগাড় করে এনেছেন তখন মিথ্যে বলা কি ওঁর এতই অসম্ভব? তা ছাড়া সত্যি মিথ্যে ত যাচাই করতে হয় বাবা, ও ত একতরফা রায় দেওয়া চলে না।

[সকলেই বিস্মিত হইল]

শিরোমণি। (স্মিতহাস্যে) বেটী কৌঁসুলীর গিন্নী কিনা, তাই জেরা ধরেচে! আচ্ছা, আমি দিচ্চি থামিয়ে, (হৈমকে) এটা দেবীর মন্দির—পীঠস্থান! বলি এটা ত মানিস?

হৈম। (ঘাড় নাড়িয়া) মানি বৈ কি!

শিরোমণি। তা যদি হয়, তা হলে তারাদাস বামুনের ছেলে হয়ে কি দেবমন্দিরে দাঁড়িয়ে মিছে কথা কইচে পাগলী? (প্রবল হাস্য করিলেন)

হৈম। আপনি নিজেও ত তাই শিরোমণিমশাই! অথচ এই দেবমন্দিরে দাঁড়িয়েই ত মিছে কথার বৃষ্টি করে গেলেন। আমি ত একবারও বলিনি ওঁকে দিয়ে কাজ করালে আমার সিদ্ধ হবে না।

[শিরোমণি হতবুদ্ধির মত হইলেন]

জনার্দন। (কুপিত হইয়া তীক্ষ্ণকণ্ঠে) বলনি কি রকম?

হৈম। না বাবা বলিনি। বলা দূরে থাক, ও-কথা আমি মনেও করিনে। বরঞ্চ ওঁকে দিয়েই আমি পূজো করাব, এতে ছেলের আমার কল্যাণই হোক, আর অকল্যাণই হোক। (ষোড়শীর প্রতি) চলুন মন্দিরের মধ্যে—আমাদের সময় বয়ে যাচ্চে।

জনার্দন। (ধৈর্য হারাইয়া অকস্মাৎ উঠিয়া দাঁড়াইয়া ভীষণ-কণ্ঠে) কখখনো না, আমি বেঁচে থাকতে ওকে কিছুতেই মন্দিরে ঢুকতে দেব না। তারাদাস, বল ত ওর মায়ের কথাটা! একবার শুনুক সবাই।

শিরোমণি। (সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়াইয়া উঠিয়া) না তারাদাস থাক। ওর কথা আপনার মেয়ে হয়ত বিশ্বাস করবে না রায়মশায়। ও-ই বলুক। চণ্ডীর দিকে মুখ করে ও-ই নিজের মায়ের কথা নিজে বলে যাক। কি বল চাটুয্যে? তুমি কি বল হে যোগেন ভট্‌চায? কেমন? ও-ই নিজে বলুক।

[ষোড়শীর মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল]

হৈম। আপনারা ওঁর বিচার করতে চান নিজেরাই করুন, কিন্তু ওঁর মায়ের কথা ওঁর নিজের মুখ দিয়ে কবুল করিয়ে নেবেন, এতবড় অন্যায় আমি কোনমতে হতে দেব না। (ষোড়শীর প্রতি) চলুন আপনি আমার সঙ্গে মন্দিরের মধ্যে—

ষোড়শী। না বোন, আমি পূজো করিনে, যিনি এ কাজ নিত্য করেন তিনিই করুন, আমি কেবল এইখানে দাঁড়িয়ে তোমার ছেলেকে আশীর্বাদ করি, সে যেন দীর্ঘজীবী হয়, নীরোগ হয়, মানুষ হয়! (পূজারীর প্রতি) কিন্তু—ছোট্‌ঠাকুরমশাই, তুমি ইতস্ততঃ করচ কিসের জন্যে? আমার আদেশ রইল দেবীর পূজা যথারীতি সেরে তুমি নিজের প্রাপ্য নিয়ো। বাকী মন্দিরের ভাঁড়ারে বন্ধ করে চাবি আমাকে পাঠিয়ে দিয়ো। (হৈমর প্রতি) আমি আবার আশীর্বাদ করে যাচ্চি, এতেই তোমার ছেলের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ হবে।

[ষোড়শী প্রাঙ্গণ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল এবং পুরোহিত পূজার জন্য মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন]

জনার্দন। (নির্মল ও হৈমর প্রতি) যাও মা তোমরাও পূজারী ঠাকুরের সঙ্গে যাও—পূজোটি যাতে সুসম্পন্ন হয় দেখো গে।

[নির্মল ও হৈম মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন]

জনার্দন। যাক বাঁচা গেছে শিরোমণিমশায়, ষোড়শী আপনিই চলে গেল। ছুঁড়ি জিদ করে যে আমার নাতির মানস-পূজাটি পণ্ড করে দিলে না এই ঢের।

শিরোমণি। এ যে হতেই হবে ভায়া, মা মহামায়ার মায়া কি কেউ রোধ করতে পারে? এ যে ওঁরই ইচ্ছে। (এই বলিয়া তিনি যুক্তকরে মন্দিরের উদ্দেশে প্রণাম করিলেন)

যোগেন ভট্‌চায। (গলা বাড়াইয়া দেখিয়া) অ্যাঁ, এ যে স্বয়ং হুজুর আসছেন।

[সকলেই ত্রস্ত এবং চকিত হইয়া উঠিল, জীবানন্দ ও তাঁহার পশ্চাতে কয়েকজন পাইক ও ভৃত্য প্রভৃতি প্রবেশ করিল]

শিরোমণি ও জনার্দন। আসুন, আসুন, আসুন।

[কেহ নমস্কার করিল, অনেকেই প্রণাম করিল]

জনার্দন। আমার পরম সৌভাগ্য যে আপনি এসেছেন। আজ আমার দৌহিত্রের কল্যাণে মায়ের পূজা দেওয়া হচ্চে।

জীবানন্দ। বটে? তাই বুঝি বাইরে এত জন-সমাগম?

[জনার্দন সবিনয়ে মুখ নত করিলেন]

শিরোমণি। হুজুরের দেহটি ভাল আছে?

জীবানন্দ। দেহ? (হাসিয়া) হাঁ, ভালই আছে। তাই ত আজ হঠাৎ বেরিয়ে পড়লাম। দেখি, বহুলোকে ভিড় করে এইদিকে আসচে। সঙ্গ নিলাম। অদৃষ্ট প্রসন্ন ছিল, দেবতা ব্রাহ্মণ এবং সাধু-সঙ্গ তিনটেই বরাতে জুটে গেল। কিন্তু রায়মশায়কে জানি, আপনাকে ত বেশ চিনতে পারলাম না ঠাকুর?

জনার্দন। ইনি সর্বেশ্বর শিরোমণি। প্রাচীন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। গ্রামের মাথা বললেই হয়।

জীবানন্দ। বটে? বেশ, বেশ, বড় আনন্দ লাভ করলাম। তা এইখানেই একটু বসা যাক না কেন।

[বসিতে উদ্যত হইলে সকলেই ব্যস্ত হইয়া উঠিল]

শিরোমণি। (চিৎকার করিয়া) আসন, আসন, বসবার একটা আসন নিয়ে এস কেউ—

জীবানন্দ। ব্যস্ত হবেন না শিরোমণিমশাই, আমি অতিশয় বিনয়ী লোক, সময়বিশেষে রাস্তায় শুয়ে পড়তেও অভিমান বোধ করিনে—এ ত ঠাকুরবাড়ি। বেশ বসা যাবে।

[জীবানন্দ উপবেশন করিলেন]

জনার্দন। একটা গুরুতর কার্যোপলক্ষে আমরা সবাই আপনার কাছে যাব স্থির করেছিলাম, শুধু আপনি পীড়িত মনে করেই যেতে পারিনি।

জীবানন্দ। গুরুতর কার্যোপলক্ষে?

শিরোমণি। হাঁ হুজুর, গুরুতর বৈ কি। ষোড়শী ভৈরবীকে আমরা কেউ চাইনে।

জীবানন্দ। চান না?

শিরোমণি। না, হুজুর।

জীবানন্দ। একটুখানি জনশ্রুতি আমার কানেতেও পৌঁছেচে। ভৈরবীর বিরুদ্ধে আপনাদের নালিশটা কি শুনি?

[সকলেই নীরব রহিল]

জীবানন্দ। বলতে কি আপনাদের করুণা বোধ হচ্ছে?

জনার্দন। হুজুর সর্বজ্ঞ, আমাদের অভিযোগ—

জীবানন্দ। কি অভিযোগ?

জনার্দন। আমরা গ্রামস্থ ষোল-আনা ইতর-ভদ্র একত্র হয়ে—

জীবানন্দ। (একটু হাসিল) তা দেখতে পাচ্ছি। (অঙ্গুলি-নির্দেশ করিয়া) ওইটি কি সেই ভৈরবীর বাপ তারাদাস ঠাকুর নয়?

[তারাদাস সাড়া দিল না, মাটিতে দৃষ্টি-নিবদ্ধ করিল]

শিরোমণি। (সবিনয়ে) রাজার কাছে প্রজা সন্তান-তুল্য, তা সে দোষ করলেও সন্তান, না করলেও সন্তান। আর কথাটা একরকম ওরই। ওর কন্যা ষোড়শীকে আমরা নিশ্চয় স্থির করেছি, তাকে আর মহাদেবীর ভৈরবী রাখা যেতে পারে না। আমার নিবেদন, হুজুর তাকে সেবায়েতের কাজ থেকে অব্যাহতি দেবার আদেশ করুন।

জীবানন্দ। (চকিত) কেন? তার অপরাধ?

দু’তিনজন ব্যক্তি। (সমস্বরে) অপরাধ অতিশয় গুরুতর।

জীবানন্দ। তিনি হঠাৎ এমন কি ভয়ানক দোষ করেছেন রায়মশায়, যার জন্যে তাঁকে তাড়ানো আবশ্যক!

[জনার্দন শিরোমণিকে বলিতে চোখের ইঙ্গিত করিল]

জীবানন্দ। না, না, উনি অনেক পরিশ্রম করেছেন, বুড়ো মানুষকে আর কষ্ট দিয়ে কাজ নেই, ব্যাপারটা আপনিই ব্যক্ত করুন।

জনার্দন। (চোখে ও মুখে দ্বিধা ও সঙ্কোচের ভাব আনিয়া) ব্রাহ্মণ-কন্যা—এ আদেশ আমাকে করবেন না।

জীবানন্দ। গো-ব্রাহ্মণে আপনার অচলা ভক্তির কথা এদিকে কারও অবিদিত নেই। কিন্তু এতগুলি ইতর-ভদ্রকে নিয়ে আপনি নিজে যখন উঠেপড়ে লেগেছেন, তখন ব্যাপার যে অতিশয় গুরুতর তা আমার বিশ্বাস হয়েছে। কিন্তু সেটা আপনার মুখ থেকেই শুনতে চাই।

জনার্দন। (শিরোমণির প্রতি ক্রুদ্ধদৃষ্টি হানিয়া) হুজুর যখন নিজে শুনতে চাচ্ছেন তখন আর ভয় কি ঠাকুর? নির্ভয়ে জানিয়ে দিন না।

শিরোমণি। (ব্যস্ত হইয়া) সত্যি কথায় ভয় কিসের জনার্দন? তারাদাসের মেয়েকে আর আমরা কেউ রাখব না হুজুর! তার স্বভাব-চরিত্র ভারী মন্দ হয়ে গেছে—এই আপনাকে আমরা জানিয়ে দিচ্ছি।

[জীবানন্দের পরিহাস-দীপ্ত প্রফুল্ল মুখ অকস্মাৎ গম্ভীর ও কঠিন হইয়া উঠিল]

জীবানন্দ। তাঁর স্বভাব-চরিত্র মন্দ হবার খবর আপনারা নিশ্চয় জেনেছেন?

[সকলে ঘাড় নাড়িল]

জীবানন্দ। তাই সুবিচারের আশায় বেছে বেছে একেবারে ভীষ্মদেবের শরণাপন্ন হয়েছেন রায়মশায়?

শিরোমণি। আপনি দেশের রাজা—সুবিচার বলুন, অবিচার বলুন, আপনাকেই করতে হবে। আমাদেরও তাই মাথা পেতে নিতে হবে। সমস্ত চণ্ডীগড় ত আপনারই।

জীবানন্দ। (মৃদু হাসিয়া) দেখুন শিরোমণিমশায়, অতি-বিনয়ে আপনাদেরও খুব হেঁট হয়ে কাজ নেই, অতি-গৌরবে আমাকেও আকাশে তোলবার প্রয়োজন নেই। আমি শুধু জানতে চাই, এ অভিযোগ কি সত্য?

[অনেকেই উত্তেজনায় চঞ্চল হইয়া উঠিল]

শিরোমণি। অভিযোগ? সত্য কিনা!—আচ্ছা, আমরা না হয় পর, কিন্তু তারাদাস, তুমিই বল ত। রাজদ্বার, যথাধর্ম বলো—

[তারাদাস একবার পাংশু একবার রাঙ্গা হইয়া উঠিতে লাগিল। জনার্দনের ক্রুদ্ধ একাগ্র দৃষ্টি খোঁচা মারিয়া যেন তাহাকে বারংবার তাড়না করিতে লাগিল। সে একবার ঢোঁক গিলিয়া একবার কণ্ঠের জড়িমা সাফ করিয়া অবশেষে মরিয়ার মত বলিয়া উঠিল]

তারাদাস। হুজুর—

জীবানন্দ। (হাত তুলিয়া তাহাকে থামাইয়া দিয়া) ওর মুখ থেকে ওর নিজের মেয়ের কলঙ্কের কথা আমি যথাধর্ম বললেও শুনব না। বরঞ্চ আপনাদের কেউ পারেন ত যথাধর্ম বলুন।

[ভৃত্য অন্তরালে ছিল, সে টম্‌ব্লার ভরিয়া হুইস্কি সোডা প্রভুর হাতে আনিয়া দিল। তিনি এক নিশ্বাসে পান করিয়া বেয়ারার হাতে ফিরাইয়া দিলেন]

জীবানন্দ। আঃ—বাঁচলাম। আপনাদের অজস্র বাক্য-সুধা পান করে তেষ্টায় বুক পর্যন্ত কাঠ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু চুপচাপ যে! কি হলো আপনাদের যথাধর্মের?

[শিরোমণি নাকে কাপড় দিয়াছিলেন]

জীবানন্দ। (সহাস্যে) শিরোমণিমশায় কি ঘ্রাণে অর্ধভোজনের কাজটা সেরে নিলেন নাকি?

[অনেকেই হাসিয়া মুখ ফিরাইল]

শিরোমণি। (হতবুদ্ধি হইয়া) এই যে বলি হুজুর। আমি যথাধর্মই বলব।

জীবানন্দ। (ঘাড় নাড়িয়া) সম্ভব বটে। আপনি শাস্ত্রজ্ঞ প্রবীণ ব্রাহ্মণ, কিন্তু একজন স্ত্রীলোকের নষ্ট-চরিত্রের কাহিনী তার অসাক্ষাতে বলার মধ্যে আপনার যথাটা যদিই বা থাকে, ধর্মটা থাকবে কি? আমার নিজের কোন বিশেষ আপত্তি নেই—ধর্মাধর্মের বালাই আমার বহুদিন ঘুচে গেছে—তবু আমি বলি, ওতে কাজ নেই। বরঞ্চ আমি যা জিজ্ঞাসা করি তার জবাব দিন। বর্তমান ভৈরবীকে আপনারা তাড়াতে চান—এই না?

সকলে। (মাথা নাড়িয়া) হাঁ, হাঁ।

জীবানন্দ। এঁকে নিয়ে আর সুবিধা হচ্ছে না?

জনার্দন। (প্রতিবাদের ভঙ্গীতে মাথা তুলিয়া) সুবিধে-অসুবিধে কি হুজুর, গ্রামের ভালর জন্যেই প্রয়োজন।

জীবানন্দ। (হাসিয়া ফেলিয়া) অর্থাৎ গ্রামের ভালমন্দের আলোচনা না তুলেও এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, আপনার ভালমন্দ কিছু একটা আছেই। তাড়াবার আমার ক্ষমতা আছে কিনা জানিনে, কিন্তু আপত্তি বিশেষ নেই। কিন্তু আর কোন একটা অজুহাত তৈরি করা যায় না? দেখুন না চেষ্টা করে। বরঞ্চ আমাদের এককড়িটিকেও না হয় সঙ্গে নিন, এ বিষয়ে তার বেশ একটু হাতযশ আছে।

[সকলে অবাক হইয়া রহিল]

জীবানন্দ। এঁদের সতীপনার কাহিনী অত্যন্ত প্রাচীন এবং প্রসিদ্ধ; সুতরাং তাকে আর নাড়াচাড়া করে কাজ নেই। ভৈরবী থাকলেই ভৈরব এসে জোটে এবং ভৈরবদেরও ভৈরবী নইলে চলে না, এ অতি সনাতন প্রথা—সহজে টলানো যাবে না। দেশসুদ্ধ ভক্তের দল চটে যাবে, হয়ত বা দেবী নিজেও খুশী হবেন না—একটা হাঙ্গামা বাধবে।মাতঙ্গী ভৈরবীর গোটা-পাঁচেক ভৈরব ছিল, এবং তাঁর পূর্বে যিনি ছিলেন তাঁর নাকি হাতে গোনা যেত না। কি বলেন, শিরোমণিমশাই, আপনি ত এ অঞ্চলের প্রাচীন ব্যক্তি, জানেন ত সব?

শিরোমণি। (শুষ্কমুখে জনান্তিকে) কি জানি, শুনেছি নাকি?

[প্রফুল্ল প্রবেশ করিল, তার হাতে ইংরিজি-বাংলা কয়েকখানা সংবাদপত্র ও কতকগুলো খোলা চিঠিপত্র]

জীবানন্দ। কিহে প্রফুল্ল, এখানেও ডাকঘর আছে নাকি? আঃ—কবে এইগুলো সব উঠে যাবে?

প্রফুল্ল। (ঘাড় নাড়িয়া) সে ঠিক। গেলে আপনার সুবিধে হতো। কিন্তু সে যখন হয়নি তখন এগুলো দেখবার কি এখন সময় হবে? অত্যন্ত জরুরি।

জীবানন্দ। তা বুঝেছি, নইলে এখানে আনবে কেন? কিন্তু দেখবার সময় আমার এখনও হবে না, অন্য সময়েও হবে না। কিন্তু ব্যাপারটা বাইরে থেকেই উপলব্ধি হচ্ছে। ওই যে হীরালাল-মোহনলালের দোকানের ছাপ। পত্রখানি তাঁর উকিলের, না একেবারে আদালতের হে? ও খামখানা ত দেখচি সলোমন সাহেবের। বাবা, বিলিতি সুধার গন্ধ যেন কাগজ ফুঁড়ে বার হচ্চে। কি বলেন সাহেব? ডিক্রি জারি করবেন, না এই রাজবপুখানি নিয়ে টানা-হেঁচড়া করবেন—জানাচ্চেন? আঃ—সেকালের ব্রাহ্মণ্যতেজ যদি কিছু বাকী থাকত ত এই ইহুদি ব্যাটাকে একেবারে ভস্ম করে দিতাম। মদের দেনা আর শুধতে হতো না।

প্রফুল্ল। (ব্যাকুল হইয়া) কি বলচেন দাদা? থাক, থাক, আর একসময়ে হবে। (ফিরিতে উদ্যত হইল)

জীবানন্দ। (সহাস্যে) আরে লজ্জা কি ভায়া, এঁরা সব আপনার লোক, জ্ঞাতগোষ্ঠী, এমন কি মণিমাণিক্যের এপিঠ-ওপিঠ বললেও অত্যুক্তি হয় না! তা ছাড়া তোমার দাদাটি যে কস্তুরী-মৃগ; সুগন্ধ আর কতকাল চেপে রাখবে ভাই? প্রফুল্ল, রাগ করো না ভায়া, আপনার বলতে আর কাউকে বড় বাকী রাখিনি, কিন্তু এই চল্লিশটা বছরের অভ্যাস ছাড়তে পারব বলেও ভরসা নেই, তার চেয়ে বরঞ্চ নোট-টোট জাল করতে পারে এমন যদি কাউকে যোগাড় করে আনতে পারতে হে—

প্রফুল্ল। (অত্যন্ত বিরক্ত হইয়াও হাসিয়া ফেলিয়া) দেখুন, সবাই আপনার কথা বুঝবে না। সত্য ভেবে যদি কেউ—

জীবানন্দ। (গম্ভীর হইয়া) সন্ধান করে নিয়ে আসেন? তা হলে ত বেঁচে যাই প্রফুল্ল। রায়মশায়, আপনি ত শুনি অতি বিচক্ষণ ব্যক্তি, আপনার জানাশুনা কি এমন কেউ—

জনার্দন। (ম্লানমুখে উঠিয়া) বেলা হলো যদি অনুমতি করেন ত—
জীবানন্দ। বসুন, বসুন, নইলে প্রফুল্লর জাঁক বেড়ে যাবে। তা ছাড়া ভৈরবীর কথাটা শেষ হয়ে যাক। কিন্তু আমি যাও বললেই কি সে যাবে?

জনার্দন। সে ভার আমাদের।

জীবানন্দ। কিন্তু আর কাউকে ত বাহাল করা চাই। ও ত খালি থাকতে পারে না।

অনেকে। সে ভারও আমাদের।

জীবানন্দ। যাক বাঁচা গেল, তবে সে যাবেই। এতগুলো মানুষের বিশ্বাসের ভার একা ভৈরবী কেন, স্বয়ং মা-চণ্ডীও সামলাতে পারেন না। আপনাদের লাভ-লোকসান আপনারাই জানেন, কিন্তু আমার এমন অবস্থা যে, টাকা পেলে আমার কিছুতেই আপত্তি নেই। নতুন বন্দোবস্তে আমার কিছু পাওয়া চাই। ভালো কথা, কেউ দেখ্‌ ত রে এককড়ি আছে না গেছে? কিন্তু গলাটা এদিকে যে মরুভূমি হয়ে গেল।

বেয়ারা। (প্রবেশ করিয়া প্রভুর ব্যগ্র-ব্যাকুল হস্তে পূর্ণপাত্র দিয়া) তিনি রান্নাবাড়ার ঘরগুলো দেখচেন।

জীবানন্দ। এর মধ্যেই? ডাক্‌ তাকে। (মদ্যপান)

[ইহার পর হইতে পূজার্থীরা মন্দিরে প্রবেশ করিতে লাগিল ও পূজা শেষ করিয়া বাহির হইয়া যাইতে লাগিল—তাদের সংখ্যা ক্রমশই বাড়িতে লাগিল। এককড়ি প্রবেশ করিল]

জীবানন্দ। আজ যে ভৈরবীকে তলব করেছিলাম, কেউ তাঁকে খবর দিয়েছিল?

এককড়ি। আমি নিজে গিয়েছিলাম।

জীবানন্দ। তিনি এসেছিলেন?

এককড়ি। আজ্ঞে না।

জীবানন্দ। না কেন? (এককড়ি অধোমুখে নীরব) তিনি কখন আসবেন, জানিয়েছেন?

এককড়ি। (তেমনি অধোমুখে) এত লোকের সামনে আমি সে কথা হুজুরে পেশ করতে পারব না।

জীবানন্দ। এককড়ি তোমার গোমস্তাগিরি কায়দাটা একটু ছাড়। তিনি আসবেন না,—না?

এককড়ি। না।

জীবানন্দ। কেন?

এককড়ি। তিনি আসতে পারবেন না। তিনি বললেন, তোমার হুজুরকে বলো এককড়ি, তাঁর বিচার করবার মত বিদ্যে-বুদ্ধি থাকে ত নিজের প্রজাদের করুন গে—আমার বিচার করবার জন্যে আদালত খোলা আছে।

জীবানন্দ। (অন্ধকার-মুখে) হুঁ। আচ্ছা তুমি যাও।

[এককড়ির প্রস্থান

জীবানন্দ। প্রফুল্ল, সেই যে চিনির কোম্পানির সঙ্গে হাজার বিঘে জমি বিক্রির কথা হয়েছিল, তার দলিল লেখা হয়েছে?

প্রফুল্ল। আজ্ঞে হয়েছে।

জীবানন্দ। এক্ষুণি তুমি গিয়ে সেটা পাকাপাকি কর গে। লিখে দাও জমি তারা পাবে।

প্রফুল্ল। তাই হবে।

[পূজার্থী ও পূজার্থিনীরা যাইতেছে আসিতেছে]

জীবানন্দ। আজ যে পূজার বড় ভিড় দেখছি। না, রোজই এইরকম?

জনার্দন। আজকের একটু বিশেষ আয়োজন ত আছেই, তা ছাড়া এই চড়কের সময়টায় কিছুদিন ধরে এমনিই হয়। লোকজনের ভিড় এখন বাড়তেই থাকবে।

জীবানন্দ। তাই নাকি? বেলা হলো এখন তা হলে আসি। (হাসিয়া) একটা মজা দেখেছেন রায়মশায়, চণ্ডীগড়ের লোকগুলো প্রায়ই ভুলে যায় যে, জমিদার এখন কালীমোহন নয়—জীবানন্দ চৌধুরী। অনেক প্রভেদ, না?

[জনার্দন কি যে জবাব দিবে ভাবিয়া পাইল না। শুধু তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল]

জীবানন্দ। এখানে বীজগাঁ’র প্রজা নয় এমন একটা প্রাণীও নেই। ঠিক না শিরোমণিমশায়?

শিরোমণি। তাতে আর সন্দেহ কি হুজুর!

জীবানন্দ। না, আমার সন্দেহ নেই, তবে আর কারও না সন্দেহ থাকে। আচ্ছা, নমস্কার শিরোমণিমশায়, চললাম। (হাসিয়া) কিন্তু ভৈরবী-বিদায়ের পালাটা শেষ করা চাই। প্রফুল্ল, যাওয়া যাক।

[প্রস্থান

শিরোমণি। (জমিদার সত্যই গেল কিনা উঁকি মারিয়া দেখিয়া) জনার্দন, কিরূপ মনে হয় ভায়া?

জনার্দন। মনে ত অনেক কিছুই হয়।

শিরোমণি। মহাপাপিষ্ঠ—লজ্জা-শরম আদৌ নেই।

জনার্দন। (গম্ভীরমুখে) না।

শিরোমণি। ভারী দুর্মুখ। মানীর মান-মর্যাদার জ্ঞান নেই।

জনার্দন। না।

শিরোমণি। কিন্তু দেখলে ভায়া কথার ভঙ্গী? সোজা না বাঁকা, সত্য না মিথ্যা, তামাশা না তিরস্কার, ভেবে পাওয়াই দায়। অর্ধেক কথা ত বোঝাই গেল না, যেন হেঁয়ালি। পাষণ্ড সত্যি বললে, না আমাদের বাঁদর নাচালে ঠিক ঠাহর করা গেল না। জানে সব, কি বল?

[জনার্দন নিরুত্তর]

শিরোমণি। যা ভাবা গিয়েছিল ব্যাটা হাবা-গোবা নয়—বিশেষ সুবিধে হবে না বলেই যেন শঙ্কা হচ্চে, না?

জনার্দন। মায়ের অভিরুচি।

শিরোমণি। তার আর কথা কি! কিন্তু ব্যাপারটা যেন খিচুড়ি পাকিয়ে গেল। না গেল একে ধরা, না গেল তাকে মারা। তোমার কি ভায়া, পয়সার জোর আছে, ছুঁড়ী যক্ষের মত আগলে আছে, গেলে সুমুখের বাগান-বেড়াটা তোমার টানা দিয়ে চৌকোস হতে পারবে।কিন্তু বাঘের গর্তের মুখে ফাঁদ পাততে গিয়ে না শেষে আমি মারা পড়ি।

জনার্দন। আপনি কি ভয় পেয়ে গেলেন নাকি?

শিরোমণি। না না, ভয় নয়,—কিন্তু তুমিও যে খুব ভরসা পেলে তা ত তোমারও মুখ দেখে অনুভব হচ্ছে না। হুজুরটি ত কানকাটা সেপাই—কথাও যেমন হেঁয়ালি, কাজও তেমনি অদ্ভুত। ও যে ধরে গলা টিপে মদ খাইয়ে দেয়নি এই আশ্চর্য। এককড়ির মুখে ভৈরবী ঠাকরুনের হুমকিও ত শুনলে? তোমরা চুপ করে ছিলে, আমিই মেলা কথা কয়েছি—ভাল করিনি। কি জানি, এককোড়ে ব্যাটা ভেতরে ভেতরে সব বলে দেয় নাকি। দুয়ের মাঝখানে পড়ে শেষকালে না বেড়াজালে ধরা পড়ি।

জনার্দন। (উদাস-কণ্ঠে) সকলই চণ্ডীর ইচ্ছে। বেলা হলো, সন্ধ্যের পর একবার আসবেন।

শিরোমণি। তা আসব। কিন্তু ঐ যে আবার এঁরা ফিরে আসচেন হে!

[মন্দির-প্রাঙ্গণের একটা দ্বার দিয়া ষোড়শী ও তাহার পশ্চাতে সাগর ও তাহার সঙ্গী প্রবেশ করিল। অন্য দ্বার দিয়া জীবানন্দ, প্রফুল্ল, ভৃত্য ও কয়েকজন পাইক প্রবেশ করিল]

জীবানন্দ। চলে যাচ্ছিলাম, শুধু তোমাকে আসতে দেখে ফিরে এলাম। এককড়িকে দিয়ে তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম এবং তারই মুখে তোমার জবাবও শুনলাম। তোমার বিরুদ্ধে রাজার আদালতে গিয়ে দাঁড়াবার বুদ্ধি আমার নেই, কিন্তু নিজের প্রজাদের শাসনে রাখবার বিদ্যেও জানি। সমস্ত গ্রামের প্রার্থনা-মত তোমার সম্বন্ধে কি আদেশ করেছি শুনেছ?

ষোড়শী। না।

জীবানন্দ। তোমাকে বিদায় করা হয়েছে। নতুন ভৈরবী করে, তাকে মন্দিরের ভার দেওয়া হবে। অভিষেকের দিনও স্থির হয়ে গেছে। তুমি রায়মশায় প্রভৃতির হাতে দেবীর সমস্ত অস্থাবর সম্পত্তি বুঝিয়ে দিয়ে আমার গোমস্তার হাতে সিন্দুকের চাবি দেবে। এ বিষয়ে তোমার কিছু বলবার আছে?

ষোড়শী। আমার বক্তব্যে আপনার কি কিছু প্রয়োজন আছে?

জীবানন্দ। না, নেই। তবে আজ সন্ধ্যার পরে এইখানেই একটা সভা হবে। ইচ্ছে কর ত দশের সামনে তোমার দুঃখ জানাতে পার। ভালো কথা, শুনতে পেলাম আমার বিরুদ্ধে আমার প্রজাদের নাকি তুমি বিদ্রোহী করে তোলবার চেষ্টা করচ?

ষোড়শী। তা জানিনে। তবে আমার নিজের প্রজাদের আপনার উপদ্রব থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছি।

জীবানন্দ। (অধর দংশন করিয়া) পারবে?

ষোড়শী। পারা না পারা মা-চণ্ডীর হাতে।

জীবানন্দ। তারা মরবে।

ষোড়শী। মানুষ অমর নয় সে তারা জানে।

[ক্রোধে ও অপমানে সকলের চোখ-মুখ আরক্ত হইয়া উঠিল। এককড়ি এমন ভাব দেখাইতে লাগিল যে সে কষ্টে আপনাকে সংযত করিয়া রাখিয়াছে]

জীবানন্দ। (একমুহূর্ত স্তব্ধ থাকিয়া) তোমার নিজের প্রজা আজ কেউ নাই। তারা যাঁর প্রজা তিনি নিজে দস্তখত করে দিয়েছেন। তাঁকে কেউ ঠেকাতে পারবে না।

ষোড়শী। (মুখ তুলিয়া) আপনার আর কোন হুকুম আছে? নেই? তা হলে দয়া করে এইবার আমার কথাটা শুনুন।

জীবানন্দ। বল।

ষোড়শী। আজ দেবীর অস্থাবর সম্পত্তির বুঝিয়ে দেবার সময় আমার নেই, এই সন্ধ্যায় মন্দিরের কোথাও সভা-সমিতির স্থানও হবে না। এগুলো এখন বন্ধ রাখতে হবে।

শিরোমণি। (সহসা চিৎকার করিয়া) কখনো না! কিছুতেই নয়! এ-সব চালাকি আমাদের কাছে খাটবে না বলে দিচ্চি—

[জীবানন্দ ছাড়া সকলেই ইহার প্রতিধ্বনি করিয়া উঠিল]

জনার্দন। (উষ্মার সহিত) তোমার সময় এবং মন্দিরের ভেতর জায়গা কেন হবে না শুনি ঠাকরুন?

ষোড়শী। (বিনীত-কণ্ঠে) আপনি ত জানেন রায়মশাই, এখন চড়কের উৎসব। যাত্রীর ভিড়, সন্ন্যাসীর ভিড়, আমারই বা সময় কোথায়, তাদেরই বা সরাই কোথায়?

জনার্দন। (আত্মবিস্মৃত হইয়া সগর্জনে) হতেই হবে! আমি বলচি হতে হবে!

ষোড়শী। (জীবানন্দকে) ঝগড়া করতে আমার ঘৃণা বোধ হয়। তবে ও-সব করবার এখন সুযোগ হবে না, এই কথাটা আপনার অনুচরদের বুঝিয়ে বলে দেবেন। আমার সময় অল্প; আপনাদের কাজ মিটে থাকে ত আমি চললাম।

জীবানন্দ। (তপ্তস্বরে) কিন্তু আমি হুকুম দিয়ে যাচ্ছি, আজই এ-সব হতে হবে এবং হওয়াই চাই।

ষোড়শী। জোর করে?

জীবানন্দ। হাঁ, জোর করে।

ষোড়শী। সুবিধে-অসুবিধে যাই-ই হোক?

জীবানন্দ। হাঁ, সুবিধে-অসুবিধে যাই-ই হোক।

ষোড়শী। (পিছনে চাহিয়া ভিড়ের মধ্যে সাগরকে অঙ্গুলি-সঙ্কেতে আহ্বান করিয়া) সাগর, তোদের সমস্ত ঠিক আছে?

সাগর। (সবিনয়ে) আছে মা, তোমার আশীর্বাদে অভাব কিছুই নেই।

ষোড়শী। বেশ। জমিদারের লোক আজ একটা হাঙ্গামা বাধাতে চায়, কিন্তু আমি তা চাইনে। এই গাজনের সময়টায় রক্তপাত হয় আমার ইচ্ছে নয়, কিন্তু দরকার হলে করতেই হবে। এই লোকগুলোকে তোরা দেখে রাখ্‌, এঁদের কেউ যেন আমার মন্দিরের ত্রিসীমানায় না আসতে পারে। হঠাৎ মারিস্‌ নে—শুধু বার করে দিবি।

[প্রস্থান

দ্বিতীয় অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

ষোড়শীর কুটীর

[সন্ধ্যা এইমাত্র উত্তীর্ণ হইয়াছে। গৃহের অভ্যন্তরে প্রদীপ জ্বলিতেছে। বাহিরে ষোড়শী উপবিষ্ট। এমনি সময়ে নির্মল ও হৈম প্রবেশ করিল। পিছনে ভৃত্য]

ষোড়শী। এস, এস, কিন্তু এ কি কাণ্ড! তোমাদের যে আজ দুপুরের গাড়িতে যাবার কথা ছিল?

[নির্মল ও হৈম নিকটে উপবেশন করিল]

হৈম। কথা ছিল, কিন্তু যাইনি। এঁকেও যেতে দিইনি। দিদির এই নতুন ঘরখানি চোখে দেখে না গেলে দুঃখ করতে হতো।

নির্মল। চোখে দেখে গিয়েও দুঃখ কম করতে হবে মনে হয় না।

হৈম। সে ঠিক। হয়ত চোখে না দেখলেই ছিল ভালো। এ ঘরের আর যা দোষ থাক, অপব্যয়ের অপবাদ শিরোমণিমশায় কেন, বোধ হয় আমার বাবাও দিতে পারেন না। কিন্তু এ পাগলামি কেন করতে গেলে দিদি, এ ঘরে ত তুমি থাকতে পারবে না!

ষোড়শী। এর চেয়েও কত খারাপ ঘরে কত মানুষকে ত থাকতে হয় ভাই।

হৈম। তা হলে সত্যিই কি তুমি সব ছেড়ে দেবে?

নির্মল। তা ছাড়া কি উপায় আছে বলতে পার? সমস্ত গ্রামের সঙ্গে ত একজন অসহায় স্ত্রীলোক দিবানিশি বিবাদ করে টিকতে পারে না।

হৈম। আমরা সমস্তই শুনেছি। তুমি সন্ন্যাসিনী, সবই তোমার সইবে, কিন্তু এর সঙ্গে যে মিথ্যে দুর্নাম লেগে রইল সেও কি সইবে দিদি?

ষোড়শী। দুর্নাম যদি মিথ্যেই হয় সইবে না কেন? হৈম, সংসারে মিথ্যে কথার অভাব নেই, কিন্তু সেই মিথ্যে কথার সঙ্গে ঝগড়া করে মিথ্যে কাজের সৃষ্টি করতে আমার লজ্জা করে বোন।

হৈম। দিদি, তুমি সন্ন্যাসিনী, তোমার সব কথা আমরা বুঝতে পারিনে, কিন্তু তোমাকে দেখে কি আমার মনে হয় জানো? আমার শ্বশুরকে কোন্‌ এক রাজা একখানি তলোয়ার খিলাত দিয়েছিলেন। খাপখানা তার ধূলো-বালিতে মলিন হয়ে গেছে, কিন্তু আসল জিনিসে কোথাও এতটুকু ময়লা ধরেনি। সে যেমন সোজা, তেমন খাঁটি, তেমনি কঠিন। তার কথা আমার তোমার পানে চাইলেই মনে পড়ে। মনে হয় দেশসুদ্ধ লোকে সবাই ভুল করেছে, আসল কথা কেউ কিছুই জানে না।

ষোড়শী। (হৈমর হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া) আজ তোমাদের কেন যাওয়া হলো না হৈম? বোধ হয় কাল যাওয়া হবে, না?

হৈম। আমার ছেলের কথা তুললেই রাগ কর, সে আর বলব না, কিন্তু ভয়ঙ্কর দুর্যোগের রাতে আমার এই অন্ধ মানুষটিকে যিনি হাতে ধরে নদী পার করে এনে নিঃশব্দে দিয়ে গেছেন, তাঁর পায়ের ধূলো না নিয়েই বা আমরা যাই কি করে? কিন্তু যাবার আগে এই কথাটি আজ দাও দিদি, আপনার লোকের যদি কখনো দরকার হয়, এই প্রবাসী বোনটিকে তখন ভুলো না।

হৈম। (ষোড়শীকে নীরব দেখিয়া) কথা দিতে বুঝি চাও না দিদি?

ষোড়শী। কথা দিলাম, ভুলব না। ভুলিওনি হৈম। আঘাত পেয়ে আজই তোমাকে একখানা চিঠি লিখছিলাম, ভেবেছিলাম, তুমি চলে গেলে সেখানা তোমাকে ডাকে পাঠিয়ে দেব। কিন্তু শেষ করতে পারলাম না, হঠাৎ মনে পড়ল এর জন্যে হয়ত তোমার বাবার সঙ্গেই শেষ পর্যন্ত বিবাদ বেধে যাবে।

হৈম। যেতেও পারে। কিন্তু আরও যে একটা মস্ত কথা আছে দিদি। আমার এই অন্ধ মানুষটিকে তুমি রক্ষে করেছ, তার চেয়ে বড় সংসারে ত আমার কিছুই নেই।

ষোড়শী। সত্যিই কিছু নেই হৈম?

হৈম। না, নেই। আর এই সত্যি কথাটিই বলে যাব বলে আজ যেতে পারিনি।

ষোড়শী। (হাসিয়া) কিন্তু এই ছোট্ট কথাটুকুর জন্যে ত একজনই যথেষ্ট ছিল ভাই, নির্মলবাবুকে ত অনায়াসে যেতে দিতে পারতে?

হৈম। এঁকে? একলা? হায়, হায়, দিদি, বাইরে থেকে তোমরা ভাব প্রচণ্ড ব্যারিস্টার, মস্তলোক। কিন্তু আমিই জানি শুধু এই বিনি-মাইনের দাসীটিকে পেয়েছিলেন বলেই উনি জগতে টিকে গেলেন। বাস্তবিক দিদি, পুরুষমানুষদের এই এক আশ্চর্য ব্যাপার। বাইরের দিকে যিনি যত বড়, যত দুর্দম, যত শক্তিমান, ভিতরের দিকে তিনি তেমনি অক্ষম, তেমনি দুর্বল, তেমনি অপটু। দরকারের সময় কোথায় হারাবে এঁদের কাগজপত্র, বার হবার সময়ে কোথায় যাবে জামা-কাপড়-পোশাক, রাস্তায় বেরিয়ে কোথায় ফেলবে পকেটের টাকাকড়ি—কোন্‌ ভরসায় একলা ছেড়ে দিই বল ত? (সহাস্যে) একটুখানি চোখের আড়াল করেছিলাম বলেই ত সেদিন অমন বিভ্রাট বাধিয়েছিলেন। ভাগ্যে তুমি ছিলে!

ভৃত্য। মা, কালকের মত আজও ঝড়-জল হতে পারে—মেঘ উঠেচে।

হৈম। আজ তা হলে উঠি। মেঘের জন্যে নয় দিদি, তোমার কাছ থেকে উঠতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু কাল সকালেই যাত্রা করতে হবে—আজ যেন আর কাজের অন্ত নেই। এঁকে নিয়ে পালিয়ে এসেছি, লুকিয়ে বাড়ি ঢুকতে হবে—বাবা না দেখতে পান। এতক্ষণে খোকা হয়ত ঘুম ভেঙ্গে বসে কাঁদচে, তাকে আবার দুধ খাইয়ে ঘুম পাড়াতে হবে, এঁর খাওয়া-দাওয়া আমি ছাড়া আর কেউ বোঝে না, আড়ালে থেকে সে ব্যবস্থা করতে হবে—তার পরে রেলগাড়িতে দীর্ঘ পথের সমস্ত আয়োজনই আমাকে নিজের হাতে করে নিতে হবে। কারও উপর নির্ভর করবার জো নেই। স্বামী, পুত্র, চাকর-বাকর—তার কত ঝঞ্ঝাট, কত ভার—আমার নিঃশ্বাস ফেলবারও সময় নেই দিদি।

ষোড়শী। এতে ত তোমার কষ্ট হয় বোন?

হৈম। (হাসিমুখে) তা হয়। তবু এই আশীর্বাদ আমাকে কর তুমি, যেন এই কষ্ট মাথায় নিয়েই একদিন যেতে পারি। আর ফিরে যদি আবার জন্ম নিতেই হয়, যেন এমনি কষ্টই বিধাতা আমার অদৃষ্টে লিখে দেন। সেদিনও যেন এমনি নিঃশ্বাস ফেলবারও অবকাশ না পাই।

ষোড়শী। তোমার কথাটা আমি বুঝেচি হৈম। এ যেন তোমার আনন্দের মধুচক্র। ভার যতই বাড়চে ততই এর রন্ধ্র মধুতে ভরে ভরে উঠচে। তাই হোক, এই আশীর্বাদই তোমাকে আজ করি।

হৈম। (সহসা পদধূলি লইয়া) তাই কর দিদি, মেয়েমানুষের জীবনের এর বড় আশীর্বাদ কি আছে!

নির্মল। আঃ, কি বকে যাচ্চো বল ত? আজ তোমার হলো কি?

হৈম। কি যে হয়েছে তুমি তার জানবে কি?

ষোড়শী। জানার শক্তিই আছে নাকি আপনাদের?

নির্মল। আপনাদের অর্থাৎ পুরুষদের ত? না, এতবড় কঠিন তত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করবার সাধ্য নেই আমাদের সে কথা মানি, কিন্তু আপনিই বা এ সত্য জানলেন কি করে?

হৈম। কেন? দেবীর ভৈরবী বলে? কিন্তু ভৈরবী কি নারী নয়? ওগো মশায়, এ তত্ত্ব আমাদের চেষ্টা করে শিখতে হয় না। আমাদের জন্মকালে বিধাতা স্বহস্তে তাঁর দুই হাত পূর্ণ করে আমাদের বুকের মধ্যে ঢেলে দেন। সে সম্পদের কাছে ইন্দ্রাণীর ঐশ্বর্যও কামনা করিনে এ কি সত্যি নয় দিদি?

ষোড়শী। সত্যি বৈ কি ভাই!

ভৃত্য। মা, মেঘ যে বেড়েই আসচে?

হৈম। এই যে উঠি বাবা। অনেক বাচালতা করে গেলাম দিদি, মাপ করো।

নির্মল। হৈমকে যে চিঠিখানা লিখেছিলেন তাঁর হাতে দিলে সময়ও বাঁচত, খরচও বাঁচত।

ষোড়শী। (হাসিয়া) না দিলেও বাঁচবে। হয়ত আর তার প্রয়োজনই হবে না।

নির্মল। ঈশ্বর করুন নাই যেন হয়, কিন্তু হলে আপনার প্রবাসী ভক্ত-দুটিকে বিস্মৃত হবেন না।

হৈম। আসি দিদি। (পদধূলি লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল) তোমার মুখের পানে চেয়ে আজ কত-কি যেন মনে হচ্চে দিদি! মনে হচ্চে, এমন যেন তোমাকে আর কখনো দেখিনি—যেন সহসা কোথায় কত দূরেই চলে গিয়েছ।

নির্মল। নমস্কার। প্রয়োজনে যেন ডাক পাই।

[সকলের প্রস্থান

ষোড়শী। হৈম, তুমি যেন আজ আমার কত যুগের চোখের ঠুলি খুলে দিয়ে গেলে বোন।—কে?

[সাগরের প্রবেশ]

সাগর। আমি সাগর।

ষোড়শী। তোদের আর সবাই? কাল যারা দল বেঁধে এসেছিল?

সাগর। আজও তারা তেমনি দল বেঁধেই গেছে হুজুরের কাছারি-বাড়িতে। আর বোধ হয় তোমারই বিরুদ্ধে—

ষোড়শী। বলিস কি সাগর? আমারই বিরুদ্ধে?

সাগর। আশ্চর্য হবার ত কিছু নেই মা! সর্বপ্রকার আপদে বিপদে চিরকাল তোমার কাছে এসে দাঁড়ানই সকলের অভ্যাস। প্রথমটা সেই অভ্যাসটাই বোধ হয় তারা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু আজ জমিদারের একটা চোখ-রাঙ্গানিতেই তাদের হুঁশ হয়েছে।

ষোড়শী। ভালো। কিন্তু সভাটা যে শুনেছিলাম মন্দিরে হবার কথা ছিল?

সাগর। কথাও ছিল, হুজুরের ভোজপুরীগুলোর ইচ্ছেও ছিল। কিন্তু গ্রামের কেউ রাজী হলেন না। তাঁরা ত এদিককার মানুষ—আমাদের খুড়ো-ভাইপোকে হয়ত চেনেন।

ষোড়শী। কি স্থির হলো সভাতে?

সাগর। তা সব ভালো। এই মঙ্গলবারেই মেয়েটার অভিষেক শেষ হবে। তোমারও ভাবনা নাই—কাশীবাসের বাবদে প্রার্থনা জানালে শ’খানেক টাকা পেতে পারবে।

ষোড়শী। প্রার্থনা জানাতে হবে বোধ করি হুজুরের কাছে?

সাগর। বোধ হয় তাই।

ষোড়শী। আচ্ছা, জমিজমা যাদের সমস্ত গেল, তাদের উপায় কি স্থির হলো?

সাগর। ভয় নেই মা, চিরকাল ধরে যা হয়ে আসচে তার অন্যথা হবে না।

ষোড়শী। আর তোদের?

সাগর। আমাদের খুড়ো-ভাইপোর? (একটু হাসিয়া) সে ব্যবস্থাও রায়মশায় করেছেন, নিতান্ত চুপ করে বসেছিলেন না। পাকা লোক, দারোগা পুলিশ মুঠোর মধ্যে, কোশ-দশেকের মধ্যে একটা ডাকাতি হতে যা দেরি।

ষোড়শী। (ভয় পাইয়া) হাঁরে, একি তোরা সত্যি বলে মনে করিস?

সাগর। মনে করি? এ ত চোখের উপর স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি মা। আমাদের জেলের বাইরে রাখতে পারে এ সাধ্য আর কারও নেই। (একটু থামিয়া) তা বলে যাদের জেল হবে না তাদের দুর্ভাগ্য কিছু কম নয় মা।

ষোড়শী। কেন রে?

সাগর। তাদের অবস্থা আমাদের চেয়েও মন্দ। জেলের মধ্যে খেতে দেয়, যা হোক আমরা দুটো খেতে পাব, কিন্তু এরা তাও পাবে না। রায়মশায়ের কাছে ধার করে জমিদারের সেলামি জুগিয়েছে, সেই খতগুলো সব ডিক্রি হতে যা বিলম্ব, তার পরে তাঁর নিজ জোতে জন খেটে দুমুঠো জোটে ভালো, না হয়—

ষোড়শী। না হয় কি?

সাগর। না হয় আসামের চা-বাগান আছেই। কেন মা, তোমারই কি মনে পড়ে না ওই বেলডাঙাটায় আগে আমাদের কত ঘর ভূমিজ বাউরির বস্‌তি ছিল?

ষোড়শী। (ঘাড় নাড়িয়া) পড়ে!

সাগর। আজ তারা কোথায়? কতক গেল কয়লা খুঁড়তে, কতক গেল চালান হয়ে চা-বাগানে। কিন্তু আমি দেখেচি ছেলেবেলায় তাদের জমিজমা, হাল-বলদ দু’মুঠো ধানের সংস্থান তাদের সবাইয়ের ছিল। আজ তাদের অর্ধেক এককড়ি নন্দীর, অর্ধেক রায়মশায়ের।

ষোড়শী। (স্তব্ধ থাকিয়া) আচ্ছা, সাগর, এ-সব তুই শুনলি কার মুখে?

সাগর। স্বয়ং হুজুরের মুখেই।

ষোড়শী। তা হলে এ-সকল তাঁরই মতলব?

সাগর। (চিন্তা করিয়া) কি জানি মা, কিন্তু মনে হয় রায়মশায়ও আছেন।

ষোড়শী। এ ত গেল তাদের কথা সাগর। কিন্তু আমি ত একা। জমিদার ইচ্ছে করলে ত আমারও প্রতি অত্যাচার করতে পারেন?

সাগর। তা জানিনে মা, শুধু জানি তুমি একা নও। (ক্ষণকাল নিঃশব্দে থাকিয়া) মা, আমাদের নিজের পরিচয় নিজে দিতে নেই, গুরুর নিষেধ আছে (বংশদণ্ড সজোরে মুষ্টিবদ্ধ করিয়া)—হরিহর সর্দারের ভাইপো সাগরের নাম দশ-বিশ ক্রোশের লোকে জানে—তোমার উপর অত্যাচার করবার মানুষ ত মা পঞ্চাশখানা গ্রামে কেউ খুঁজে পাবে না।

ষোড়শী। (দুই চক্ষু অকস্মাৎ জ্বলিয়া উঠিল) সাগর, এ কি সত্যি?

সাগর। (তৎক্ষণাৎ হেঁট হইয়া হাতের লাঠি ষোড়শীর পায়ের কাছে রাখিয়া) বেশ ত মা, সেই আশীর্বাদই কর না, যেন কথা আমার মিথ্যে না হয়।

ষোড়শী। (চোখের দৃষ্টি একবার একটুখানি কোমল হইয়া আবার তেমনি জ্বলিতে লাগিল) আচ্ছা সাগর, আমি ত শুনেচি তোদের প্রাণের ভয় করতে নেই?

সাগর। (সহাস্যে) মিথ্যে শুনেচ তাও ত আমি বলচি নে মা।

ষোড়শী। কেবল প্রাণ দিতেই পারিস, আর নিতে পারিস নে?

সাগর। পারিনে? এই আদেশের জন্য কত ভিক্ষেই না চাইলাম, কিন্তু কিছুতেই যে হুকুমটুকু তোমার মুখ থেকে বার করতে পারলাম না মা।

ষোড়শী। না সাগর, না। অমন কথা তোরা মুখেও আনিস নে বাবা।

সাগর। কিন্তু মন থেকে যে কথাটা তাড়াতে পারচি নে মা!

[পূজারী প্রবেশ করিল]
পূজারী। মন্দিরের দোর বন্ধ করে এলাম মা।

ষোড়শী। চাবি?

পূজারী। এই যে মা। (চাবির গোছা হাতে দিয়া) রাত হলো এখন তা হলে আসি?

ষোড়শী। এস, বাবা।

[পূজারীর প্রস্থান

ষোড়শী। সাগর, ফকিরসাহেব চলে গেছেন। তিনি কোথায় আছেন, খোঁজ নিয়ে আমাকে জানাতে পারিস বাবা?

সাগর। কেন মা?

ষোড়শী। তাঁকে আমার বড় প্রয়োজন। তোরা ছাড়া তাঁর চেয়ে শুভাকাঙ্ক্ষী আমার কেউ নেই।

সাগর। কিন্তু তোমার কাছেই ত কতবার শুনেছি তিনি সাধুপুরুষ। যেখানেই থাকুন তাঁকে যথার্থ মন দিয়ে ডাকলেই এসে উপস্থিত হন।

ষোড়শী। (চমকিয়া) তাই ত সাগর, এতবড় কথাটা আমি কি করে ভুলেছিলাম! আর আমার চিন্তা নেই, আমার এতবড় দুঃসময়ে তিনি না এসে কিছুতেই পারবেন না।

সাগর। আমারও বিশ্বাস তাই। কিন্তু কথায় কথায় রাত্রি অনেক হলো মা, তুমি বিশ্রাম কর, আসি?

ষোড়শী। এসো।

সাগর। (ঈষৎ হাসিয়া) ভয় নেই মা, সাগর তোমাকে একলা রেখে কোথাও বেশীক্ষণ থাকবে না।

[প্রস্থান

[তখন পর্যন্ত ষোড়শীর আহ্নিক প্রভৃতি নিত্যকার্য সমাধা হয় নাই, সে এই আয়োজনে ব্যাপৃত থাকিয়া]

ষোড়শী। সাগর আমাকে কতবড় কথাই না স্মরণ করিয়ে দিলে। ফকির-সাহেব! যেখানে থাকুন, এ বিপদে আপনার দেখা আমি পাবোই পাব।

নেপথ্যে। আসতে পারি কি?

ষোড়শী। (সচকিত উঠিয়া দাঁড়াইয়া ব্যাকুল-কণ্ঠে) আসুন, আসুন—আমি যে সমস্ত মন দিয়ে শুধু আপনাকেই ডাকছিলাম!

[জীবানন্দ প্রবেশ করিলেন]

জীবানন্দ। এতবড় পতিভক্তি কলিকালে দুর্লভ। আমার পাদ্য অর্ঘ্য আসনাদি কৈ?

ষোড়শী। (ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া, সভয়ে) আপনি? আপনি এসেছেন কেন?

জীবানন্দ। তোমাকে দেখতে। একটু ভয় পেয়েছ বোধ হচ্ছে। পাবারই কথা। কিন্তু চেঁচিও না। সঙ্গে পিস্তল আছে, তোমার ডাকাতের দল শুধু মারাই পড়বে, আর বিশেষ কিছু করতে পারবে না।

[ষোড়শী নির্বাক হইয়া রহিল]

জীবানন্দ। তবু, দোরটা বন্ধ করে একটু নিশ্চিন্ত হওয়া যাক। কি বল?

[এই বলিয়া জীবানন্দ অগ্রসর হইয়া দ্বার অর্গলবদ্ধ করিয়া দিলেন]

ষোড়শী। (ভয়ে কণ্ঠস্বর তাহার কাঁপিতেছিল) সাগর নেই—

জীবানন্দ। নেই? ব্যাটা গেল কোথায়?

ষোড়শী। আপনারা জানেন বলেই ত—

জীবানন্দ। জানি বলে? কিন্তু আপনারা কারা? আমি ত বাষ্পও জানতাম না।

ষোড়শী। নিরাশ্রয় বলেই ত লোক নিয়ে আমার প্রতি অত্যাচার করতে এসেছেন? কিন্তু আপনার কি করেছি আমি?

জীবানন্দ। লোক নিয়ে অত্যাচার করতে এসেছি? তোমার প্রতি? মাইরি না! বরঞ্চ মন কেমন করছিল বলে ছুটে দেখতে এসেছি।

[ষোড়শীর চোখে জল আসিতেছিল, এই উপহাসে তাহা একেবারে শুকাইয়া গেল। জীবানন্দ অদূরে বসিয়া তাহার আনত মুখের প্রতি লুব্ধ তৃষিত চক্ষে চাহিয়া রহিলেন]

জীবানন্দ। অলকা?

ষোড়শী। বলুন।

জীবানন্দ। তোমার এখানে তামাক-টামাকের ব্যবস্থা নেই বুঝি?

[ষোড়শী একবার মুখ তুলিয়াই অধোমুখে স্থির হইয়া রহিল]

জীবানন্দ। (দীর্ঘনিশ্বাস মোচন করিয়া) ব্রজেশ্বরের কপাল ভাল ছিল। দেবীরানী তাকে ধরিয়ে আনিয়েছিল সত্যি, কিন্তু অম্বুরী তামাকও খাইয়েছিল, এবং ভোজনান্তে দক্ষিণাও দিয়েছিল। বিদায়ের পালাটা আর তুলব না, বলি বঙ্কিমবাবুর বইখানা পড়েছ ত?

ষোড়শী। আপনাকে ধরে আনলে সেইমত ব্যবস্থাও থাকত—অনুযোগ করতে হত না।

জীবানন্দ। (হাসিয়া) তা বটে। টানা-হেঁচড়া দড়িদড়ার বাঁধাবাঁধিই মানুষের নজরে পড়ে। ভোজপুরী পেয়াদা পাঠিয়ে ধরে আনাটাই পাড়াসুদ্ধ সকলেই দেখে; কিন্তু যে পেয়াদাটিকে চোখে দেখা যায় না—হাঁ অলকা, তোমাদের শাস্ত্রগ্রন্থে তাঁকে কি বলে? অতনু, না? বেশ তিনি। (ক্ষণেক নীরব থাকিয়া) যৎসামান্য অনুরোধ ছিল; কিন্তু আজ উঠি। তোমার অনুচরগুলো সন্ধান পেলেই জামাই আদর করবে না। এমন কি শ্বশুরবাড়ি এসেছি বলে হয়ত বিশ্বাস করতেই চাইবে না—ভাববে প্রাণের দায়ে বুঝি মিথ্যেই বলচি।

[লজ্জায় ষোড়শী আরও অবনত হইল]

জীবানন্দ। তামাকের ধুঁয়া আপাততঃ পেটে না গেলেও চলত, কিন্তু ধুঁয়া নয় এমন কিছু একটা পেটে না গেলে আর ত দাঁড়াতে পারিনে। বাস্তবিক, নেই কিছু অলকা?

ষোড়শী। কিছু কি? মদ?

জীবানন্দ। (হাসিয়া মাথা নাড়িয়া) এবারে ভুল হলো। ওর জন্যে অন্য লোক আছে, সে তুমি নয়। তোমাকে বুঝতে পারার যথেষ্ট সুবিধে দিয়েছ—আর যা অপবাদ দিই, অস্পষ্টতার অপবাদ দিতে পারব না। অতএব তোমার কাছে যদি চাইতেই হয়, চাই এমন কিছু যা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, মরণের পথে ঠেলে দেয় না। ডাল, ভাত, মেঠাইমণ্ডা, চিঁড়ে, মুড়ি যা হোক দাও, আমি খেয়ে বাঁচি। নেই?

[ষোড়শী নির্নিমেষ-চক্ষে চাহিয়া রহিল]

জীবানন্দ। আজ সকালে মন ভাল ছিল না। শরীরের কথা তোলা বিড়ম্বনা, কারণ সুস্থদেহ যে কি আমি জানিনে। সকালে হঠাৎ নদীর তীরে বেরিয়ে পড়লাম, কত যে হাঁটলাম বলতে পারিনে—ফিরতে ইচ্ছেও হলো না। সূর্যদেব অস্ত গেলেন, একলা জলের ধারে দাঁড়িয়ে কি যে ভাল লাগল বলতে পারিনে। কেবল তোমাকে মনে পড়তে লাগল। মনে পড়ল আমার কাছারি-বাড়িতে এতক্ষণে লোক জমেছে—তোমাকে নির্বাসনে পাঠাবার ব্যবস্থাটা আজ শেষ করাই চাই। ফিরে এসে সভায় যোগ দিলাম, কিন্তু টিকতে পারলাম না। একটা ছুতো করে পালিয়ে এসে দাঁড়ালাম ওই মনসা গাছটার পিছনে।

ষোড়শী। তার পরে?

জীবানন্দ। দেখি দাঁড়িয়ে সাগর সর্দার এবং তুমি। আলাপ-আলোচনা সমস্তই কানে গেল, তাৎপর্য গ্রহণ করতেও বিলম্ব হলো না। ভাবলাম, আমাদের মত সাধু ব্যক্তিরা যে এ-হেন নির্বোধ ভৈরবীকে দূর করে দিতে চেয়েছে সে ঠিকই হয়েছে। সে-রাত্রি বাড়ি ঘেরাও করে পুলিশ পেয়াদা হাতকড়া নিয়ে হাজির, সামান্য একটা মুখের কথার জন্য স্বয়ং ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব পর্যন্ত কি পীড়াপীড়ি—আর তুমি বললে কিনা আমি নিজের ইচ্ছায় এসেছি। আর ছোট্ট একটুখানি হুকুমের জন্যে সাগরচাঁদের কত অনুনয়-বিনয়, কি সাধাসাধি—আর তুমি বলে বসলে কিনা অমন কথা মুখেও আনিস নে বাবা। অভিমানে বাবাজীবন মুখখানি ম্লান করে চলে গেলেন সে ত স্বচক্ষেই দেখলাম। মনে মনে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করে বললাম, জয় মা চণ্ডীগড়ের চণ্ডী! তোমার এই অধম সন্তানের প্রতি এত কৃপা না থাকলে কি আর এই মেয়েমানুষটির বার বার এমন করে বুদ্ধি লোপ কর! এখন একবার একে বিদায় করে আমাকে তক্তে বসাও মা, জনার্দন আর এককড়ি, এই দুই তাল-বেতালকে সঙ্গে নিয়ে আমি এমনি সেবা তোমার শুরু করে দেব যে, একদিনের পূজোর চোটে তোমার মাটির মূর্তি আহ্লাদে একেবারে পাথর হয়ে যাবে। কিন্তু ভক্তি-তত্ত্বের এ-সব বড় বড় কথা না হয় পরে ভাবা যাবে, কিন্তু এখন ক্ষিদের জ্বালায় যে আর দাঁড়াতে পারিনে। বাস্তবিক নেই কিছু অলকা?

ষোড়শী। কিন্তু বাড়ি গিয়ে ত অনায়াসে খেতে পারবেন।

জীবানন্দ। অর্থাৎ, আমার বাড়ির খবর আমার চেয়ে তুমি বেশি জানো। (এই বলিয়া সে একটুখানি হাসিল)

ষোড়শী। আপনি সারাদিন খাননি, আর বাড়িতে আপনার খাবার ব্যবস্থা নেই, এ কি কখনো হতে পারে?

জীবানন্দ। না পারবে কেন? আমি খাইনি বলে আর একজন উপোস করে থালা সাজিয়ে পথ চেয়ে থাকবে এ ব্যবস্থা ত করে রাখিনি। আজ খামকা রাগ করলে চলবে কেন অলকা? (বলিয়া সে তেমনি মৃদু হাসিল) আমার যে শান্তিময় জীবনযাত্রা সেদিন চোখে দেখে এসেছ সে বোধ হয় ভুলে গেছ। আজ তা হলে আসি?

ষোড়শী। (ব্যাকুল-কণ্ঠে) দেবীর সামান্য একটু প্রসাদ আছে, কিন্তু সে কি আপনি খেতে পারবেন?

জীবানন্দ। খুব পারব। কিন্তু সামান্য একটু প্রসাদ। কিন্তু সে ত নিশ্চয় তোমার নিজের জন্যে আনা অলকা?

ষোড়শী। নইলে কি আপনার জন্যে রেখেছি এই আপনি মনে করেন?

জীবানন্দ। (হাসিমুখে) না, তা করিনে, কিন্তু ভাবচি, তোমাকে ত বঞ্চিত করা হবে।

ষোড়শী। সে ভাবনার প্রয়োজন নেই। আমাকে বঞ্চিত করায় আপনার নূতন অপরাধ কিছু হবে না।

জীবানন্দ। না, অপরাধ আর আমার হয় না। একেবারে তার নাগালের বাইরে চলে গেছি। কিন্তু হঠাৎ একটা অদ্ভুত খেয়াল মনে উঠেছে অলকা, যদি না হাসো ত তোমাকে বলি।

ষোড়শী। বলুন।

জীবানন্দ। কি জানো, মনে হয়, হয়ত আজও বাঁচতে পারি, হয়ত আজও মানুষের মত—কিন্তু এমন কেউ নেই যে আমার—কিন্তু তুমিই পারো শুধু এই পাপিষ্ঠের ভার নিতে—নেবে অলকা?

ষোড়শী। কি বলচেন?

জীবানন্দ। (আত্মসমর্পণের আশ্চর্য কণ্ঠস্বরে) বলচি আমার সমস্ত ভার তুমি নাও অলকা।

ষোড়শী। (চমকিয়া, একমুহূর্ত থামিয়া) অর্থাৎ আমার যে কলঙ্কের বিচার করছেন, আমাকে দিয়ে তাকেই প্রতিষ্ঠিত করিয়ে নিতে চান। আমার মাকে ঠকাতে পেরেছিলেন, কিন্তু আমাকে পারবেন না।

জীবানন্দ। কিন্তু সে চেষ্টা ত আমি করিনি। তোমার বিচার করেচি, কিন্তু বিশ্বাস করিনি। কেবলি মনে হয়েছে, এই কঠোর আশ্চর্য রমণীকে অভিভূত করেছেন সে মানুষটি কে?

ষোড়শী। (আশ্চর্য হইয়া) তারা আপনার কাছে তার নাম বলেনি?

জীবানন্দ। না। আমি বার বার জিজ্ঞাসা করেচি, তারা বার বার চুপ করে গেছে। যাক, এবার আমি যাই; কি বল?

ষোড়শী। কিন্তু আপনার যে কি কাজের কথা ছিল?

জীবানন্দ। কাজের কথা? কিন্তু কি যে ছিল আমার আর মনে পড়চে না। শুধু এই কথাই মনে পড়চে, তোমার সঙ্গে কথা কহাই আমার কাজ। অলকা, তোমার কি সত্যিই আবার বিয়ে হয়েছিল?

ষোড়শী। আবার কিরকম? সত্যি বিয়ে আমার একবার মাত্রই হয়েছে।

জীবানন্দ। আর তোমার মা যে তোমাকে আমাকে দিয়েছিলেন সেটাই কি সত্যি নয়?

ষোড়শী। না, সে সত্যি নয়। মা আমার সঙ্গে যে টাকাটা দিয়েছিলেন আপনি তাই শুধু নিয়েছিলেন, আমাকে নেননি। ঠকানো ছাড়া তার মধ্যে লেশমাত্র সত্য কোথাও ছিল না।

জীবানন্দ। (কিছুক্ষণ ধ্যানমগ্নের মত বসিয়া; যেন কতদূর হইতে কথা কহিল) অলকা, এ কথা তোমার সত্য নয়।

ষোড়শী। কোন্ কথা?

জীবানন্দ। তুমি যা জেনে রেখেচ। ভেবেছিলাম সে কাহিনী কখনো কাউকে বলব না, কিন্তু সেই কাউকের মধ্যে আজ তোমাকে ফেলতে পারচি নে! তোমার মাকে ঠকিয়েছিলাম, কিন্তু ভগবান তোমাকে ঠকাবার সুযোগ আমাকে দেননি। আমার একটা অনুরোধ রাখবে?

ষোড়শী। বলুন?

জীবানন্দ। আমি সত্যবাদী নই; কিন্তু আজকের কথা আমার তুমি বিশ্বাস কর। তোমার মাকে আমি জানতাম, তাঁর মেয়েকে স্ত্রী বলে গ্রহণ করবার মতলব আমার ছিল না—ছিল কেবল তাঁর টাকাটাই লক্ষ্য। কিন্তু সে রাত্রে হাতে হাতে তোমাকে যখন পেলাম, তখন না বলে ফিরিয়ে দেওয়ার ইচ্ছেও আর হলো না।।

ষোড়শী। তবে কি ইচ্ছে হলো?

জীবানন্দ। থাক, সে তুমি আর শুনতে চেয়ো না। হয়ত শেষ পর্যন্ত শুনলে আপনিই বুঝবে, এবং সে বোঝায় ক্ষতি বৈ লাভ আমার হবে না। কিন্তু এরা তোমাকে যা বুঝিয়েছিল তা তাই নয়, আমি তোমাকে ফেলে পালাই নি।

ষোড়শী। আপনার না পালানোর ইতিবৃত্ত এখন ব্যক্ত করুন।

জীবানন্দ। আমি নির্বোধ নই, যদি ব্যক্তই করি, তার সমস্ত ফলাফল জেনেই করব। তোমার মায়ের এতবড় ভয়ানক প্রস্তাবেও কেন রাজি হয়েছিলাম জানো? একজন স্ত্রীলোকের হার আমি চুরি করি; ভেবেছিলাম টাকা দিয়ে তাকে শান্ত করব। সে শান্ত হলো, কিন্তু পুলিশের ওয়ারেন্ট শান্ত হলো না। ছ’মাস জেলে গেলাম—সেই যে শেষ রাত্রে বার হয়েছিলাম, আর ফেরবার অবকাশ হলো না।

ষোড়শী। (রুদ্ধ-নিশ্বাসে) তার পরে?

জীবানন্দ। (মৃদু হাসিয়া) তার পরেও মন্দ নয়। জীবানন্দবাবুর নামে আরও একটা ওয়ারেন্ট ছিল। মাস-কয়েক পূর্বে রেলগাড়িতে একজন বন্ধু সহযাত্রীর ব্যাগ নিয়ে তিনি অন্তর্হিত হন। অতএব আরও দেড় বৎসর। একুনে বছর-দুই নিরুদ্দেশের পর বীজগাঁয়ের ভাবী জমিদারবাবু যখন রঙ্গমঞ্চে পুনঃপ্রবেশ করলেন, তখন কোথায় বা অলকা আর কোথার বা তার মা! (দু’জনেই ক্ষণিক নিস্তব্ধ হইয়া রহিল) আর একবার সভায় যেতে হবে। অলকা, আসি তা হলে!

ষোড়শী। সভায় আপনার অনেক কাজ, না গেলেই নয়। কিন্তু কিছু না খেয়েও ত যেতে পারবেন না।

জীবানন্দ। পারব না? তা হলে আনো। কিন্তু মস্ত বদ অভ্যেস আমার, খেয়ে আর নড়তে পারিনে।

ষোড়শী। না পারেন এখানেই বিশ্রাম করবেন।

জীবানন্দ। বিশ্রাম করব! যদি ঘুমিয়ে পড়ি অলকা?

ষোড়শী। (হাসিয়া) সে সম্ভাবনা ত রইলই। কিন্তু পালাবেন না যেন! আমি খাবার নিয়ে আসি।

[প্রস্থান

[গৃহকোণে একখানা পত্রের খণ্ডাংশ পড়িয়া ছিল, জীবানন্দের দৃষ্টি পড়িতেই তাহা সে তুলিয়া লইয়া দীপালোকে পড়িয়া ফেলিল। তাহার মুহূর্তকাল পূর্বের সরস ও প্রফুল্ল মুখের চেহারা গম্ভীর ও অত্যন্ত কঠিন হইয়া উঠিল। ষোড়শী খাবারের পাত্র লইয়া প্রবেশ করিল। তাহার মনে পড়িল ঠাঁই করা হয় নাই, তাই সে পাত্রটি তাড়াতাড়ি একধারে রাখিয়া আসনের অভাবে কম্বলই পুরু করিয়া পাতিল এবং নিজের একখানি বস্ত্র পাট করিয়া দিতেছিল, এমনি সময়ে জীবানন্দ কথা কহিলেন।]

জীবানন্দ। ও কি হচ্ছে?

ষোড়শী। আপনার ঠাঁই করচি। শুধু কম্বলটা ফুটবে।

জীবানন্দ। ফুটবে, কিন্তু আতিশয্যটা ঢের বেশী ফুটবে। যত্ন জিনিসটায় মিষ্টি আছে সত্যি, কিন্তু তার ভান করাটায় না আছে মধু, না আছে স্বাদ। ওটা বরঞ্চ আর কাউকে দিয়ো।

[কথা শুনিয়া ষোড়শী বিস্ময়ে অবাক হইয়া গেল]

জীবানন্দ। (হাতের কাগজ দেখাইয়া) ছেঁড়া চিঠি—সবটুকু নেই। যাঁকে লিখেছিলে তাঁর নামটি শুনতে পাইনে?

ষোড়শী। কার নাম?

জীবানন্দ। যিনি দৈত্য-বধের জন্য চণ্ডীগড়ে অবতীর্ণ হবেন, যিনি দ্রৌপদীর সখা—আর বলবো?

[এই ব্যঙ্গোক্তির ষোড়শী উত্তর দিতে পারিল না, কিন্তু তাহার চোখের উপর হইতে ক্ষণকাল পূর্বের মোহের যবনিকা খানখান হইয়া ছিঁড়িয়া গেল]

জীবানন্দ। এই আহ্বান-লিপির প্রতি ছত্রটি যাঁর কর্ণে অমৃত বর্ষণ করবে তাঁর নামটি?

ষোড়শী। (আপনাকে সংযত করিয়া লইয়া) তাঁর নামে আপনার প্রয়োজন?

জীবানন্দ। প্রয়োজন আছে বৈ কি। পূর্বাহ্নে জানতে পারলে হয়ত আত্মরক্ষার একটা উপায় করতে পারি।

ষোড়শী। আত্মরক্ষার প্রয়োজন ত একা আপনারই নয় চৌধুরীমশায়। আমারও ত থাকতে পারে।

জীবানন্দ। পারে বৈ কি!

ষোড়শী। তা হলে সে নাম আপনি শুনতে পাবেন না। কারণ, আমার ও আপনার একই সঙ্গে রক্ষা পাবার উপায় নেই।

জীবানন্দ। বেশ, তা যদি না থাকে রক্ষা পাওয়াটা আমারই দরকার এবং তাতে লেশমাত্র ত্রুটি হবে না জেনো। (ষোড়শী নিরুত্তর) তুমি জবাব না দিতে পারো, কিন্তু তোমার এই বীরপুরুষটির নাম যে আমি জানিনে তা নয়।

ষোড়শী। জানবেন বৈ কি। পৃথিবীর বীরপুরুষদের মধ্যে পরিচয় থাকবারই ত কথা।

জীবানন্দ। সে ঠিক। কিন্তু এই কাপুরুষকে বার বার অপমান করার ভারটা তোমার বীরপুরুষটি সইতে পারলে হয়। যাক, এ চিঠি ছিঁড়লে কেন?

ষোড়শী। এর জবাব আমি দেব না। জীবানন্দ। কিন্তু সোজা নির্মল সাহেবকে না লিখে তাঁর স্ত্রীকে লেখা কেন? এ শব্দভেদী বাণ কি তাঁরই শেখানো নাকি?

ষোড়শী। তার পরে?

জীবানন্দ। তার পরে আজ আমার সন্দেহ গেল। বন্ধুর সংবাদ আমি অপরের কাছে শুনেচি, কিন্তু রায়মশায়কে যতই প্রশ্ন করেচি, ততই তিনি চুপ করে গেলেন। আজ বোঝা গেল তাঁর আক্রোশটাই সবচেয়ে কেন বেশি।

ষোড়শী। (সচকিত) নির্মলের সম্বন্ধে আপনি কি শুনেছেন?

জীবানন্দ। সমস্তই। তোমার চমক আর গলার মিঠে আওয়াজে আমার হাসি পাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু হাসতে পারলাম না—আমার আনন্দ করবার এ কথা নয়। সেই ঝড়-জল অন্ধকার রাত্রে একাকী তার হাত ধরে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া মনে পড়ে? তার সাক্ষী আছে। সাক্ষী ব্যাটারা যে কোথায় লুকিয়ে থাকে আগে থেকে কিছুই জানবার জো নেই। আমি যখন গাড়ি থেকে ব্যাগ নিয়ে পালাই, ভেবেছিলাম কেউ দেখেনি।

ষোড়শী। যদি সত্যই তাই করে থাকি সে কি এতবড় দোষের?

জীবানন্দ। কিন্তু গোপন করার চেষ্টাটা? এই চিঠির টুকরোটা? নিজেই একবার পড়ে দেখ ত কি মনে হয়? আমার মত ইনিও একবার তোমার বিচার করতে বসেছিলেন না?

দেখচি, তোমার বিচার করবার বিপদ আছে। (এই বলিয়া জীবানন্দ মুচকিয়া হাসিল। ষোড়শী নিরুত্তর) এ আমি সঙ্গে নিয়ে চললাম, আবশ্যক হলে যথাস্থানে পৌঁছে দেবার ত্রুটি হবে না। এই ক’টা ছত্র আমার পুরুষের চোখকেই যখন ফাঁকি দিতে পারেনি, তখন আশা করি হৈমকেও ঠকাতে পারবে না।

[ষোড়শী নিরুত্তর]

জীবানন্দ। কেমন, অনেক কথাই জানি?

ষোড়শী। হাঁ।

জীবানন্দ। এ-সব তবে সত্যি বল?

ষোড়শী। হাঁ, সত্যি।

জীবানন্দ। (আহত হইয়া) ওঃ—সত্যি! (স্তিমিত দীপশিখাটা উজ্জ্বল করিয়া দিয়া ষোড়শীর মুখের প্রতি তীক্ষ্ণচক্ষে চাহিয়া) এখন তাহলে তুমি কি করবে মনে কর?

ষোড়শী। কি আমাকে আপনি করতে বলেন?

জীবানন্দ। তোমাকে? (ক্ষণকাল স্তব্ধ থাকিয়া, দীপশিখা পুনরায় উজ্জ্বল করিয়া দিয়া) তা হলে এঁরা সকলে যে তোমাকে অসতী বলে—

ষোড়শী। এঁদের বিরুদ্ধে আপনার কাছে ত আমি নালিশ জানাই নি। আমাকে কি করতে হবে তাই বলুন। কারণ দেখাবার প্রয়োজন নেই।

জীবানন্দ। তা বটে। কিন্তু সবাই মিথ্যা কথা বলে, আর তুমি একাই সত্যবাদী এই কি আমাকে তুমি বোঝাতে চাও অলকা?

[ষোড়শী নিরুত্তর]

জীবানন্দ। একটা উত্তর দিতেও চাও না?

ষোড়শী। (মাথা নাড়িয়া) না।

জীবানন্দ। অর্থাৎ আমার কাছে কৈফিয়ত দেওয়ার চেয়ে দুর্নামও ভালো। বেশ, সমস্তই স্পষ্ট বোঝা গেছে! (এই বলিয়া তিনি ব্যঙ্গ করিয়া হাসিলেন)

ষোড়শী। স্পষ্ট বোঝা যাবার পরে কি করতে হবে তাই শুধু বলুন!

[তাহার এই উত্তরে জীবানন্দের ক্রোধ ও অধৈর্য শতগুণে বাড়িয়া গেল]

জীবানন্দ। কি করতে হবে সে তুমি জানো, কিন্তু আমাকে দেবমন্দিরের পবিত্রতা বাঁচাতেই হবে। এর যথার্থ অভিভাবক তুমি নয়, আমি। পূর্বে কি হতো জানিনে, কিন্তু এখন থেকে ভৈরবীকে ভৈরবীর মতই থাকতে হবে, না হয় তাকে যেতে হবে।

ষোড়শী। বেশ তাই হবে। যথার্থ অভিভাবক কে সে নিয়ে আমি বিবাদ করব না। আপনারা যদি মনে করেন আমি গেলে মন্দিরের ভালো হবে আমি যাব।

জীবানন্দ। তুমি যে যাবে সে ঠিক। কারণ, যাতে যাও সে আমি দেখব।

ষোড়শী। কেন রাগ করচেন, আমি ত সত্যিই যেতে চাচ্চি। কিন্তু আপনার ওপর এই ভার রইল যেন মন্দিরের যথার্থই ভাল হয়।

জীবানন্দ। কবে যাবে?

ষোড়শী। যখনই আদেশ করবেন। কাল, আজ, এখন—

জীবানন্দ। কিন্তু নির্মলবাবু? জামাইসাহেব?

ষোড়শী। (কাতর-কণ্ঠে) তাঁর নাম আর করবেন না।

জীবানন্দ। আমার মুখে তাঁর নামটা পর্যন্ত তোমার সহ্য হয় না। ভাল। কিন্তু কি তোমাকে দিতে হবে?

ষোড়শী। কিছুই না।

জীবানন্দ। এ ঘরখানা পর্যন্ত ছাড়তে হবে জানো? এও দেবীর।

ষোড়শী। জানি। যদি পারি, কালই ছেড়ে দেব।

জীবানন্দ। কোথায় যাবে ঠিক করেছ?

ষোড়শী। এখানে থাকব না, এর বেশি কিছুই ঠিক করিনি। একদিন কিছু না জেনেই আমি ভৈরবী হয়েছিলাম, আজ বিদায় নেওয়ার বেলাতেও এর বেশি ভাবব না। আপনি দেশের জমিদার, চণ্ডীগড়ের ভালোমন্দের ভার আপনার পরে রেখে যেতে শেষ সময়ে আর আমি দ্বিধা করব না। কিন্তু আমার বাবা ভারী দুর্বল, তাঁর উপরে নির্ভর করে যেন আপনি নিশ্চিন্ত হবেন না।

জীবানন্দ। তুমি কি সত্যিই চলে যেতে চাও নাকি?

ষোড়শী। আর আমার দুঃখী দরিদ্র ভূমিজ প্রজারা। একদিন তাদের সমস্তই ছিল—আজ তাদের মত নিঃস্ব নিরুপায় আর কেউ নেই। ডাকাত বলে বিনাদোষে লোকে তাদের জেল দিয়েছে। এদের সুখ-দুঃখের ভারও আমি আপনাকেই দিয়ে গেলাম।

জীবানন্দ। আচ্ছা, তা হবে হবে। কি তারা চায় বল ত?

ষোড়শী। সে তারাই আপনাকে জানাবে।

[এই বলিয়া সে সহসা জানালা দিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া দড়ির আলনা হইতে গামছা ও কাপড় হাতে লইল]

ষোড়শী। আমার স্নান করতে যাবার সময় হলো।

জীবানন্দ। স্নানের সময়? এই রাত্রে?

ষোড়শী। রাত আর নেই—এবার আপনি বাড়ি যান। (এই বলিয়া সে যাইতে উদ্যত হইল)

জীবানন্দ। (ব্যগ্রকণ্ঠে) কিন্তু আমার সকল কথাই যে বাকী রয়ে গেল?

ষোড়শী। থাক, আপনি বাড়ি যান।

জীবানন্দ। না। কোথায় যেন আমার মস্ত ভুল হয়ে গেছে অলকা, কথা আমার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি—

ষোড়শী। না সে হবে না, আপনি বাড়ি যান। আমার বহু ক্ষতিই করেছেন, এ জীবনের শেষ সর্বনাশ করতে আর আপনাকে দেব না।

জীবানন্দ। আচ্ছা, আমি চললাম অলকা।

[প্রস্থান]

দ্বিতীয় দৃশ্য

চণ্ডীগড় গ্রাম—গাজনের সঙ

গীত (১)

বড় প্যাঁচে পড়েছে এবার ভোলা দিগম্বর।
অভিমানী উমারানী বলেনি তায় প্রাণেশ্বর।।
অনেকদিনের পরে এবার এল শ্বশুরবাড়ি।
ভেবেছিল আসবে গৌরী পরে পাটের শাড়ী।।
চাঁদ-বদনে কইবে কথা
ঘুচবে ভোলার প্রাণের ব্যথা
কোন কথা না বলে সে পালিয়ে এল ছেড়ে ঘর।
ভাবের ঘোরে ছিল অচেতন
ভেবে চিন্তে পেল নাকো হলো এ কেমন—
এবার শান্ত-শিষ্ট গৃহবাসী
করবে তোমায় হে সন্ন্যাসী
জটা বাকল ছাড়িয়ে নিয়ে সাজিয়ে দেবে প্রেমের বর।।

গীত (২)

বৌ নিতে এসেছে এবার আপনি মহেশ্বর।
তুই নাকি সই বলেছিলি
করবি না আর স্বামীর ঘর।।
পাঁচ বছরে করে পঞ্চতপা
তোর হাতে তোর মা-জননী সঁপেছেন ক্ষ্যাপা,
বাঁধতে যদি পারিস নি তায়,
তাই বলে কি হবে সে পর?
(তাই বলে পর হয়ে কি যায়)
একবার নাকি গিয়েছিল কুচুনী পাড়ায়
সত্যি কথা তোর কাছে সই যদিই সে ভাঁড়ায়।
ফেলার জিনিস নয় ত সে তোর বোন
ধুয়ে পুঁছে তুল গে যা তারে ঘর।।

তৃতীয় দৃশ্য

ষোড়শীর কুটীর

[নির্মলের প্রবেশ]

ষোড়শী। এ কি, এই রাত্রে শেষে অকস্মাৎ আপনি যে নিমর্লবাবু?

[নির্মল নিরুত্তর]

(হাসিয়া) ওঃ—বুঝেচি। যাবার পূর্বে লুকিয়ে বুঝি একবার দেখে যেতে এলেন?

নির্মল। আপনি কি অন্তর্যামী?

ষোড়শী। তা নইলে কি ভৈরবীগিরি করা যায় নির্মলবাবু? কিন্তু এখানটায় তেমন আলো নেই, আসুন, আমার ঘরের মধ্যে গিয়ে বসবেন চলুন।

নির্মল। রাত্রে একাকী আমাকে ঘরের মধ্যে নিয়ে যেতে চান, আপনার সাহস ত কম নয়?

ষোড়শী। আর সে-রাত্রে অন্ধকারে যখন হাত ধরে নদী পার করে এনেছিলাম তখনি কি ভয়ের লক্ষণ দেখতে পেয়েছিলেন নাকি? সেদিনও ত এমনি একাকী।

নির্মল। সত্যই আপনার সাহসের অবধি নেই।

ষোড়শী। অবধি থাকবে কি করে নির্মলবাবু, ভৈরবী যে! আসুন ঘরে।

নির্মল। না, ঘরে আর যাব না, আমাকে এখনি ফিরতে হবে।

ষোড়শী। তবে এইখানেই বসুন।

[উভয়ের উপবেশন]

ষোড়শী। আজ তা হলে চলে যাওয়াই স্থির?

নির্মল। না, আজ যাওয়া স্থগিত রইল। রাত্রে ফিরে গিয়ে শুনতে পেলাম আজ সন্ধ্যাবেলায় মন্দিরের মধ্যে আপনার বিচার হবে। সে সভায় আমি উপস্থিত থাকতে চাই।

ষোড়শী। কিসের জন্যে? নিছক কৌতূহল, না আমাকে রক্ষে করতে চান?

নির্মল। প্রাণপণে চেষ্টা করব বটে।

ষোড়শী। যদি ক্ষতি হয়, কষ্ট হয়, শ্বশুরের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়, তবুও?

নির্মল। হাঁ, তবুও।

[ষোড়শী হাসিয়া ফেলিল]

(হাসিমুখে) আপনি হাসলেন যে বড়? বিশ্বাস হয় না?

ষোড়শী। হয়। কিন্তু হাসচি আর একটা কথা ভেবে। শুনি, আগেকার দিনে ভৈরবীরা নাকি বিদেশী মানুষদের ভেড়া বানিয়ে রাখত, আচ্ছা, ভেড়া নিয়ে তারা কি করত নির্মলবাবু? চরিয়ে বেড়াত, না লড়াই বাধিয়ে দিয়ে তামাশা দেখত? (বলিতে বলিতে ছেলেমানুষের মত উচ্ছ্বসিত হইয়া হাসিতে লাগিল)

নির্মল। (পরিহাসে যোগ দিয়া, নিজেও হাসিয়া) হয়ত বা মাঝে মাঝে মায়ের স্থানে বলি দিয়ে খেতো।

ষোড়শী। সে ত ভয়ের কথা নির্মলবাবু।

নির্মল। (সহাস্যে মাথা নাড়িয়া) ভয় একটু আছে বৈ কি!

ষোড়শী। একটু থাকা ভালো। হৈমকে সাবধান করে দেওয়া উচিত।

নির্মল। তার মানে?

ষোড়শী। মানে কি সব কথারই থাকে নাকি? (হাসিয়া) কুটুমের অভ্যর্থনা ত হলো। অবশ্য হাসি-খুশী দিয়ে যতটুকু পারি ততটুকু, —তার বেশী ত সম্বল নেই ভাই—এখন আসুন দুটো কাজের কথা কওয়া যাক।

নির্মল। বলুন।

ষোড়শী। (গম্ভীর হইয়া) দুটি লোক দেবতাকে বঞ্চিত করতে চায়। একটি রায়মশায় আর একটি জমিদার—

নির্মল। আর একটি আপনার বাবা।

ষোড়শী। বাবা? হাঁ, তিনিও বটে!

নির্মল। আমার শ্বশুরের কথা বুঝি, আপনার বাবার কথাও কতক বুঝতে পারি, কিন্তু পারিনে এই জমিদার প্রভুটিকে বুঝতে। তিনি কিসের জন্য আপনার শত্রুতা করচেন?

ষোড়শী। দেবীর অনেকখানি জমি তিনি নিজের বলে বিক্রি করে ফেলতে চান। কিন্তু আমি থাকতে ত কোনমতেই হবার জো নেই।

নির্মল। (সহাস্যে) সে আমি সামলাতে পারব।

ষোড়শী। কিন্তু আরও অনেক জিনিস আছে, যা আপনিও হয়ত সামলাতে পারবেন না।

নির্মল। কি সে-সব? একটা ত আপনার মিথ্যে দুর্নাম?

ষোড়শী। (শান্তস্বরে) সে আমি ভাবিনে। দুর্নাম সত্য হোক মিথ্যে হোক, তাই নিয়েই ত ভৈরবীর জীবন নির্মলবাবু। আমি এই কথাটাই তাঁদের বলতে চাই।

নির্মল। (সবিস্ময়ে) নিজের মুখ দিয়ে এ কথা যে স্বীকার করার সমান!

ষোড়শী। তা হবে।

নির্মল। কিন্তু ওরা যে বলে—অনেকেই বলে সে সময়ে, অর্থাৎ ম্যাজিস্ট্রেটের আসার রাত্রে আপনার কোলের উপরেই নাকি—

ষোড়শী। তারা কি দেখেছিল নাকি? তা হবে, আমার ঠিক মনে নেই; যদি দেখে থাকে সে সত্যি। তাঁর সেদিন ভারী অসুখ, আমার কোলে মাথা রেখেই তিনি শুয়েছিলেন।

নির্মল। (ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া) তার পরে?

ষোড়শী। কোনমতে দিন কেটে যাচ্ছে, কিন্তু সেদিন থেকেই কিছুতে আর মন বসাতে পারিনে, সবই যেন মিথ্যে বলে ঠেকেছে।

নির্মল। কি মিথ্যে?

ষোড়শী। সব। ধর্ম, কর্ম, ব্রত, উপবাস, দেবসেবা, এতদিনের যা-কিছু সমস্তই—

নির্মল। তবে কিসের জন্যে ভৈরবীর আসন রাখতে চান?

ষোড়শী। এমনিই। আর আপনি যদি বলেন এতে কাজ নেই—

নির্মল। না না, আমি কিছুই বলিনে। কিন্তু এখন আমি উঠলাম। আপনার হয়ত কত কাজ নষ্ট করলাম।

ষোড়শী। কুটুম্বের অভ্যর্থনা, বন্ধুর মর্যাদা রক্ষা করা, এ কি কাজ নয় নির্মলবাবু?

নির্মল। সকাল হলো, এখন আসি?

ষোড়শী। আসুন। আমারও স্নানের সময় উত্তীর্ণ হয়ে যায়, আমিও চললাম।

[উভয়ের প্রস্থান

[সাগর সর্দার ও ফকিরসাহেবের প্রবেশ]

সাগর। না, এ চলবে না—কোনমতেই চলবে না ফকিরসাহেব। মা নাকি বলেচেন সমস্ত ত্যাগ করে যাবেন। আপনাকে বলচি এ চলবে না।

ফকির। কেন চলবে না সাগর?

সাগর। তা জানিনে। কিন্তু যাওয়া চলবে না। গেলে আমরা তাঁর দীন-দুঃখী প্রজারা সব থাকব কোথায়? বাঁচব কি করে?

ফকির। কিন্তু তোমরা কি শোননি ষোড়শী কত বড় লজ্জা এবং ঘৃণায় সমস্ত ত্যাগ করে যাচ্ছেন?

সাগর। শুনেচি। তাই আরও দশজনের মত আমরাও ভেবে পাইনি কিসের জন্য মা সাহেবের হাত থেকে সে রাত্রে জমিদারকে বাঁচাতে গেলেন। (ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া) ভেবে নাই পেলাম ফকিরসাহেব, কিন্তু এটুকু ত ভেবে পেয়েছি, যাঁকে মা বলে ডেকেছি সন্তান হয়ে আমরা তাঁর বিচার করতে যাব না।

ফকির। তোমরা জন-কতক বিচার না করলেই কি চণ্ডীগড়ে তার বিচার করবার মানুষের অভাব হবে সাগর?

সাগর। কিন্তু তারাই কি মানুষ? আমরা তাঁর ছেলে—আমাদের অন্তরের বিশ্বাসের চেয়ে কি তাদের বাইরের বিচারটাই বড় হবে ফকিরসাহেব? তাদের কি আমরা চিনিনে? একদিন যখন আমাদের সর্বস্ব কেড়ে নিলে তারা, সেও যেমন সত্যি-পাওনার দাবীতে, আবার জেলে যখন দিলে সেও তেমনি সত্যি-সাক্ষীর জোরে।

ফকির। সে আমি জানি।

সাগর। কিন্তু সব কথা ত জানো না। খুড়ো-ভাইপোয় জেল খেটে ফিরে এসে দাঁড়ালাম। বললাম, মা, আমরা যে মরি। মা রাগ করে বললেন, তোরা ডাকাত, তোদের মরাই ভালো। অভিমানে ঘরে ফিরে গেলাম। খুড়ো বললে, ভগবান! গরীবকে বিশ্বাস করতে কেউ নেই। পরের দিন সকালবেলা মা আমাদের ডেকে পাঠিয়ে বললেন, তোদের কাছে আমি মস্ত অপরাধ করেছি বাবা, আমাকে তোরা ক্ষমা কর্‌। তোদের কেউ বিশ্বাস না করুক আমি বিশ্বাস করব। এখনো বিঘে-কুড়ি জমি আমার আছে, তাই তোরা ভাগ করে নে। চণ্ডীর খাজনা তোরা যা ইচ্ছে দিস, কিন্তু অসৎ পথে কখনো পা দিবিনে, এই আমার শর্ত।

ফকির। কিন্তু লোকে যে বলে—

সাগর। বলুক। কিন্তু মা জানলেই হলো সে বিশ্বাস আমরা কখনো ভাঙ্গিনি। জানো ফকিরসাহেব, আমাদের জন্যেই এককড়ি তাঁর শত্রু, আমাদের জন্যেই রায়মশায় তাঁর দুশমন। অথচ, তারা জানেও না কার দয়ায় আজও তারা বেঁচে আছে।

ফকির। কিন্তু আমাকে তোরা ধরে আনলি কেন?

সাগর। কেন? শুনেছি, মুসলমান হয়েও তুমি তাঁর গুরুর চেয়ে বড়, তোমার নিষেধ ছাড়া মাকে কেউ আটকাতে পারবে না।

ফকির। কিন্তু এতবড় অন্যায় নিষেধ আমি কিসের জন্যে করব সাগর?

সাগর। করবে মানুষের ভালর জন্যে।

ফকির। কিন্তু ষোড়শী ঘরে নেই। বেলা যায়, আমিও ত আর অপেক্ষা করতে পারি নে। এখন আমি চললুম।

সাগর। পারবে না থাকতে? করবে না নিষেধ? কিন্তু ফল তার ভাল হবে না।

ফকির। এ-সব কথা মুখেও এনো না সাগর।

সাগর। মা-ও বলেন ও-কথা মুখে আনিস নে সাগর। বেশ মুখে আর আনব না—আমাদের মনের মধ্যেই থাক।

[ফকিরের প্রস্থান

সাগর। সন্ন্যাসী ফকির তুমি, জানো না ডাকাতের বুকের জ্বালা। আমাদের সব গেছে, এর ওপর মা-ও যদি ছেড়ে যায় আমরা বাকী কিছুই রাখব না।

[প্রস্থান
[নির্মল ও ষোড়শীর প্রবেশ]

ষোড়শী। ডেকে নিয়ে এলাম সাধে! ছি, ছি, কি দাঁড়িয়ে যা তা শুনছিলেন বলুন ত! দেবীর মন্দিরে, তার উঠানের মাঝখানে জটলা করে কতকগুলো কাপুরুষ মিলে বিচারের ছলনায় দুজন অসহায় স্ত্রীলোকের কুৎসা রটনা করচে, —তাও আবার একজন মৃত, আর একজন অনুপস্থিত। আসুন আমার ঘরে।

[দুয়ারে আসন পাতা ছিল, নির্মলকে সমাদর করিয়া তাহাতে বসাইয়া ষোড়শী নিজে অদূরে উপবেশন করিল]

ষোড়শী। আপনি নাকি বলেছেন আমার মামলা-মকদ্দমার সমস্ত ভার নেবেন। এ কি সত্যি?

নির্মল। হাঁ, সত্যি।

ষোড়শী। কিন্তু কেন নেবেন?

নির্মল। বোধ হয় আপনার প্রতি অত্যাচার হচ্চে বলে।

ষোড়শী। কিন্তু আর কিছু বোধ করেন না ত? (এই বলিয়া সে মুচকিয়া হাসিল) থাক, সব কথার যে জবাব দিতেই হবে এমন কিছু শাস্ত্রের অনুশাসন নেই। বিশেষ করে এই কূট-কচালে শাস্ত্রের, না? আচ্ছা সে যাক। মকদ্দমার ভার যেন নিলেন, কিন্তু যদি হারি তখন ভার কে নেবে? তখন পেছোবেন না ত?

নির্মল। না, তখনও না।

ষোড়শী। ইস! পরোপকারের কি ঘটা! (হাসিয়া) আমি কিন্তু হৈম হলে এইসব পরোপকার-বৃত্তি ঘুচিয়ে দিতাম। অত ভালমানুষই নই—আমার কাছে ফাঁকি চলত না। রাত্রি-দিন চোখে চোখে রেখে দিতাম।

নির্মল। (বিস্ময়ে, ভয়ে, আনন্দে) চোখে চোখে রাখলেই কি রাখা যায় ষোড়শী? এর বাঁধন যেখানে শুরু হয় চোখের দৃষ্টি যে সেখানে পৌঁছায় না, এ কথা কি আজও জানতে পারনি তুমি।

ষোড়শী। পেরেছি বৈ কি। (হাসিল; বাহিরের শব্দ শুনিয়া গলা বাড়াইয়া চাহিয়া) এই যে ইনি এসেছেন।

নির্মল। কে? ফকিরসাহেব?

ষোড়শী। না, জমিদারবাবু। বলেছিলাম সভা ভাঙলে যাবার পথে আমার কুঁড়েতে একবার একটু পদধূলি দিতে। তাই দিতেই বোধ হয় আসচেন।

নির্মল। (বিরক্তি ও সঙ্কোচে আড়ষ্ট হইয়া) তা হলে আপনি আমাকে এ কথা বলেন নি কেন?

ষোড়শী। বেশ! একবার ‘তুমি’ একবার ‘আপনি’! (হাসিয়া) ভয় নেই, উনি ভারী ভদ্রলোক; লড়াই করেন না। তা ছাড়া আপনাদের পরিচয় নেই; সেটাও একটা লাভ। (দ্বারের নিকটে অগ্রসর হইয়া অভ্যর্থনা করিয়া) আসুন।

জীবানন্দ। (প্রবেশ করিয়াই থমকিয়া দাঁড়াইয়া) ইনি? নির্মলবাবু বোধ হয়।

ষোড়শী। হাঁ, আপনার বন্ধু বলে পরিচয় দিলে খুব সম্ভব অতিশয়োক্তি হবে না।

জীবানন্দ। (হাসিয়া) বিলক্ষণ! বন্ধু নয় ত কি? ওঁদের কৃপাতেই ত টিকে আছি, নইলে মামার জমিদারি পাওয়া পর্যন্ত যে-সব কীর্তি করা গেছে তাতে চণ্ডীগড়ের শান্তিকুঞ্জের বদলে ত এতদিন আন্দামানের শ্রীঘরে গিয়ে বসবাস করতে হতো।

ষোড়শী। চৌধুরীমশাই, উকিল-ব্যারিস্টার বড়লোক বলে বাহবাটা কি একা ওঁরাই পাবেন। আন্দামান প্রভৃতি বড় ব্যাপারে না হোক, কিন্তু ছোটো বলে এদেশের শ্রীঘরগুলোও ত মনোরম স্থান নয়—দুঃখী বলে ভৈরবীরা কি একটু ধন্যবাদ পেতেও পারে না?

জীবানন্দ। (অপ্রস্তুত হইয়া) ধন্যবাদ পাবার সময় হলেই পাবে।

ষোড়শী। (হাসিয়া) এই যেমন সভায় দাঁড়িয়ে এইমাত্র এক দফা দিয়ে এলেন?

[জীবানন্দ স্তব্ধ হইয়া রহিল]

ষোড়শী। নির্মলবাবু না থাকলে আজ আপনার সঙ্গে আমি ভারী ঝগড়া করতাম। ছি—এ কি কোন পুরুষের পক্ষেই সাজে? তা ছাড়া কি প্রয়োজন ছিল বলুন ত? সেদিন এই ঘরে বসেই ত আপনাকে বলেছিলাম, আপনি আমাকে যা আদেশ করবেন আমি পালন করব। আপনিও আপনার হুকুম স্পষ্ট করেই জানিয়েছিলেন। এই নিন সিন্দুকের চাবি এবং নিন হিসাবের খাতা। (অঞ্চল হইতে সিন্দুকের চাবি খুলিয়া এবং তাকের উপর হইতে একখানা খেরো-বাঁধানো মোটা খাতা পাড়িয়া জীবানন্দের পায়ের কাছে রাখিয়া দিল) মায়ের যা-কিছু অলঙ্কার, যত-কিছু দলিলপত্র সিন্দুকের ভিতরেই পাবেন, এবং আর একখানা কাগজ ঐ খাতার মধ্যে পাবেন, যাতে ভৈরবীর সকল দায়িত্ব ও কর্তব্য ত্যাগ করে আমি সই করে দিয়েছি।

জীবানন্দ। (অবিশ্বাস করিয়া) বল কি! কিন্তু ত্যাগ করলে কার কাছে?

ষোড়শী। তাতেই লেখা আছে দেখতে পাবেন।

জীবানন্দ। তাই যদি হয় ত এই চাবিগুলো তাঁকেই দিলে না কেন?

ষোড়শী। তাঁকেই যে দিলাম।

জীবানন্দ। (মলিন-মুখে ও সন্দিগ্ধ-কণ্ঠে) কিন্তু এ ত আমি নিতে পারিনে ষোড়শী। খাতায় লেখা নামগুলোর সঙ্গে সিন্দুকে রাখা জিনিসগুলোও যে এক হবে, সে আমি কি করে বিশ্বাস করব? তোমার আবশ্যক থাকে তুমি পাঁচজনের কাছে বুঝিয়ে দিয়ো।

ষোড়শী। (ঘাড় নাড়িয়া) আমার সে আবশ্যক নেই। কিন্তু চৌধুরীমশায়, আপনার এ অজুহাতও অচল। চোখ বুজে যার হাত থেকে বিষ নিয়ে খাবার ভরসা হয়েছিল, তার হাত থেকে আজ চাবিটুকু নেবার সাহস নেই, এ আমি মানিনে। নিন, ধরুন। (খাতা ও চাবি তুলিয়া জীবানন্দের হাতের মধ্যে একরকম জোর করিয়া গুঁজিয়া দিল) আজ আমি বাঁচলাম। (কোমল কণ্ঠস্বরে) আর একটিমাত্র ভার আপনাকে দিয়ে যাব, সে আমার গরীব-দুঃখী প্রজাদের ভবিষ্যৎ। আমি শত ইচ্ছে করেও তাদের ভাল করতে পারিনি—আপনি অনায়াসে পারবেন। (নির্মলের প্রতি) আমার কথাবার্তা শুনে আপনি আশ্চর্য হয়ে গেছেন, না নির্মলবাবু?

নির্মল। (মাথা নাড়িয়া) শুধু আশ্চর্য নয়, আমি প্রায় অভিভূত হয়ে পড়েছি। ভৈরবীর আসন ত্যাগ করে যে আপনি ইতিমধ্যে ছাড়পত্র পর্যন্ত সই করে রেখেছেন, এ খবর ত আমাকে ঘুণাগ্রে জানান নি?

ষোড়শী। আমার অনেক কথাই আপনাকে জানানো হয়নি, কিন্তু একদিন হয়ত সমস্তই জানতে পারবেন। কেবল একটিমাত্র মানুষ সংসারে আছেন যাঁকে সকল কথাই জানিয়েছি, সে আমার ফকিরসাহেব।

নির্মল। এ-সকল পরামর্শ বোধ হয় তিনিই দিয়েছেন?

ষোড়শী। না, তিনি এখন পর্যন্ত কিছুই জানেন নি, এবং ওই যাকে ছাড়পত্র বলচেন সে আমার একটু আগের রচনা। যিনি এ কাজে আমাকে প্রবৃত্তি দিয়েছেন, শুধু তাঁর নামটিই আমি সংসারে সকলের কাছে গোপন রাখব।

জীবানন্দ। মনে হচ্ছে যেন ডেকে এনে আমার সঙ্গে কি একটা প্রকাণ্ড তামাশা করচ ষোড়শী। এ বিশ্বাস করা যেন সেই ‘মরফিয়া’ খাওয়ার চেয়েও শক্ত ঠেকচে।

নির্মল। (হাসিয়া জীবানন্দের প্রতি চাহিয়া) আপনি তবু এই কয়েক পা মাত্র হেঁটে এসে তামাশা দেখচেন, কিন্তু আমাকে কাজকর্ম, বাড়ি-ঘর ফেলে রেখে এই তামাশা দেখতে হচ্ছে।

আর এ যদি সত্য হয় ত আপনি যা চেয়েছিলেন সেটা অন্ততঃ পেয়ে গেলেন কিন্তু আমার ভাগ্যে ষোল আনাই লোকসান। (ষোড়শীকে) বাস্তবিক এ সকল ত আপনার পরিহাস নয়?

ষোড়শী। না নির্মলবাবু, আমার এবং আমার মায়ের কুৎসায় দেশ ছেয়ে গেল, এই কি আমার হাসি-তামাশার সময়? আমি সত্য সত্যই অবসর নিলাম।

নির্মল। তা হলে বড় দুঃখে পড়েই এ কাজ আপনাকে করতে হলো। আমি আপনাকে বাঁচাতেও হয়ত পারতাম, কিন্তু কেন যে তা হতে দিলেন না তা আমি বুঝেছি। বিষয় রক্ষা হতো, কিন্তু কুৎসার ঢেউ তাতে উত্তাল হয়ে উঠত। সে থামাবার সাধ্য আমার ছিল না। (এই বলিয়া সে কটাক্ষে জীবানন্দের প্রতি চাহিল)

নির্মল। এখন তা হলে কি করবেন স্থির করেছেন?

ষোড়শী। সে আপনাকে আমি পরে জানাব।

নির্মল। কোথায় থাকবেন?

ষোড়শী। এ খবরও আপনাকে আমি পরে দেব।

নির্মল। (হাতঘড়ি দেখিয়া) রাত প্রায় দশটা। আচ্ছা, এখন আমি তা হলে, —আমাকে আর বোধ হয় কোন আবশ্যক নেই?

ষোড়শী। এতবড় অহঙ্কারের কথা কি বলতে পারি নির্মলবাবু? তবে মন্দির নিয়ে আর বোধ হয় আমার কখনো আপনাকে দুঃখ দেবার প্রয়োজন হবে না।

নির্মল। আমাদের শীঘ্র ভুলে যাবেন না আশা করি?

ষোড়শী। (মাথা নাড়িয়া) না।

নির্মল। হৈম আপনাকে বড় ভালবাসে। যদি অবকাশ পান মাঝে মাঝে একটা খবর দেবেন।

[নির্মল প্রস্থান করিল

জীবানন্দ। ভদ্রলোকটিকে ঠিক বুঝতে পারলাম না।

ষোড়শী। না পারলেও আপনার ক্ষতি হবে না।

জীবানন্দ। আমার না হোক তোমার ত হতে পারে। মনে রাখবার জন্যে কি ব্যাকুল প্রার্থনাই জানিয়ে গেলেন।

ষোড়শী। সে শুনেছি। কিন্তু আমি তাঁকে যতখানি জানি তার অর্ধেকও আমাকে জানলে আজ এতবড় বাহুল্য আবেদন তাঁর করতে হতো না।

জীবানন্দ। অর্থাৎ?

ষোড়শী। অর্থাৎ এই যে চণ্ডীগড়ের ভৈরবী-পদ অনায়াসে জীর্ণবস্ত্রের মত ত্যাগ করে যাচ্ছি সে শিক্ষা কোথায় পেলাম জানেন? ওঁদের কাছে। মেয়েমানুষের কাছে এ যে কত ফাঁকি, কত মিথ্যে, সে বুঝেছি কেবল হৈমকে দেখে। অথচ এর বাষ্পও কোনদিন তাঁরা জানতে পারবেন না।

জীবানন্দ। তথাপি এ হেঁয়ালি হেঁয়ালিই রয়ে গেল অলকা। একটা কথা স্পষ্ট করে জিজ্ঞাসা করতে আমার ভারী লজ্জা করে; কিন্তু যদি পারতাম, তুমি কি তার সত্য জবাব দিতে পারতে?

ষোড়শী। (সহাস্যে) আপনি যদি কোন একটা আশ্চর্য কাজ করতে পারতেন, তখন আমিও তেমনি কোন একটা অদ্ভুত কাজ করতে পারতাম কিনা, এ আমি জানিনে—কিন্তু আশ্চর্য কাজ করবার আপনার প্রয়োজন নেই—আমি বুঝেছি। অপবাদ সকলে মিলে দিয়েছে বলেই তাকে সত্য করে তুলতে হবে তার অর্থ নেই। আমি কিছুর জন্যেই কখনো কারও আশ্রয় গ্রহণ করব না। আমার স্বামী আছেন, কোন লোভেই সে কথা আমি ভুলতে পারব না। এই ভয়ানক প্রশ্নটাই না আপনাকে লজ্জা দিচ্ছিল চৌধুরীমশাই?

জীবানন্দ। তুমি আমাকে চৌধুরীমশাই বল কেন?

ষোড়শী। তবে কি বলব? হুজুর?

জীবানন্দ। না। অনেকে যা বলে ডাকে—জীবানন্দবাবু।

ষোড়শী। বেশ, ভবিষ্যতে হবে। কিন্তু রাত্রি হয়ে যাচ্চে আপনি বাড়ি গেলেন না? আপনার লোকজন কৈ?

জীবানন্দ। আমি তাদের পাঠিয়ে দিয়েচি।

ষোড়শী। একলা বাড়ি যেতে আপনার ভয় করবে না?

জীবানন্দ। না, আমার পিস্তল আছে।

ষোড়শী। তবে তাই নিয়ে বাড়ি যান, আমার ঢের কাজ আছে।

জীবানন্দ। তোমার থাকতে পারে, কিন্তু আমার নেই। আমি এখন যাব না।

ষোড়শী। (প্রখর চোখে, অথচ শান্তস্বরে) আমি লোক ডেকে আপনার সঙ্গে দিচ্চি, তারা বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসবে।

জীবানন্দ। (অপ্রতিভ হইয়া) ডাকতে কাউকে হবে না, আমি আপনিই যাচ্ছি। যেতে আমার ইচ্ছে হয় না। তাই শুধু আমি বলছিলাম। তুমি কি সত্যই চণ্ডীগড় ছেড়ে চলে যাবে অলকা?

ষোড়শী। (ঘাড় নাড়িয়া) হাঁ।

জীবানন্দ। কবে যাবে?

ষোড়শী। কি জানি, হয়ত কালই যেতে পারি।

জীবানন্দ। কাল? কালই যেতে পার? (একান্ত স্তব্ধ রহিয়া) আশ্চর্য! মানুষের নিজের মন বুঝতেই কি ভুল হয়! যাতে তুমি যাও সেই চেষ্টাই প্রাণপণে করেছি—অথচ, তুমি চলে যাবে শুনে চোখের সামনে সমস্ত দুনিয়াটা যেন শুকনো হয়ে গেল। তোমাকে তাড়াতে পারলে, ওই যে জমিটা দেনার দায়ে বিক্রি করেছি সে নিয়ে আর গোলমাল হবে না—কতকগুলো নগদ টাকাও হাতে এসে পড়বে, আর, —আর তোমাকে যা হুকুম করব তাই তুমি করতে বাধ্য হবে, এই দিকটাই কেবল দেখতে পেয়েছি। কিন্তু আরও যে একটা দিক আছে, স্বেচ্ছায় তুমি সমস্ত ত্যাগ করে আমার মাথাতেই বোঝা চাপিয়ে দিলে সে ভার বইতে পারব কিনা, এ কথা আমার স্বপ্নেও মনে হয়নি। আচ্ছা অলকা, এমন ত হতে পারে আমার মত তোমারও ভুল হচ্ছে, —তুমিও নিজের মনের ঠিক খবরটি পাওনি! জবাব দাও না যে?

ষোড়শী। জবাব খুঁজে পাইনে। হঠাৎ বিস্ময় লাগে এ কি আপনার কথা!

জীবানন্দ। তবে এই কথাটা বল, সেখানে তোমার চলবে কি করে?

ষোড়শী। অত্যন্ত অনাবশ্যক কৌতূহল চৌধুরীমশায়।

জীবানন্দ। তাই বটে, অলকা তাই বটে। আজ আমার আবশ্যক-অনাবশ্যক তোমাকে বোঝাব আমি কি দিয়ে!

[বাহিরে পূজারীর কাশি ও পায়ের শব্দ শুনা গেল। অতঃপর তিনি প্রবেশ করিলেন]

পূজারী। মা, সকলের সম্মুখে মন্দিরের চাবিটা আমি তারাদাস ঠাকুরের হাতেই দিলাম। রায়মশায়, শিরোমণি—এঁরা উপস্থিত ছিলেন।

ষোড়শী। ঠিকই হয়েছে। তুমি একটু দাঁড়াও, আমি সাগরের ওখানে একবার যাব।

জীবানন্দ। এগুলোও তা হলে তুমি রায়মশায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়ো।

ষোড়শী। না, সিন্দুকের চাবি আর কারও হাতে দিয়ে আমার বিশ্বাস হবে না।

জীবানন্দ। তবে কি বিশ্বাস হবে শুধু আমাকেই?

[ষোড়শী কোন উত্তর না দিয়া জীবানন্দের পায়ের কাছে গড় হইয়া প্রণাম করিল। উঠিয়া দাঁড়াইয়া বিস্ময়ে অভিভূত পূজারীকে কহিল]

ষোড়শী। চল বাবা, আর দেরি করো না।

পূজারী। চল, মা চল।

[পূজারী ও ষোড়শী প্রস্থান করিলে একাকী জীবানন্দ সেই জনহীন কুটীর-অঙ্গনে স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল]

তৃতীয় অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

নাটমন্দির

[চণ্ডীর প্রাঙ্গণস্থিত নাটমন্দিরের একাংশ। সময়—অপরাহ্ন। উপস্থিত—শিরোমণি, জনার্দন রায় এবং আরও দুই-চারিজন গ্রামের ভদ্রব্যক্তি]

শিরোমণি। (আশীর্বাদের ভঙ্গিতে ডান হাত তুলিয়া জনার্দনের প্রতি) আশীর্বাদ করি দীর্ঘজীবী হও, ভায়া, সংসারে এসে বুদ্ধি ধরেছিলে বটে।

জনার্দন। (হেঁট হইয়া পদধূলি লইয়া) আজ এই নিয়ে নির্মলকে দুটো তিরস্কার করতে হলো, শিরোমণিমশাই, মনটা তেমন ভালো নেই।

শিরোমণি। না থাকবারই কথা। কিন্তু এ একপ্রকার ভালই হলো ভায়া। এখন বাবাজীর চৈতন্যোদয় হবে যে, শ্বশুর এবং পিতৃব্যস্থানীয়দের বিরুদ্ধাচরণ করার প্রত্যবায় আছে। আর, এ যে হতেই হবে। সর্বমঙ্গলময়ী চণ্ডীমাতার ইচ্ছা কিনা!

প্রথম ভদ্রলোক। সমস্তই মায়ের ইচ্ছা। তা নইলে কি ষোড়শী ভৈরবী বিনা বাক্যব্যয়ে চলে যেতে চায়!

শিরোমণি। নিঃসন্দেহ। মন্দিরের চাবিটা ত পূজারীর কাছ থেকে কৌশলে আদায় হয়েছে, কিন্তু আসল চাবিটা শুনচি নাকি গিয়ে পড়েছে জমিদারের হাতে। ব্যাটা পাঁড় মাতাল, দেখো ভায়া, শেষকালে মায়ের সিন্দুকের সোনারূপো না ঢুকে যায় শুঁড়ির সিন্দুকে। পাপের আর অবধি থাকবে না।

জনার্দন। ঐটে খেয়াল করা হয়নি।

শিরোমণি। না, এখন সহজে দিলে হয়। দশদিন পরে হয়ত বলে বসবে, কৈ, কিছুই ত সিন্দুকে ছিল না! কিন্তু আমরা সবাই জানি ভায়া, ষোড়শী আর যাই কেন না করুক, মায়ের সম্পত্তি অপহরণ করবে না—একটি পাই-পয়সা না।

[অনেকেই এ কথা স্বীকার করিল]

দ্বিতীয় ভদ্রলোক। এর চেয়ে বরঞ্চ সে-ই ছিল ভাল।

শিরোমণি। চাবিটা অবিলম্বে উদ্ধার করা চাই।

অনেকে। চাই চাই—অবিলম্বে চাই।

প্রথম ভদ্রলোক। আমি বলি, চলুন, আমরা দল বেঁধে যাই জমিদারের কাছে। বলি গে, চাবিটা দিন, কি আছে না আছে মিলিয়ে দেখি গে।

দ্বিতীয় ভদ্রলোক। আমিও তাই বলি।

প্রথম ভদ্রলোক। আজ বেলা তৃতীয় প্রহরে—হুজুর ঘুমটি থেকে উঠে মদ খেতে বসেছেন, মেজাজ খুশ্ আছে—ঠিক এমনি সময়টিতে।

অনেকে। ঠিক ঠিক, এই ঠিক মতলব।

শিরোমণি। (সভয়ে) কিন্তু অত্যন্ত মদ্যপান করে থাকলে যাওয়া সঙ্গত হবে না। কি বল জনার্দন?

[অকস্মাৎ ইঁহাদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য দেখা দিল। কে একজন কহিল, ‘স্বয়ং হুজুর আসচেন যে!’ পরক্ষণেই জীবানন্দ ও প্রফুল্ল প্রবেশ করিলেন। যাহারা বসিয়াছিল অভ্যর্থনা করিতে উঠিয়া দাঁড়াইল। জীবানন্দ নাটমন্দিরে উঠিবার সিঁড়ির উপরে বসিতে যাইতেছিলেন, সকলে সমস্বরে বলিয়া উঠিল, ‘আসন, আসন, শীঘ্র একটা আসন নিয়ে এস’]

জীবানন্দ। (উপবেশন করিয়া) আসনের প্রয়োজন নেই।—দেবীর মন্দির, এর সর্বত্রই ত আসন বিছানো।

জনার্দন। তাতে আর সন্দেহ কি! কিন্তু এ আপনারই যোগ্য কথা।

[প্রফুল্ল সিঁড়ির একাংশে গিয়া বসিল, এবং হাতে তাহার যে খবরের কাগজখানা ছিল তাহাই খুলিয়া নিঃশব্দে পড়িতে লাগিল]

শিরোমণি। যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী। মেঘ না চাইতে জল। আজই দ্বিপ্রহরে আমরা হুজুরের কাছে যাব স্থির করেছিলাম, কিন্তু পাছে নিদ্রার ব্যাঘাত হয় এইজন্যেই—

জীবানন্দ। যাননি? কিন্তু হুজুর ত দিনের বেলা নিদ্রা দেন না।

শিরোমণি। কিন্তু আমরা যে শুনি হুজুর—

জীবানন্দ। শোনেন? তা আপনারা অনেক কথা শোনেন, যা সত্য নয় এবং অনেক কথা বলেন, যা মিথ্যা। এই যেমন, আমার সম্বন্ধে ভৈরবীর কথাটা—

[এই বলিয়া বক্তা হাস্য করিলেন, কিন্তু শ্রোতার দল থতমত খাইয়া একেবারে মুষড়িয়া গেল]

জনার্দন। মন্দির-সংক্রান্ত গোলযোগ যে এত সহজে নিষ্পত্তি করতে পারা যাবে তা আশা ছিল না। নির্মল যে-রকম বেঁকে দাঁড়িয়েছিল—

জীবানন্দ। তিনি সোজা হলেন কি প্রকারে?

শিরোমণি। (খুশী হইয়া সদর্পে) সমস্তই মায়ের ইচ্ছা হুজুর, সোজা যে হতেই হবে। পাপের ভার তিনি আর বইতে পারছিলেন না।

জীবানন্দ। তাই হবে। তার পরে?

শিরোমণি। কিন্তু পাপ ত দূর হলো, এখন,—বল না জনার্দন, হুজুরকে সমস্ত বুঝিয়ে বল না।

জনার্দন। (চকিত হইয়া) মন্দিরের চাবি ত আমরা দাঁড়িয়ে থেকেই তারাদাস ঠাকুরকে দিইয়েচি। আজ তিনি সকালে মায়ের দোর খুলেছেন, কিন্তু সিন্দুকের চাবিটা শুনতে পেলাম, ষোড়শী হুজুরের হাতে সমর্পণ করেছে।

জীবানন্দ। তা করেছে। জমা-খরচের খাতাও একখানা দিয়েছে।

শিরোমণি। বেটী এখনও আছে, কিন্তু কখন কোথায় চলে যায় সে ত বলা যায় না।

জীবানন্দ। (মুহূর্তকাল বৃদ্ধের মুখের প্রতি চাহিয়া) কিন্তু সেজন্য আপনাদের উদ্বেগ কিসের? তাকে তাড়ানও ত চাই। কি বলেন রায়মশায়?

জনার্দন। দলিলপত্র, মূল্যবান তৈজসাদি, দেবীর অলঙ্কার প্রভৃতি যা-কিছু আছে গ্রামের প্রাচীন ব্যক্তিরা সমস্তই জানেন। শিরোমণিমশায় বলেছেন যে, ষোড়শী থাকতে থাকতেই সেগুলো সব মিলিয়ে দেখলে ভালো হয়। হয়ত—

জীবানন্দ। হয়ত নেই? এই না? কিন্তু না থাকলেই বা আপনারা আদায় করবেন কি করে?

জনার্দন। (হঠাৎ উত্তর খুঁজিয়া পাইলেন না। শেষে বলিলেন) কি জানেন, তবু ত জানা যাবে হুজুর।

জীবানন্দ। ত যাবে। কিন্তু শুধু শুধু জানা গিয়ে আর লাভ কি?

শিরোমণি। (প্রথম ভদ্রলোকের প্রতি অলক্ষ্যে) সেরেছে!

জনার্দন। কিন্তু কোনদিন ত জানতেই হবে হুজুর।

জীবানন্দ। তা হবে। কিন্তু আজ আর আমার সময় নেই রায়মশাই।

শিরোমণি। (ব্যগ্র হইয়া) আমাদের সময় আছে হুজুর। চাবিটা জনার্দন ভায়ার হাতে দিলেই সন্ধ্যার পরে আমরা সমস্ত মিলিয়ে দেখতে পারি। হুজুরেরও কোনও দায়িত্ব থাকে না—কি আছে না আছে সে পালাবার আগেই সব জানা যায়। কি বল ভায়া? কি বল হে তোমরা? ঠিক বলেছি কিনা?

[সকলেই এ প্রস্তাবে সম্মতি দিল, দিল না শুধু যাহার হাতে চাবি]

জীবানন্দ। (ঈষৎ হাসিয়া) ব্যস্ত কি শিরোমণিমশায়, যদি কিছু নষ্ট হয়েই থাকে ত ভিখিরীর কাছ থেকে আর আদায় হবে না। আজ থাক, যেদিন আমার অবসর হবে আপনাদের খবর দেব।

[মনে মনে সকলেই ক্রুদ্ধ হইল]

জনার্দন। (উঠিয়া দাঁড়াইয়া) কিন্তু দায়িত্ব একটা—

জীবানন্দ। সে ত ঠিক কথা রায়মশায়। দায়িত্ব একটা আমার রইল বৈ কি।

[সকলে উঠিয়া দাঁড়াইল। চলিতে চলিতে জমিদারের শ্রুতিপথের বাইরে আসিয়া]

শিরোমণি। (জনার্দনের গা টিপিয়া) দেখলে ভায়া, ব্যাটা মাতালের ভাব বোঝাই ভার। গুয়োটা কথা কয় যেন হেঁয়ালি। মদে চুর হয়ে আছে। বাঁচবে না বেশিদিন।

জনার্দন। হুঁ। যা ভয় করা গেল তাই হলো দেখচি।

শিরোমণি। এবারে গেল সব শুঁড়ির দোকানে। বেটী যাবার সময় আচ্ছা জব্দ করে গেল।

প্রথম ভদ্রলোক। হুজুর আর দিচ্চেন না।

শিরোমণি। আবার? এবার চাইতে গেলে গলা টিপে মদ খাইয়ে দিয়ে তবে ছাড়বে। (কথাটা উচ্চারণ করিয়াই তাঁহার সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল)

[সকলের প্রস্থান

প্রফুল্ল। (খবরের কাগজ হইতে মুখ তুলিয়া) দাদা, আবার একটা নূতন হাঙ্গামা জড়ালেন কেন? চাবিটা ওদের দিয়ে দিলেই ত হতো।

জীবানন্দ। হতো না প্রফুল্ল, হলে দিতাম। পাছে এই দুর্ঘটনা ঘটে বলেই সে কাল রাতে আমার হাতে চাবি দিয়েছে।

প্রফুল্ল। সিন্দুকে আছে কি?

জীবানন্দ। (হাসিয়া) কি আছে? আজ সকালে তাই আমি খাতাখানা পড়ে দেখলাম। আছে মোহর, টাকা, হীরে, পান্না, মুক্তোর মালা, মুকুট, নানা রকমের জড়োয়া গয়না, কত কি দলিলপত্র, তা ছাড়া সোনা-রূপার বাসন-কোসনও কম নয়। কতকাল ধরে জমা হয়ে এই ছোট্ট চণ্ডীগড়ের ঠাকুরের যে এত সম্পত্তি সঞ্চিত আছে, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। চুরি-ডাকাতের ভয়ে ভৈরবীরা বোধ করি কাউকে জানতেও দিত না।

প্রফুল্ল। (সভয়ে) বলেন কি! তার চাবি আপনার কাছে? একমাত্র পুত্র-সমর্পণ ডাইনীর হাতে?

জীবানন্দ। নিতান্ত মিথ্যে বলনি ভায়া, এত টাকা দিয়ে আমি নিজেকেও বিশ্বাস করতে পারতাম না অথচ এ আমি চাইনি। যতই তাকে পীড়াপীড়ি করলাম, জনার্দনকে দিতে, ততই সে অস্বীকার করে আমার হাতে গুঁজে দিলে।

প্রফুল্ল। এর কারণ?

জীবানন্দ। বোধ হয় সে ভেবেছিল এ দুর্নামের ওপর আবার চুরির কলঙ্ক চাপালে তার আর সইবে না। এদের সে চিনেছিল।

প্রফুল্ল। কিন্তু আপনাকে সে চিনতে পারেনি।

জীবানন্দ। (হাসিল, কিন্তু সে হাসিতে আনন্দ ছিল না) সে দোষ তার, আমার নয়। তার সম্বন্ধে অপরাধ আর যত দিকেই করে থাকি প্রফুল্ল, আমাকে চিনতে না দেওয়ার অপরাধ করিনি। কিন্তু আশ্চর্য এই পৃথিবী, এবং তার চেয়েও আশ্চর্য এর মানুষের মন। এ যে কি থেকে কি স্থির করে নেয় কিছুই বলবার জো নেই। এর যুক্তিটা কি জানো ভায়া, সেই যে তার হাত থেকে একদিন মরফিয়া চেয়ে নিয়ে চোখ বুজে খেয়েছিলাম, সেই হলো তার সকল তর্কের বড় তর্ক—সকল বিশ্বাসের বড় বিশ্বাস। কিন্তু সে রাত্রে আর যে কোন উপায় ছিল না—সে ছাড়া যে আর কারও পানে চাইবার কোথাও কেউ ছিল না—এ-সব ষোড়শী একেবারে ভুলে গেছে। কেবল একটি কথা তার মনে জেগে আছে—যে নিজের প্রাণটা অসংশয়ে তার হাতে দিতে পেরেছিল তাকে আবার অবিশ্বাস করা যায় কি করে! ব্যস্ যা কিছু ছিল চোখ বুজে দিলে আমার হাতে তুলে। প্রফুল্ল, দুনিয়ায় ভয়ানক চালাক লোকেও মাঝে মাঝে মারাত্মক ভুল করে বসে, নইলে সংসারটা একেবারে মরুভূমি হয়ে যেত, কোথাও রসের বাষ্পটুকু জমবারও ঠাঁই পেত না।

প্রফুল্ল। অতিশয় খাঁটি কথা দাদা! অতএব অবিলম্বে খাতাখানা পুড়িয়ে ফেলে তারাদাস ঠাকুরকে ডেকে ধমক দিন—জমানো মোহরগুলোয় যদি সলোমন সাহেবের দেনাটা শোধ যায় ত শুধু রসের বাষ্প কেন, মুষলধারে বর্ষণ শুরু হতে পারবে।

জীবানন্দ। প্রফুল্ল, এই জন্যেই তোমাকে এত পছন্দ করি।

প্রফুল্ল। (হাত জোড় করিয়া) এই পছন্দটা এইবার একটু খাটো করতে হবে দাদা। রসের উৎস আপনার অফুরন্ত হোক, কিন্তু মোসাহেবি করে এ অধীনের গলার চুঙ্গিটা পর্যন্ত কাঠ হয়ে গেছে। এইবার একবার বাইরে গিয়ে দুটো ডালভাতের যোগাড় করতে হবে। কাল-পরশু আমি বিদায় নিলাম।

জীবানন্দ। (সহাস্যে) একেবারে নিলে? কিন্তু এইবার নিয়ে ক’বার নেওয়া হলো প্রফুল্ল?

প্রফুল্ল। বার-চারেক। (হাসিয়া ফেলিয়া) ভগবান মুখটা দিয়েছিলেন, তা বড়লোকের প্রসাদ খেয়েই দিন গেল; দুটো বড় কথাও যদি না মাঝে মাঝে বার করতে পারি ত নিতান্তই এর জাত যায়। নেহাত অপরাধও নেই দাদা। বহুকাল ধরে আপনাদের জলকে কখনো উঁচু কখনো নীচু বলে এ দেহটায় মেদ-মাংসই কেবল পরিপূর্ণ করেছি, সত্যিকারের রক্ত বলতে আর ছিটেফোঁটাও বাকী রাখিনি। আজ ভাবচি এক কাজ করব। সন্ধ্যার আবছায়ায় গা-ঢাকা দিয়ে গিয়ে খপ করে ভৈরবীঠাক্‌রুনের এক খামচা পায়ের ধূলো নিয়ে ফেলব। আপনার অনেক ভালো-মন্দ দ্রব্যই ত আজ পর্যন্ত উদরস্থ করেচি, এ নইলে সেগুলো আর হজম হবে না, পেটে লোহার মত ফুটবে।

জীবানন্দ। (হাসিবার চেষ্টা করিয়া) আজ উচ্ছ্বাসের কিছু বাড়াবাড়ি হচ্চে প্রফুল্ল।

প্রফুল্ল। (যুক্তহস্তে) তা হলে বসুন দাদা, এটা শেষ করি। মোসাহেবির পেন্সন বলে সেদিন যে উইলখানায় হাজার-পাঁচেক টাকা লিখে রেখেছেন, সেটার ওপরে দয়া করে একটা কলমের আঁচড় দিয়ে রাখবেন—চণ্ডীর টাকাটা হাতে এলে মোসাহেবের অভাব হবে না কিন্তু আমাকে দান করে অতগুলো টাকার আর দুর্গতি করবেন না।

জীবানন্দ। তা হলে এবার আমাকে তুমি সত্যিই ছাড়লে

প্রফুল্ল। আশীর্বাদ করুন এই সুমতিটুকু যেন শেষ পর্যন্ত বজায় থাকে। কিন্তু কবে যাচ্চেন তিনি

জীবানন্দ। জানিনে।

প্রফুল্ল। কোথায় যাচ্চেন তিনি

জীবানন্দ। তাও জানিনে।

প্রফুল্ল। জেনেও কোন লাভ নেই দাদা। বাপ রে মেয়েমানুষ ত নয় যেন পুরুষের বাবা। মন্দিরে দাঁড়িয়ে সেদিন অনেকক্ষণ চেয়েছিলাম মনে হলো পা থেকে মাথা পর্যন্ত যেন পাথরে গড়া। ঘা মেরে গুঁড়ো করা যাবে কিন্তু আগুনে গলিয়ে ইচ্ছে মত ছাঁচে ঢেলে গড়বেন সে বস্তুই নয়। পারেন ত ও মতলবটা পরিত্যাগ করবেন।

জীবানন্দ। বিদ্রূপের স্বরে তা হলে প্রফুল্ল এবার নিতান্তই যাচ্চো

প্রফুল্ল। গুরুজনের আশীর্বাদের জোর থাকে ত মনস্কামনা সিদ্ধ হবে বৈ কি।

জীবানন্দ। তা হতে পারে। আচ্ছা ষোড়শী সত্যই চলে যাবে তোমার মনে হয়

প্রফুল্ল। হয়। কারণ সংসারে সবাই প্রফুল্ল নয়। ভালো কথা দাদা একটা খবর দিতে আপনাকে ভুলেছিলাম। কাল রাত্রে নদীর ধারে বেড়াচ্ছিলাম হঠাৎ দেখি সেই ফকিরসাহেব। আপনাকে যিনি একদিন তাঁর বটগাছে ঘুঘু শিকার করতে দেননি—বন্দুক কেড়ে নিয়েছিলেন—তিনি। কুর্নিশ করে কুশল প্রশ্ন করলাম ইচ্ছে ছিল মুখরোচক দুটো খোশামোদ টোশামোদ করে যদি একটা কোন ভালরকমের ওষুধ টষুধ বার করে নিতে পারি ত আপনাকে ধরে পেটেন্ট নিয়ে বেচে দু’পয়সা রোজগার করব। কিন্তু ব্যাটা ভারী চালাক, সেদিক দিয়েই গেল না। কথায় কথায় শুনলাম তাঁর ভৈরবী মাকে দেখতে এসেছিলেন, এখন চলে যাচ্চেন। ভৈরবী যে সমস্ত ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্চেন তাঁর কাছেই শুনতে পেলাম।

জীবানন্দ। এঁর সদুপদেশের ফলেই বোধ হয়?

প্রফুল্ল। না। বরঞ্চ, উপদেশের বিরুদ্ধেই যাচ্চেন।

জীবানন্দ। বল কি হে, ফকির যে শুনি তাঁর গুরু! গুরু-আজ্ঞা লঙ্ঘন?

প্রফুল্ল। এক্ষেত্রে তাই বটে।

জীবানন্দ। কিন্তু এতবড় বিরাগের হেতু?

প্রফুল্ল। হেতু আপনি। কি জানি, এ কথা শোনানো আপনাকে উচিত হবে কিনা, কিন্তু ফকিরের বিশ্বাস আপনাকে তিনি মনে মনে অত্যন্ত ভয় করেন। পাছে কলহবিবাদের মধ্যে দিয়েও আপনার সঙ্গে মাখামাখি হয়ে যায়, এই তাঁর সবচেয়ে দুশ্চিন্তা। নইলে ভয় তাঁর মিথ্যা কলঙ্কেও নয়, গ্রামের লোককেও নয়।

[জীবানন্দ বিস্ফারিত চক্ষে নীরবে চাহিয়া রহিলেন]

প্রফুল্ল। দাদা, ভগবান আপনাকেও বুদ্ধি বড় কম দেননি, কিন্তু সর্বস্ব সমর্পণ করে কাল তিনিই মারাত্মক ভুল করলেন, না হাত পেতে নিয়ে আপনিই মারাত্মক ভুল করলেন, সে মীমাংসা আজ বাকী রয়ে গেল। বেঁচে থাকি ত একদিন দেখতে পাব আশা হয়।

[জীবানন্দ নিঃশব্দে বসিয়া রহিলেন। সহসা বেয়ারা পাত্র ভরিয়া মদ লইয়া প্রবেশ করিতেই]

জীবানন্দ। আঃ—এখানেও! যা নিয়ে যা—দরকার নেই।

[বেয়ারা প্রস্থান করিল

প্রফুল্ল। রাগ করেন কেন দাদা, যেমন শিক্ষা। বরঞ্চ কখন দরকার সেইটেই বলে দিন না। অকস্মাৎ অমৃতে অরুচি যে দাদা?

জীবানন্দ। (হাসিয়া) অরুচি নয়, কিন্তু আর খাব না।

প্রফুল্ল। (হাসিয়া) এই নিয়ে ক’বার হলো দাদা?

জীবানন্দ। (হাসিয়া) এই মীমাংসাটাও আজ না হয় বাকী থাক প্রফুল্ল, যদি বেঁচে থাকো ত একদিন দেখতে পাবে আশা করি।

[বেয়ারা পুনরায় প্রবেশ করিল]

বেয়ারা। এই পিস্তলটা ভুলে টেবিলের ওপর ফেলে রেখে এসেছিলেন।

জীবানন্দ। ভুলেই এসেছিলাম বটে, কিন্তু ওতেও আর কাজ নেই, তুই নিয়ে যা।

প্রফুল্ল। কিন্তু রাত প্রায় এগারোটা হলো, বাড়ি চলুন।

জীবানন্দ। না, বাড়ি নয় প্রফুল্ল, এখন একলা অন্ধকারে একটু ঘুরতে বার হবো।

প্রফুল্ল। একলা? নিরস্ত্র? না না, সে হয় না দাদা। অন্ধকার রাত, পথে-ঘাটে আপনার অনেক শত্রু। অন্ততঃ নিত্য-সহচরটিকে সঙ্গে রাখুন। (এই বলিয়া সে ভৃত্যের হাত হইতে পিস্তল লইয়া দিতে গেল)

জীবানন্দ। (পিছাইয়া গিয়া) এ জীবনে ওকে আর আমি ছুঁচ্চিনে প্রফুল্ল। আজ থেকে আমি এমনি একাকী বার হবো, যেন কোথাও কোন শত্রু নেই আমার। আমার থেকেও কারও কোন না ভয় হোক; তার পরে যা হয় তা ঘটুক, আমি কারও কাছে নালিশ করব না।

প্রফুল্ল। হঠাৎ হলো কি? না হয়, পাইকদের কাউকে ডেকে দিই?

জীবানন্দ। না, পাইক-পেয়াদা আর নয়। তোমরা বাড়ি যাও।

প্রফুল্ল। আপনার অবাধ্য হবো না দাদা, আমরা চললাম, কিন্তু আপনিও বেশী বিলম্ব করবেন না আমার অনুরোধ।

[প্রফুল্ল ও বেয়ারা প্রস্থান করিল

[জীবানন্দ ধীরে ধীরে নাটমন্দিরের আর একটা দিকে আসিয়া উপস্থিত হইল। একজন থাম ঠেস দিয়া বসিয়া মৃদুকণ্ঠে নাম-গান করিতেছিল এবং অদূরে চার-পাঁচজন লোক চাদর মুড়ি দিয়া ঘুমাইতেছিল। জীবানন্দ হেঁট হইয়া অন্ধকারে তাহাকে দেখিবার চেষ্টা করিল]

গীত

পূজা করে তোরে তারা
সার যদি হয় নয়নধারা,
শুভঙ্করী নাম তবে মা
ধরিস কেন দুঃখ-হরা।
কি পাপেতে বল্ মা কালী
মাখালি কলঙ্ক-কালি—
এখন ভরসা কেবল কালী
তুই মা বরাভয়-করা।

জীবানন্দ। তুমি কে হে?

পথিক। আজ্ঞে, আমি একজন যাত্রী বাবু।

জীবানন্দ। বাবু বলে আমাকে চিনলে কি করে?

পথিক। আজ্ঞে, তা আর চেনা যায় না? ভদ্দরলোক ছাড়া এমন ধপধপে কাপড় আর কাদের থাকে বাবু?

জীবানন্দ। ওঃ—তাই বটে! কোথা থেকে আসচ? কোথায় যাবে? এরা বুঝি তোমার সঙ্গী?

পথিক। আসচি মানভূম জেলা থেকে বাবু, যাব পুরীধামে। এদের কারও বাড়ি মেদিনীপুরে, কারও বাড়ি আর কোথাও—কোথায় যাবে তাও জানিনে।

জীবানন্দ। আচ্ছা, কত লোক এখানে রোজ আসে? যারা থাকে তারা দু’বেলা খেতে পায়, না?

পথিক। (লজ্জিত হইয়া) কেবল খাবার জন্যেই নয় বাবু! আমার পা কেটে গিয়ে ঘায়ের মত হয়েছে দেখেই মা-ভৈরবী নিজে হুকুম দিয়েছিলেন যত দিন না সারে তুমি থাকো।

জীবানন্দ। তোমাকে যেতে বলিনি ভাই, বেশ ত থাকো না। জায়গার ত আর অভাব নেই।

পথিক। কিন্তু ভৈরবী মা ত আর নেই শুনতে পেলাম।

জীবানন্দ। এরই মধ্যে শুনতে পেয়েছ? তা নাই তিনি থাকলেন, তাঁর হুকুম ত আছে? তোমাকে যেতে বলে কার সাধ্য? বাড়ি কোথায় তোমার ভাই?

পথিক। বাড়ি আমার ছিল বাবু মানভুঁয়ের বংশীতট গাঁয়ে। গাঁয়ে অন্ন নেই, জল নেই, ডাক্তার-বদ্যি নেই—জমিদার থাকেন কলকাতায়, কখনো তাঁকে কেউ দুঃখ জানাতে পারিনে। আছে শুধু গোমস্তা টাকা আদায়ের জন্যে।

[জীবানন্দ নিঃশব্দে মাথা নাড়িয়া সায় দিল]

পথিক। উপরি উপরি দু’সন বৃষ্টি হলো না, ক্ষেতের ফসল জ্বলে-পুড়ে গেল, এও সয়েছিল বাবু, —কিন্তু— (কান্নায় তাহার গলা বুজিয়া আসিল)

জীবানন্দ। তাই বুঝি তীর্থ-দর্শনে একবার বেরিয়ে পড়লে?

পথিক। (মাথা নাড়িয়া) এই ফাল্গুনে পরিবার মারা গেল, একে একে দুই ছেলে ওলাউঠায় চোখের সামনে মারা গেল বাবু, একফোঁটা ওষুধ কাউকে দিতে পারলাম না।

[বলিতে বলিতে লোকটি উচ্ছ্বসিত শোকে কাঁদিয়া ফেলিল। জীবানন্দ জামার হাতায় চোখ মুছিতে লাগিলেন]

পথিক। মনে মনে বললাম, আর কেন? ভাঙ্গা কুঁড়েখানি বিধবা ভাইঝিকে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম—বাবু, আমার চেয়ে দুঃখী আর সংসারে নেই।

জীবানন্দ। ওরে ভাই, সংসারটা ঢের বড় জায়গা, এর কোথায় কে কিভাবে আছে বলবার জো নেই।

পথিক। কিন্তু আমার মত—

জীবানন্দ। দুঃখী? কিন্তু দুঃখীদেরও কোন আলাদা জাত নেই দাদা, দুঃখেরও কোন বাঁধানো রাস্তা নেই। তা হলে সবাই তাকে এড়িয়ে চলতে পারত। হুড়মুড় করে যখন ঘাড়ে এসে পড়ে তখনই কেবল মানুষ টের পায়। আমার সব কথা তুমি বুঝবে না ভাই, কিন্তু সংসারে তুমি একলা নও। অন্ততঃ একজন সাথী তোমার বড় কাছেই আছে, তাকে তুমি চিনতেও পারোনি। কিন্তু তুমি মায়ের নাম করছিলে—

[সহসা সাগর ও হরিহর দ্রুতপদে প্রবেশ করিয়া মন্দিরের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল। জীবানন্দ উৎকর্ণ হইয়া শুনিতে লাগিল]

হরিহর। আমাদের মায়ের সর্বনাশ যে করেছে তার সর্বনাশ না করে আমরা কিছুতেই ছাড়ব না।

সাগর। মায়ের চৌকাঠ ছুঁয়ে দিব্যি করলাম খুড়ো, ফাঁসি যেতে হয় তাও যাব।

হরিহর। হঃ—আমাদের আবার জেল, আমাদের আবার ফাঁসি! মা আগে যাক—

হরিহর ও সাগর। জয় মা চণ্ডী!

[উভয়ের প্রস্থান

জীবানন্দ। বাস্তবিক, ঠাকুর-দেবতার মত এমন সহৃদয় শ্রোতা আর নেই। হোক না মিথ্যা দম্ভ, তবু তার দাম আছে। দুর্বলের ব্যর্থ পৌরুষ তবু একটু গৌরবের স্বাদ পায়।

পথিক। কি বললেন বাবু?

জীবানন্দ। কিছু না ভাই, মায়ের নাম করছিলে আমি বাধা দিলাম। আবার শুরু কর, আমি চললাম। কাল এমনি সময়ে হয়ত আবার দেখা পাবে।

পথিক। আর ত দেখা হবে না বাবু, আমি পাঁচদিন আছি, কালই সকালে চলে যেতে হবে।

জীবানন্দ। চলে যেতে হবে? কিন্তু এই যে বললে তোমার পা এখনো সারেনি, তুমি হাঁটতে পার না?

পথিক। মায়ের মন্দির এখন রাজাবাবুর। হুজুরের হুকুম তিনদিনের বেশি আর কেউ থাকতে পারবে না।

জীবানন্দ। (হাসিয়া) ভৈরবী এখনও যায়নি, এরই মধ্যে হুজুরের হুকুম জারি হয়ে গেছে? মা-চণ্ডীর কপাল ভালো! আচ্ছা, আজ অতিথিদের সেবা হলো কিরকম? কি খেলে ভাই?

পথিক। যাদের তিনদিনের বেশি হয়নি তারা মায়ের প্রসাদ সবাই পেলে।

জীবানন্দ। আর তুমি? তোমার ত তিনদিনের বেশি হয়ে গেছে?

পথিক। ঠাকুরমশাই কি করবেন, রাজাবাবুর হুকুম নেই কিনা।

জীবানন্দ। তাই হবে। (এই বলিয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস মোচন করিল)

জীবানন্দ। কাল আমি আবার আসব, কিন্তু ভাই, চুপিচুপি চলে যেতে পাবে না।

পথিক। ঠাকুরমশাই যদি কিছু বলে?

জীবানন্দ। বললেই বা। এত দুঃখ সইতে পারলে, আর বামুনের একটা কথা সইতে পারবে না? রাত হলো এখন যাই, কিন্তু মনে থাকে যেন।

[এমনি সময়ে ষোড়শী প্রদীপ-হস্তে ধীরে ধীরে প্রবেশ করিয়া মন্দিরের দ্বারের অভিমুখে অগ্রসর হইতেছিল, জীবানন্দ পিছন হইতে ডাক দিল]

জীবানন্দ। অলকা?

ষোড়শী। (চমকিয়া) আপনি? এত রাত্রে আপনি এখানে কেন?

জীবানন্দ। কি জানি, এমনি এসেছিলাম। তুমি যাত্রার আগে ঠাকুর-প্রণাম করতে যাচ্ছ, না? চল, আমি তোমার সঙ্গে যাই।

ষোড়শী। আমার সঙ্গে যাবার বিপদ আছে সে ত আপনি জানেন!

জীবানন্দ। বিপদ? জানি। কিন্তু আমার পক্ষ থেকে একেবারেই নেই। আজ আমি একা এবং সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। এ জীবনে আর যাই কেন না স্বীকার করি, আমার শত্রু আছে এ আমি একটা দিনও আর মানব না।

ষোড়শী। কিন্তু কি হবে আমার সঙ্গে গিয়ে?

জীবানন্দ। কিছু না। শুধু যতক্ষণ আছ সঙ্গে থাকব, তার পর যখন সময় হবে তোমাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আমি বাড়ি চলে যাব। যাবার দিন আজ আর আমাকে তুমি অবিশ্বাস করো না। আমার আয়ুর দাম জানো, হয়ত আর দেখাও হবে না। আমাকে যে তুমি কতরকমে দয়া করে গেলে, শেষদিন পর্যন্ত আমি সেই কথাই স্মরণ করব।

ষোড়শী। আচ্ছা, আসুন আমার সঙ্গে।

[রুদ্ধ মন্দিরের দ্বারে গিয়া ষোড়শী প্রণাম করিল। জীবানন্দ বলিতে লাগিল]

জীবানন্দ। তোমাকে আমার প্রয়োজন অলকা। দুটো দিনও কি আর তোমার থাকা চলে না?

ষোড়শী। না।

জীবানন্দ। একটা দিন?

ষোড়শী। না।

জীবানন্দ। তবে সকল অপরাধ আমার এইখানে দাঁড়িয়ে আজ ক্ষমা কর!

ষোড়শী। কিন্তু তাতে কি আপনার প্রয়োজন আছে?

জীবানন্দ। এর উত্তর আজ দেবার আমার শক্তি নেই। এখন কেবল এই কথাই আমার সমস্ত মন ছেয়ে আছে অলকা, কি করলে তোমাকে একটা দিনও ধরে রাখতে পারি। উঃ—নিজের মন যার পরের হাতে চলে যায়, সংসারে তার চেয়ে নিরুপায় বুঝি আর কেউ নেই।

[ষোড়শী জীবানন্দের কাছে আসিয়া স্তব্ধ হইয়া নীরবে দাঁড়াইল]

জীবানন্দ। (দাঁড়াইয়া) আমার সবচেয়ে বড় দুঃখ অলকা, সবাই জানবে আমি শাস্তি দিয়েছি, তুমি সহ্য করেছ, আর নিঃশব্দে চলে গেছ। এতবড় মিথ্যে কলঙ্ক আমি সইব কেমন করে? তাও সয় যদি একটি দিন—শুধু কেবল একটি দিনও তোমাকে কাছে রাখতে পারি।

ষোড়শী। (পিছাইয়া গিয়া) চৌধুরীমশাই, কিসের জন্যে এত অনুনয়-বিনয়? আপনার পাইক-পেয়াদাদের গায়ের জোরের ত আজও অভাব হয়নি। আপনি ত জানেন, আমি কারো কাছে নালিশ করবো না।

জীবানন্দ। (পথ ছাড়িয়া সরিয়া) তা হলে তুমি যাও। অসম্ভবের লোভে আর তোমাকে আমি পীড়ন করব না। পাইক-পেয়াদা সবাই আছে অলকা, তাদের জোরের অভাব হয়নি। কিন্তু যে নিজে ধরা দিলে না, জোর করে ধরে রেখে তার বোঝা বয়ে বেড়াবার জোর আর আমার গায়ে নেই।

ষোড়শী। (গড় হইয়া প্রণাম করিয়া জীবানন্দের পায়ের ধূলা মাথায় তুলিয়া) আপনার কাছে আমার একান্ত অনুরোধ—

জীবানন্দ। কি অনুরোধ অলকা?

[বাহিরে গরুর গাড়ি দাঁড়ানোর শব্দ হইল]

ষোড়শী। দয়া করে একটু সাবধানে থাকবেন।

জীবানন্দ। সাবধানে থাকব! কি জানি, সে বোধ হয় আর পেরে উঠব না। কিছুক্ষণ পূর্বে এই মন্দিরে কে দুজন দেবতার চৌকাঠ ছুঁয়ে প্রাণ পর্যন্ত পণ করে শপথ করে গেল, তাদের মায়ের সর্বনাশ যে করেছে, তার সর্বনাশ না করে তারা বিশ্রাম করবে না,—আড়ালে দাঁড়িয়ে নিজের কানেই ত সব শুনলাম—দুদিন আগে হলে হয়ত মনে হতো আমিই বুঝি তাদের লক্ষ্য—দুশ্চিন্তার সীমা থাকত না, কিন্তু আজ কিছু মনেই হলো না—কি অলকা? চমকালে কেন?

ষোড়শী। (পাংশু-মুখে) না কিছু না। এইবারে ত আপনার চণ্ডীগড় ছেড়ে বাড়ি যাওয়া উচিত? আর ত এখানে আপনার কাজ নেই।

জীবানন্দ। (অন্যমনস্কতায়) কাজ নেই?

ষোড়শী। কৈ আমি ত আর দেখতে পাইনে। এ গ্রাম আপনার, একে নিষ্পাপ করবার জন্যেই আপনি এসেছিলেন। আমার মত অসতীকে নির্বাসিত করার পরে আর এখানে আপনার কি আবশ্যক আছে আমি ত দেখতে পাইনে।

জীবানন্দ। (চোখ মেলিয়া চাহিয়া রহিয়া) কিন্তু তুমি ত অসতী নও!

[গাড়োয়ানের প্রবেশ]

গাড়োয়ান। মা, আর কি বেশী দেরি হবে?

ষোড়শী। না বাবা, আর বেশী দেরি হবে না।

[গাড়োয়ান প্রস্থান করিল

চণ্ডীগড় থেকে আপনাকে কিন্তু যেতেই হবে তা বলে দিচ্ছি।

জীবানন্দ। কোথায় যাব বল?

ষোড়শী। কেন, আপনার নিজের বাড়িতে। বীজগাঁয়ে।

জীবানন্দ। বেশ, তাই যাব।

ষোড়শী। কিন্তু কালকেই যেতে হবে।

জীবানন্দ। (মুখ তুলিয়া) কালই? কিন্তু কাজ আছে যে। মাঠে জলনিকাশের একটা সাঁকো করা দরকার। এদের জমিগুলো সব ফিরিয়ে দিতে হবে, সে ত তোমারই হুকুম। তা ছাড়া মন্দিরের একটা ভালো বিলি-ব্যবস্থা হওয়া চাই, —অতিথি-অভ্যাগত যারা আসে তাদের ওপর না অত্যাচার হয়—এ-সব না করেই তুমি চলে যেতে বলচ?

ষোড়শী। (মুশকিলে পড়িয়া) এ-সব সাধুসঙ্কল্প কি কাল সকাল পর্যন্ত থাকবে? (জীবানন্দ নীরব রহিল) কিন্তু আবশ্যকের চেয়ে একটা দিনও বেশী থাকবেন না আমাকে কথা দিন। এবং সে-ক’টা দিন আগেকার মত সাবধানে থাকবেন বলুন?

জীবানন্দ। (সে কথায় কান না দিয়া) আমার কৃতকর্মের ফল যদি আমি ভোগ করি সে অভিযোগ আমি কারুর কাছে করব না—কিন্তু যাবার সময় তোমার কাছে আমার শুধু একটিমাত্র দাবী আছে—(পকেট হইতে একখানি পত্র বাহির করিয়া ষোড়শীর হাতে দিয়া) এই চিঠিখানি ফকিরসাহেবকে দিয়ো।

ষোড়শী। দেবো। কিন্তু এ পত্র কি পড়তে পারিনে?

জীবানন্দ। পার, কিন্তু আবশ্যক নেই। এর জবাব দেবার ত প্রয়োজন হবে না। আমাকে দুঃখ থেকে বাঁচাবার জন্যে তার ঢের বেশী দুঃখ তুমি নিজে নিয়েচ। নইলে এমন করে হয়ত আমাকে—কিন্তু যাক সে। আমার শেষ অনুরোধ এতেই লেখা আছে, তা যদি রাখতে পার, তার চেয়ে আনন্দ আর আমার নেই।

ষোড়শী। তা হলে পড়ি?

[ষোড়শী নীরবে চিঠিখানি পড়িল, তাহার মুখে ভাবের একান্ত পরিবর্তন ঘটিল; জীবানন্দকে আড়াল করিয়া তাড়াতাড়ি সজল চক্ষু মুছিয়া ফেলিল]

ষোড়শী। আমি যে কুষ্ঠাশ্রমের দাসী হয়ে যাচ্চি এ খবর তুমি জানলে কি করে?

জীবানন্দ। কুষ্ঠাশ্রমের কথা অনেকেই জানে। আর তোমার কথা? আজই দেবতার স্থানে দাঁড়িয়ে যারা শপথ করে গেল, নিজের কানে শুনেও আমি যাদের চিনতে পারিনি তুমি তাদের চিনলে কি করে?

ষোড়শী। তোমার কি সংসারে আর মন নেই? সমস্ত বিলিয়ে নষ্ট করে দিয়ে কি তুমি সন্ন্যাসী হয়ে বেরিয়ে যেতে চাও নাকি?

জীবানন্দ। (সহসা উত্তেজিত হইয়া) আমি সন্ন্যাসী? মিছে কথা। আমি বাঁচতে চাই—মানুষের মত, আমি মানুষের মত বাঁচতে চাই। বাড়ি চাই, ঘর চাই, স্ত্রী চাই, সন্তান চাই—আর মরণ যেদিন আটকাতে পারব না, সেদিন তাদের চোখের উপর দিয়েই চলে যেতে চাই। কিন্তু এ প্রার্থনা জানাব আমি কার কাছে?

[গাড়োয়ানের প্রবেশ]

গাড়োয়ান। মা, শৈবালদীঘি সাত-আট কোশের পথ, এখন বার না হলে পৌঁছাতে বেলা হয়ে যাবে।

ষোড়শী। চল বাবা, যাচ্চি।

[গাড়োয়ান প্রস্থান করিল। ষোড়শী পুনরায় জীবানন্দকে প্রণাম করিয়া]

আমি চললাম।

জীবানন্দ। এখনি? এত রাত্রে?

ষোড়শী। প্রজারা জানে আমি ভোরবেলায় যাত্রা করব, তারা এসে পড়বার পূর্বেই আমার বিদায় হওয়া চাই।

[প্রস্থান

জীবানন্দ। (একাকী অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়াইয়া) অলকা! অলকা! একদিন তোমার মা আমার হাতে তোমাকে দিয়েছিলেন; তবু তোমাকে পেলাম না; কিন্তু সেদিন আমাকে যদি কেউ তোমার হাতে সঁপে দিতেন, আজ বোধ হয় তুমি অন্ধকারে আমাকে এমন করে ফেলে যেতে পারতে না।

[বাহির হইতে গরুর গাড়ি চালানোর শব্দ শুনা যাইতে লাগিল]

চতুর্থ অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

শান্তিকুঞ্জ

[জমিদারের ‘শান্তিকুঞ্জ’ তিন-চারিদিন হইল ভস্মীভূত হইয়াছে। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের বহু চিহ্ন তখনও বিদ্যমান। সবই পুড়িয়াছে, মাত্র ভৃত্যদের খান-দুই ঘর রক্ষা পাইয়াছে। ইহার মধ্যেই জীবানন্দ আশ্রয় লইয়াছেন। সম্মুখের খোলা জানালা দিয়া বারুই নদীর জল দেখা যাইতেছে; প্রভাতবেলায় সেইদিকে চোখ মেলিয়া জীবানন্দ নিঃশব্দে বসিয়াছিলেন। মুখে চাঞ্চল্য বা উত্তেজনার কোন প্রকাশ নাই, শুধু সারারাত্রি ধরিয়া উৎকট রোগ-ভোগের একটা অবসন্ন ম্লান ছায়া তাঁহার সর্বদেহে পরিব্যাপ্ত হইয়া আছে]

[প্রফুল্ল প্রবেশ করিল]

প্রফুল্ল। এখন কেমন আছেন দাদা?

জীবানন্দ। ভালো আছি।

প্রফুল্ল। বহুকালের অভ্যাস, ওষুধ বলেও যদি এক-আধ আউন্স—

জীবানন্দ। (সহাস্যে) ওষুধই বটে। না প্রফুল্ল, মদ আমি খাব না।

প্রফুল্ল। রাত্রিটা কাল কি উৎকণ্ঠাতেই আমাদের কেটেছে। যন্ত্রণায় হাত-পা পর্যন্ত ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল।

জীবানন্দ। তাই এই গরম করার প্রস্তাব?

প্রফুল্ল। বল্লভ ডাক্তারের ভয়, হয়ত হঠাৎ হার্টফেল করতে পারে।

জীবানন্দ। হার্ট ত হঠাৎই ফেল করে প্রফুল্ল।

প্রফুল্ল। কিন্তু সেজন্যে ত একটা—

জীবানন্দ। (নিজের হার্ট হাত দিয়া দেখাইয়া) ভায়া, এ বেচারা বহু উপদ্রবেও সমানে চলতে কোনদিন ফেল করেনি। দৈবাৎ একদিন একটা অকাজ যদি করেই বসে ত মাপ করা উচিত।

প্রফুল্ল। কি একগুঁয়ে মানুষ আপনি দাদা। ভাবি, এতবড় জিদ এতকাল কোথায় লুকানো ছিল!

জীবানন্দ। ভালো কথা, তোমার ডালভাতের যোগাড়ে বার হবার যে একটা সাধু প্রস্তাব ছিল তার কতদূর?

প্রফুল্ল। ঘাট হয়েছে দাদা। আপনি ভালো হয়ে উঠুন, ডালভাতের চিন্তা তার পরেই করব।

জীবানন্দ। আমার ভালো হবার পরে ত? যাক তা হলে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।

[তারাদাস ও পূজারীর প্রবেশ]

তারাদাস। মন্দিরের খানকয়েক থালা-ঘটি-বাটি পাওয়া যাচ্ছে না।

জীবানন্দ। না গেলে সেগুলো আবার কিনে নিতে হবে।

[ব্যস্ত হইয়া এককড়ির প্রবেশ]

এককড়ি। (ডাক ছাড়িয়া) এ কাজ সাগর সর্দারের। আজ খবর পাওয়া গেল, তাকে আর তার দু’জন সঙ্গীকে সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত এদিকে ঘুরে বেড়াতে লোক দেখেচে। থানায় সংবাদ পাঠিয়েচি, পুলিশ এল বলে। সমস্ত ভূমিজ গুষ্টিকে যদি না আমি এই ব্যাপারে আন্দামানে পাঠাতে পারি ত আমার নামই এককড়ি নন্দী নয়—বৃথাই আমি এতকাল হুজুরের সরকারে গোলামি করে মরচি।

জীবানন্দ। (একটু হাসিয়া) তা হলে তোমাকেও ত এদের সঙ্গে যেতে হয় এককড়ি। জমিদারের গোমস্তাগিরি কাজে তুমি যাদের ঘর জ্বালিয়েছ সে ত আমি জানি। এদের আগুন দিতে কেউ চোখে দেখেনি, কেবল সন্দেহের উপর যদি তাদের শাস্তি ভোগ করতে হয়, জানা-অপরাধের জন্য তোমাকেও ত তার ভাগ নিতে হয়।

এককড়ি। (প্রথমে হতবুদ্ধি হইয়া, পরে শুষ্ক হাস্যের সহিত) হুজুর মা-বাপ। আমাদের সাত-পুরুষ হুজুরের গোলাম। হুজুরের আদেশে শুধু জেল কেন, ফাঁসি যাওয়ায় আমাদের অহঙ্কার।

জীবানন্দ। যা পুড়েছে, সে আর ফিরবে না; কিন্তু এর পর যদি পুলিশের সঙ্গে জুটে নতুন হাঙ্গামা বাধিয়ে দু’পয়সা উপরি রোজগারের চেষ্টা কর, তা হলে হুজুরের লোকসানের মাত্রা ঢের বেড়ে যাবে এককড়ি।

পূজারী। মিস্ত্রী এসেছে হুজুরের কাছে নালিশ জানাতে।

জীবানন্দ। কিসের নালিশ?

পূজারী। মন্দিরের মেরামতি-কাজে ঘটনাচক্রে তার বিশেষ লোকসান হয়ে যায়। মা বলেছিলেন, কাজ শেষ হলে তার ক্ষতিপূরণ করে দেবেন। আমি তখন উপস্থিত ছিলাম হুজুর।

জীবানন্দ। তবে দেওয়া হয় না কেন?

পূজারী। (তারাদাসকে ইঙ্গিত করিয়া) উনি বলেন, যে বলেছিল তার কাছে গিয়ে আদায় করতে।

[জীবানন্দ ক্রুদ্ধ-চক্ষে তারাদাসের প্রতি চাহিতে]

তারাদাস। অনেকগুলো টাকা—

জীবানন্দ। অনেকগুলো টাকাই দেবে ঠাকুর।

তারাদাস। কিন্তু খরচটা ন্যায্য কিনা—

জীবানন্দ। দেখ তারাদাস, ও-সব শয়তানি মতলব তুমি ছাড়ো। ষোড়শীর ন্যায়-অন্যায় বিচারের ভার তোমার ওপরে নেই। যা বলে গেছেন তাই কর গে। (পূজারীর প্রতি) মিস্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে?

পূজারী। আছে হুজুর।

জীবানন্দ। চল, আমি নিজে গিয়ে সমস্ত মিটিয়ে দিচ্ছি।

[জীবানন্দ, প্রফুল্ল, তারাদাস ও পূজারীর প্রস্থান। রহিল শুধু এককড়ি]

[শিরোমণি ও জনার্দন রায়ের প্রবেশ]

জনার্দন। বাবু গেলেন কোথা?

এককড়ি। (তিক্তকণ্ঠে) কে জানে!

জনার্দন। কে জানে কি হে? পুলিশে খবর দেবার কথাটা তাঁকে বলেছিলে?

এককড়ি। পারেন, আপনিই বলুন না।

জনার্দন। ব্যাপার কি এককড়ি?

এককড়ি। কে জানে কি ব্যাপার। না আছে মেজাজের ঠিক, না পাই কোন কথার ঠিকানা। তারা ঠাকুরকে তেড়ে মারতে গেলেন, আমাকে পাঠাতে চাইলেন জেলে—

শিরোমণি। অত্যধিক মদ্যপানের ফল। হুজুর কি এখনি ফিরে আসবেন মনে হয়?

এককড়ি। বুঝলেন রায়মশায়, মিথ্যে সন্দেহ করে সাগর সর্দারের নাম পুলিশে জানানো চলবে না।

জনার্দন। মিথ্যে সন্দেহ কি হে? এ যে একরকম স্পষ্ট চোখে দেখা।

শিরোমণি। একেবারে প্রত্যক্ষ বললেই হয়।

এককড়ি। বেশ, তাই একবার বলে দেখুন না?

জনার্দন। বলবই ত হে। নইলে কি গুষ্টিবর্গ মিলে পুড়ে কয়লা হবো! ষোড়শীকে তাড়ানোর কাজে আমিও ত একজন উদ্যোগী।

শিরোমণি। আমার কথাই না কোন্‌ তারা শুনেছে!

জনার্দন। যারা এতবড় জমিদারের বাড়িতে আগুন দিতে পারে, তারা পারে না কি?

এককড়ি। আমিও তাই ভাবি।

জনার্দন। ভেবো পরে। এখন শীঘ্র কিছু একটা করো। এখানে যদি প্রশ্রয় পায় ত আমাকে ঘরে শিকল দিয়ে মানকচুর মত সেদ্ধ করে ছাড়বে।

শিরোমণি। ব্যাটারা গুরুর দোহাই মানবে না। ডাকাত কিনা! হয়ত বা ব্রহ্মহত্যাই করে বসবে। (শিহরিয়া উঠিলেন)

জনার্দন। আর শুধু কি কেবল বাড়ি? আমার কত ধানের গোলা, কত খড়ের মাড়, সবসুদ্ধ যদি—

শিরোমণি। দেখ ভায়া, আমি বরঞ্চ দিন-কতক শিষ্যবাড়ি থেকে ঘুরে আসি গে।

জনার্দন। কিন্তু আমার ত শিষ্যবাড়ি নেই? আর থাকলেও ত ধানের গোলা, খড়ের মাড় নিয়ে শিষ্যবাড়ি ওঠা যায় না?

শিরোমণি। না। গেলেও ও সকল ফিরিয়ে আনা কঠিন। আজকালকার শিষ্য-সেবকদের মতিগতিও হয়েছে অন্য প্রকার।

এককড়ি। চারিদিকে কড়া পাহারা মোতায়েন করে রাখুন।

জনার্দন। তা ত রেখেচি, কিন্তু পাহারা কি তোমাদেরই কম ছিল এককড়ি!

এককড়ি। আর একটা কথা শুনেছেন? ভূমিজ প্রজারা গিয়ে কাল আদালতে নালিশ করে এসেছে। শুনচি কান্নাকাটি শুনে স্বয়ং হাকিম আসবেন সরজমিন তদারকে।

জনার্দন। বল কি হে! চণ্ডীগড়ে বাস করে জমিদার আর আমার নামে নালিশ?

শিরোমণি। শিষ্যগণের আহ্বান উপেক্ষা করা আমার কর্তব্য নয় জনার্দন।

এককড়ি। দেখুন আস্পর্ধা! জীবনে বেশীদিন যারা পেটভরে খেতে পায় না, শীতের রাতে যারা বসে কাটায়, মড়কের দিনে যারা কুকুর-বেড়ালের মত মরে—

জনার্দন। আবার আবাদের দিনে একমুঠা বীজের জন্যে আমারই দরজার বাইরে পড়ে হত্যা দেয়—

এককড়ি। সেই নিমকহারাম ব্যাটারা আদালতে দাঁড়াবার টাকা পেলেই বা কোথা? এ দুর্মতি দিলেই বা তাদের কে?

জনার্দন। এই সোজা কথাটা ব্যাটারা বোঝে না যে, কেবল জেলে আদালতেই নয় হাইকোর্ট বলেও একটা-কিছু আছে যেখানে জীবানন্দ চৌধুরী, জনার্দন রায়কে ডিঙিয়ে সাগর সর্দার যেতে পারে না।

এককড়ি। নিশ্চয়। টাকা যার মোকদ্দমা তার। আপনার অর্থ আছে, সামর্থ্য আছে, ব্যারিস্টার জামাই আছে, কত উকিল-মোক্তার আছে; নালিশ যদি করেই, আপনার ভাবনা কিসের?

জনার্দন। (চিন্তিতভাবে) না এককড়ি, কেবল জমি বিক্রিই ত নয় (ইঙ্গিত করিয়া) আরো যে-সব কাজ করা গেছে, ফৌজদারী দণ্ডবিধি কেতাবের পাতায় পাতায় তার ফলশ্রুতি ত সহজ নয়!

এককড়ি। তা জানি। কিন্তু এই ছোটলোক চাষার দল হাকিমের কাছে আমল পেলে ত!

জনার্দন। বলা যায় না; এই কথাই আজ তোমার মনিবের কাছে পাড়ো গে। এখন চললাম।

এককড়ি। আসুন। আমিও ইতিমধ্যে একটা কাজ সেরে রাখি গে।

[শিরোমণি, এককড়ি ও জনার্দনের প্রস্থান

[কথা কহিতে কহিতে জীবানন্দ ও প্রফুল্ল প্রবেশ করিলেন]

জীবানন্দ। না প্রফুল্ল, সে হয় না। মাঠের জল-নিকাশী সাঁকো তৈরির পয়সা যদি নায়েবমশায়ের তবিলে না থাকে ত এখানকার বাড়ি মেরামতও বন্ধ থাক।

প্রফুল্ল। বেশ থাক। কিন্তু দেশে ফিরে চলুন।

জীবানন্দ। না।

প্রফুল্ল। না কিরকম? এ বাড়িতে আপনি থাকবেন কি করে?

জীবানন্দ। যেমন করে আছি। এ সহ্য হয়ে যাবে। মানুষের অনেক কিছুই সয় প্রফুল্ল।

প্রফুল্ল। সয় না দাদা, তারও সীমা আছে। শরীরটা যে হঠাৎ ভয়ানক ভেঙ্গে গেল। বর্ষা সুমুখে। এই ভাঙ্গা মন্দিরে কি এই ভাঙ্গা দেহে সে দুর্যোগ সইবে? রক্ষে করুন, এবার বাড়ি চলুন।

জীবানন্দ। (হাসিয়া) এই ভাঙ্গা দেহের দেহ-তত্ত্বের আলোচনা আর একদিন করা যাবে ভায়া, এখন কিন্তু নায়েবকে চিঠি লিখে দাও এ টাকা আমার চাই-ই। প্রজারা বছর বছর টাকা যোগাচ্ছে আর মরচে, এবার তাদের মরণ আটকাতে যদি জমিদারিটা মরে ত মরুক না।

[দ্রুতপদে জনার্দনের প্রবেশ]

জনার্দন। হুজুর কি নিজে—স্বয়ং হুকুম দিয়ে আমার—

জীবানন্দ। কি হুকুম রায়মশায়?

জনার্দন। আমার পুকুরধারের জায়গায় বেড়া ভেঙ্গে মন্দিরের জমির সঙ্গে এক করিয়ে দিয়েছেন?

জীবানন্দ। কোন্‌ জায়গাটা বলছেন? যেখানে বছর-কুড়ি পূর্বে মন্দিরের গোশালা ছিল?

জনার্দন। আমি ত জানিনে কবে আবার—

জীবানন্দ। অনেকদিন হয়ে গেল কিনা! বোধ হয় নানা কাজের ঝঞ্ঝাটে কথাটা ভুলে গেছেন।

জনার্দন। (দুঃসহ ক্রোধ দমন করিয়া) কিন্তু এ-সব করার আগে হুজুর ত আমার কাছে একটা খবর পাঠাতে পারতেন।

জীবানন্দ। খবর পৌঁছোবেই জানি। দু’দণ্ড আগে আর পরে। কিছু মনে করবেন না।

জনার্দন। কিন্তু আগে জানলে মামলা-মকদ্দমা হয়ত বাধত না।

জীবানন্দ। এতেও বাধা দেওয়া উচিত নয় রায়মশায়। ভৈরবীদের হাতে দেবীর বহু সম্পত্তিই বেহাত হয়ে গেছে। এখন সেগুলো হাত-বদল হওয়া দরকার।

জনার্দন। (শুষ্ক হাস্য করিয়া) তার চেয়ে আর ভালো কথা কি আছে হুজুর। শুনতে পাই সমস্ত গ্রামখানাই একদিন মা-চণ্ডীর ছিল। এখন কিন্তু—

জীবানন্দ। জমিদারের গর্ভে গেছে? তা গেছে। তারও ত্রুটি হবে না রায়মশায়! মন্দিরের দলিল, নকশা, ম্যাপ প্রভৃতি যা-কিছু আছে কলকাতায় এটর্নির বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমার একলার সাধ্য কি? আপনারা এ-কাজে আমার সহায় থাকবেন।

জনার্দন। থাকব বৈ কি হুজুর। আমরা চিরকাল হুজুর সরকারের চাকর বৈ ত নয়।

[জনার্দন প্রস্থান করিল। জীবানন্দ সকৌতুক হাসিমুখে তাহার প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া ক্ষণকাল নীরবে দাঁড়াইয়া রহিলেন]

প্রফুল্ল। দাদা কি শেষে একটা লঙ্কাকাণ্ড বাধাবেন নাকি?

জীবানন্দ। যদি বাধে সে ভাগ্যের কথা প্রফুল্ল। তার জন্যে দেবতাদের একদিন তপস্যা করতে হয়েছিল।

প্রফুল্ল। দেবতারা পারেন। লঙ্কার বাইরে বসে তপস্যা করায় পুণ্যও আছে, দুশ্চিন্তাও কম। কিন্তু লঙ্কার ভিতরে যারা বাস করে, লঙ্কাকাণ্ডের ব্যাপারে তাদের ভাগ্যকে ঠিক সৌভাগ্য বলা চলে না। এসে পর্যন্ত গ্রামসুদ্ধ লোকের সঙ্গে বিবাদ করে বেড়ানো আপনার গৌরবেরও নয়, প্রয়োজনও নয়। ইতিমধ্যে নানাপ্রকার কার্যই ত করা গেল, এখন ক্ষান্ত দিয়ে চলুন বাড়ি ফিরে যাওয়া যাক।

জীবানন্দ। সময় হলেই যাব।

প্রফুল্ল। তাই যাবেন। যাই হোক দাদা, আপনার যাবার সময়ের তবু একটা আন্দাজ পাওয়া গেল, কিন্তু আমার যাবার সময় যে কবে আসবে তার কূল-কিনারাও চোখে পড়ে না।

[এককড়ির প্রবেশ]

এককড়ি। মিস্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে। পুলের কাজটা কোথা থেকে আরম্ভ হবে জানতে চায়।

জীবানন্দ। চল না প্রফুল্ল, একবার মাঠে গিয়ে তাদের কাজটা দেখিয়ে আসি গে।

প্রফুল্ল। চলুন।

[জীবানন্দ প্রফুল্লকে লইয়া বাহির হইয়া গেলেন। অন্যদিক দিয়া শিরোমণি ও জনার্দন রায় প্রবেশ করিলেন]

জনার্দন। বাবু গেলেন কোথায় এককড়ি?

এককড়ি। মিস্ত্রীকে দেখাতে গেলেন। মাঠে সাঁকো তৈরি হবে।

জনার্দন। পাগলের খেয়াল।

শিরোমণি। মদ্যপান-জনিত বুদ্ধি-বিকৃতি।

এককড়ি। এই শনিবারে হাকিম সরজমিন-তদন্তে আসবেন। ছোটলোক ব্যাটাদের বুদ্ধি এবং টাকা কে যোগাচ্চে ঠিক জানতে পারলাম না, কিন্তু এইটুকু জানতে পারলাম তারা সাক্ষী মানলে হুজুর গোপন কিছুই করবেন না। দলিল তৈরির কথা পর্যন্ত না।

জনার্দন। (সহাস্যে) আমার বয়সটা কত হয়েচে ঠাওরাও এককড়ি? চণ্ডীগড়ের জনার্দন রায়কে ও-ধাপ্পায় কাত করা যাবে না, বাপু, আর কোন মতলব ভেঁজে এসো গো। (একমুহূর্ত মৌন থাকিয়া) তবে, এ কথা মানি তোমার হাতে গিয়ে একটু পড়েচি। মোচড় দিয়ে দু’পয়সা উপরি রোজগারের সময় এই বটে। কিন্তু তাই বলে যা রয় সয় কর।

এককড়ি। সত্যি বলচি আপনাকে রায়মশায়—

জনার্দন। আহা, সত্যিই ত বলচ! এককড়ি নন্দী আবার মিথ্যে কবে বলেন? সে কথা নয় ভায়া, আমার না হয় শ’খানেক বিঘের টান ধরবে, কিন্তু তাঁর নিজের যাবে কত? সেটা কি তোমার মনিব খতিয়ে দেখেন নি? না দেখে থাকেন ত দেখাও গে চোখে আঙুল দিয়ে। তারপরে না হয় আমাকে প্যাঁচ ক’ষো।

এককড়ি। জায়গা-জমির কথাই হচ্চে না রায়মশাই, কথা হচ্চে দলিলপত্র তৈরি করার। জিজ্ঞাসা করলে সমস্তই বলবেন, কিছুই গোপন করবেন না।

জনার্দন। তার হেতু? শ্রীঘরে যাবার বাসনা ত? কিন্তু একা জনার্দন যাবে না এককড়ি, মহারানী হুজুর বলে রেয়াত করবে না, কথাটা তাঁকে ব’লো।

এককড়ি। (অভিমান-সুরে) বলতে হয় আপনি নিজেই বলবেন।

জনার্দন। বলব বৈ কি হে। ভালো করেই বলব। হাকিমের কাছে কবুল জবাব দিয়ে সাধু সাজা ঠাট্টা-তামাশা নয়। (ইঙ্গিতে দেখাইয়া) হাতকড়ি পড়বে।

এককড়ি। সে-আপনি বুঝবেন আর তিনি বুঝবেন।

জনার্দন। আর তুমি? শ্রীমান এককড়ি নন্দী? বাড়ি যখনি পুড়েছে তখনি জানি কি-একটা ভেতরে হচ্চে। কিন্তু জনার্দনকে অত নরম মাটি ঠাউরো না ভায়া, পস্তাবে। নির্মলকে আটকে রেখেচি, সে-ই তোমাদের বুঝিয়ে দেবে। এককড়ি। আমার ওপরে মিথ্যে রাগ করচেন রায়মশায়, যা জানি তাই শুধু জানিয়েচি। বিশ্বাস না হয়, হুজুর ত এই সামনের মাঠেই আছেন, একটু ঘুরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেই যান না।

জনার্দন। তাই যাব। শিরোমণিমশায়, আসুন ত?

শিরোমণি। চল না ভায়া, ভয় কিসের?

[দুই-এক পা অগ্রসর হইয়া সহসা পিছন ফিরিয়া]

শিরোমণি। (এককড়ির প্রতি) বলি, অত্যধিক মদ্যপান করে নেই ত? তা হলে না হয়—

এককড়ি। মদ তিনি খান না! (হঠাৎ কণ্ঠস্বর সংযত করিয়া) কিন্তু যেতেও আর হবে না। হুজুর নিজেই আসছেন।

[জীবানন্দ ও প্রফুল্ল তর্ক করিতে করিতে প্রবেশ করিলেন]

জনার্দন। (কাছে গিয়া স্বাভাবিক ব্যাকুলতার সহিত) হুজুর, সমস্ত ব্যাপার একবার মনে করে দেখুন।

জীবানন্দ। কিসের রায়মশায়?

জনার্দন। জমি-বিক্রির ব্যাপারে হাকিম নিজে আসছেন তদন্ত করতে। হয়ত ভারী মকদ্দমাই বাধবে। কিন্তু আপনি নাকি—

জীবানন্দ। ওঃ! কিন্তু উপায় কি রায়মশায়? সাহেব জমি ছাড়তে চায় না, সে সস্তায় কিনেচে। মকদ্দমা ত বাধবেই। সুতরাং মামলা জেতা ছাড়া প্রজাদের আর ত পথ দেখিনে।

জনার্দন। (আকুল হইয়া) কিন্তু আমাদের পথ?

জীবানন্দ। (ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া) সে ঠিক, আমাদের পথও খুব দুর্গম মনে হয়।

জনার্দন। (মরিয়া হইয়া) এককড়ি তা হলে সত্যই বলেছে! কিন্তু হুজুর, পথ শুধু দুর্গম নয়—জেল খাটতে হবে, এবং আমরা একা নয়, আপনিও বাদ যাবেন না।

জীবানন্দ। (একটুখানি হাসিয়া) তাই বা কি করা যাবে রায়মশায়! শখ করে যখন গাছ পোঁতা গেছে, ফল তার খেতে হবে বৈ কি!

জনার্দন। (চীৎকার করিয়া) এ আমাদের সর্বনাশ করবে এককড়ি।

[পাগলের মত ঝড়ের বেগে জনার্দন বাহির হইয়া গেল, তাহার পিছনে এককড়ি নিঃশব্দে প্রস্থান করিল, নেপথ্যে কোলাহল]

জীবানন্দ।(ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া) কারা যায় প্রফুল্ল?

প্রফুল্ল। বোধ হয় আপনার মাটি-কাটা ধাঙড়-কুলীর দল।

জীবানন্দ। একবার ডাক ত, ডাক ত হে। শুনি আজ বাঁধের কাজ কতখানি করলে।

প্রফুল্ল। (ঈষৎ অগ্রসর হইয়া) ওহে, ও সর্দার? শোন শোন, একবার শুনে যাও।

[স্ত্রী ও পুরুষ কুলীদের প্রবেশ]

সর্দার। কি রে, ডাকচিস্ কেনে?

জীবানন্দ। বাবারা, কোথায় চলেচিস বল্ ত?

সর্দার। ভাত খাবার লাগি রে।

জীবানন্দ। দেখিস বাবারা, আমার বাঁধের কাজ যেন বর্ষার আগেই শেষ হয়।

সকলে। (সমস্বরে) সব হোয়ে যাবে রে, সব হোয়ে যাবে। তুই কিছু ভাবিস্‌ না। চল্।

[কুলীদের প্রস্থান

[নির্মল প্রবেশ করিল]

জীবানন্দ। (সাদরে) আসুন, আসুন, নির্মলবাবু।

নির্মল। (নমস্কার করিয়া) আপনার সঙ্গে আমার একটু কাজ আছে।

জীবানন্দ। আর একদিন হলে হয় না?

নির্মল। না, আমার বিশেষ প্রয়োজন।

জীবানন্দ। তা বটে। অকাজের বোঝা টানতে যাঁকে আটক থাকতে হয় তাঁর সময় নষ্ট করা চলে না।

নির্মল। অকাজ মানুষে করে বলেই ত সংসারে আমাদের প্রয়োজন চৌধুরীমশাই।

জীবানন্দ। কিন্তু কাজের ধারণা ত সকলের এক নয় নির্মলবাবু। রায়মশায়ের আমি অকল্যাণ কামনা করিনে, এবং আপনার উদ্দেশ্য সফল হলে আমি বাস্তবিকই খুশী হব, কিন্তু আমার কর্তব্যও আমি স্থির করে ফেলেছি, এ থেকে নড়চড় করা আর সম্ভব হবে না।

নির্মল। এ কথা কি সত্য যে আপনি সমস্তই স্বীকার করবেন?

জীবানন্দ। সত্য বৈ কি।

নির্মল। এমন ত হতে পারে আপনার কবুল জবাবে আপনিই শুধু শাস্তি পাবেন, কিন্তু আর সকলে বেঁচে যাবেন।

জীবানন্দ। খুব সম্ভব বটে। কিন্তু সেজন্যে আমার কোন অভিযোগ নেই নির্মলবাবু। নিজের কৃতকর্মের ফল আমি একা ভোগ করলেই যথেষ্ট। নইলে রায়মশায় নিস্তার লাভ করে সুস্থদেহে সংসার-যাত্রা নির্বাহ করতে থাকুন এবং আমার এককড়ি নন্দীমশায়ও আর কোথাও গোমস্তাগিরি-কর্মে উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি লাভ করতে থাকুন, কারও প্রতি আমার আক্রোশ নেই।

নির্মল। আত্মরক্ষায় সকলেরই ত অধিকার আছে, অতএব শ্বশুরমশায়কেও করতে হবে। আপনি নিজে জমিদার, আপনার কাছে মামলা-মকদ্দমার বিবরণ দিতে যাওয়া বাহুল্য—শেষ পর্যন্ত হয়ত বা বিষ দিয়ে বিষের চিকিৎসা করতে হবে।

জীবানন্দ। চিকিৎসক কি জাল-করার বিষে খুন করার ব্যবস্থা দেবেন?

নির্মল। (রাগ সংবরণ করিয়া) এমন ত হতে পারে কারও কোন শাস্তিভোগ করারই আবশ্যক হবে না, অথচ ক্ষতিও কাউকে স্বীকার করতে হবে না।

জীবানন্দ। (তৎক্ষণাৎ সম্মত হইয়া) বেশ ত পারেন ভালোই। কিন্তু আমি অনেক চিন্তা করে দেখেচি সে হবার নয়। কৃষকেরা তাদের জমি ছাড়বে না। কারণ এ শুধু অন্নবস্ত্রের কথা নয়, তাদের সাত-পুরুষের চাষ-আবাদের মাঠ, এর সঙ্গে তাদের নাড়ীর সম্পর্ক। এ তাদের নিতেই হবে। (একটু চুপ করিয়া) আপনি ভালোই জানেন, অন্য পক্ষ অত্যন্ত প্রবল, তার উপর জোর-জুলুম চলবে না। চলতে পারে কেবল চাষাদের উপর, কিন্তু চিরদিন তাদের প্রতিই অত্যাচার হয়ে আসছে, আর হতে আমি দেব না।

নির্মল। আপনার বিস্তীর্ণ জমিদারি; এই ক’টা চাষার কি আর তাতে স্থান হবে না? কোথাও না কোথাও—

জীবানন্দ। না না, আর কোথাও না—এই চণ্ডীগড়ে। এইখানে আমি জোর করে সেদিন তাদের কাছে অনেক টাকা আদায় করেছি—আর সে টাকা যুগিয়েছেন জনার্দন রায়। এ ঋণ পরিশোধ করতে আমাকে হবেই, এবং আরও যে কতবড় একটা শূল তাদের বিদ্ধ করেছি, সে কথা শুধু আমিই জানি। কিন্তু যাক। অপ্রীতিকর আলোচনায় আর আমার প্রবৃত্তি নেই নির্মলবাবু, আমি মনস্থির করেছি।

[জীবানন্দ প্রস্থান করিলেন।

[সেই দিকে চাহিয়া নির্মল অভিভূতের ন্যায় স্থির হইয়া রহিল। এমনি সময়ে ফকিরসাহেব প্রবেশ করিলেন]

ফকির। জামাইবাবু, সেলাম। বাবু কৈ?

নির্মল। (অভিবাদন করিয়া) জানিনে। ফকিরসাহেব, ষোড়শীকে আমাদের বড় প্রয়োজন। তিনি যেখানেই থাকুন একবার আমাকে দেখা করতেই হবে। বলুন, কোথায় আছেন।

ফকির। আপনাকে জানাতে আমার বাধা নেই। কারণ, একদিন যখন সবাই তাঁর সর্বনাশে উদ্যত হয়েছিল, তখন আপনিই শুধু তাঁকে রক্ষা করতে দাঁড়িয়েছিলেন।

নির্মল। আজ আবার ঠিক সেইটি উলটে দাঁড়িয়েচে ফকিরসাহেব। এখন, কেউ যদি তাঁদের বাঁচাতে পারে ত শুধু তিনিই। কোথায় আছেন এখন?

ফকির। শৈবালদীঘির কুষ্ঠাশ্রমে।

নির্মল। কুষ্ঠাশ্রমে? সেখানে কি সুখে আছেন?

ফকির। (মৃদু হাসিয়া) এই নিন! মেয়েমানুষের সুখে থাকার খবর দেবতারা জানেন না, আমি ত আবার সন্ন্যাসীমানুষ। তবে, মা আমার শান্তিতে আছেন এইটুকুই অনুমান করতে পারি।

নির্মল। (ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া) এখানে আপনি কোথায় এসেছিলেন?

ফকির। জমিদার জীবানন্দের এই চিঠি পেয়ে তাঁরই সঙ্গে একবার দেখা করতে। এই চিঠি আপনাদের পড়া প্রয়োজন। নিন পড়ুন। (চিঠিখানি দিতে গেলেন)

নির্মল। (সসঙ্কোচে) জীবানন্দের লেখা? ও আমি ছোঁব না। প্রয়োজন থাকে আপনিই পড়ুন।

ফকির। প্রয়োজন আছে। নইলে বলতাম না। পত্র আমাকেই লেখা।

[ফকির ধীরে ধীরে চিঠিখানি পড়িতে লাগিলেন এবং নির্মলের মুখের ভাব সংশয় ও বিস্ময়ে কঠিন হইয়া উঠিতে লাগিল]

ফকির। (পত্র পাঠ—)

“ফকির সাহেব,—

ষোড়শীর আসল নাম অলকা। সে আমার স্ত্রী। আপনার কুষ্ঠাশ্রমের কল্যাণ কামনা করি, কিন্তু তাহাকে দিয়া কোন ছোট কাজ করাইবেন না। আশ্রম যেখানে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন সে আমার নয়, কিন্তু তাহার সংলগ্ন শৈবালদীঘি আমার। এই গ্রামের মুনাফা প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার টাকা। আপনাকে জানি। কিন্তু আপনার অবর্তমানে পাছে কেহ তাহাকে নিরুপায় মনে করিয়া অমর্যাদা করে, এই ভয়ে আশ্রমের জন্যই গ্রামখানি তাহাকে দিলাম। আপনি নিজে একদিন আইন-ব্যবসায়ী ছিলেন, এই দান পাকা করিয়া লইতে যাহা কিছু প্রয়োজন, করিবেন, সে খরচ আমিই দিব। কাগজপত্র প্রস্তুত করিয়া পাঠাইলে আমি সহি করিয়া রেজেস্টারি করিয়া দিব।

শ্রীজীবানন্দ চৌধুরী”

ফকির। (নির্মলের মুখের ভাব লক্ষ্য করিয়া) সংসারে কত বিস্ময়ই না আছে!

নির্মল। (দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া, ঘাড় নাড়িয়া) হাঁ। কিন্তু এ যে সত্য তার প্রমাণ কি?

ফকির। সত্য না হলে এ দান নেবার জন্যে ষোড়শীকে কিছুতেই আনতে পারতাম না।

নির্মল। (ব্যগ্রকণ্ঠে) কিন্তু তিনি কি এসেচেন? কোথায় আছেন?

ফকির। আছেন আমার কুটীরে, নদীর পরপারে।

নির্মল। আমার যে এখনি একবার যাওয়া চাই ফকিরসাহেব।

ফকির। চলুন। (হাসিয়া) কিন্তু বেলা পড়ে এল, আবার না তাঁকে হাত ধরে রেখে যেতে হয়।

[উভয়ের প্রস্থান

[সহসা অন্তরাল হইতে কয়েকজনের সতর্ক, চাপা কোলাহলের মধ্য হইতে প্রফুল্লর কণ্ঠস্বর স্পষ্ট শোনা গেল—“সাবধানে! সাবধানে! দেখো যেন ধাক্কা না লাগে!” এবং পরক্ষণেই তাহারা ধরাধরি করিয়া জীবানন্দকে বহিয়া আনিয়া বিছানায় শোয়াইয়া দিল। তাঁহার চক্ষু মুদ্রিত। সঙ্গে প্রফুল্ল]

প্রফুল্ল। এখন কেমন মনে হচ্চে দাদা?

জীবানন্দ। ভালো না। আমি অজ্ঞান হয়ে সাঁকো থেকে পড়ে গিয়েছিলাম প্রফুল্ল?

প্রফুল্ল। না দাদা, আমরা ধরে ফেলেছিলাম। কতবার বলছি এ রুগ্নদেহে এত পরিশ্রম সইবে না, কিছুতে কান দিলেন না। কি সর্বনাশ করলেন বলুন ত?

জীবানন্দ। (চক্ষু মেলিয়া) সর্বনাশ কোথায় প্রফুল্ল, এই ত আমার পার হবার পাথেয়। এ ছাড়া এ জীবনে আর সম্বল ছিল কৈ?

[দ্রুতবেগে এককড়ি প্রবেশ করিল, তাহার হাতে একটা কাঁচের শিশি]

এককড়ি। (প্রফুল্লের প্রতি) এখ্‌খুনি হুজুরকে এটা খাইয়ে দিন। বল্লভ ডাক্তার দৌড়ে আসছে এলো বলে।

প্রফুল্ল। (শিশি হাতে লইয়া জীবানন্দের কাছে গিয়া) দাদা! এই ওষুধটুকু যে খেতে হবে।

জীবানন্দ। (চক্ষু মুদ্রিত) খেতে হবে? দাও। (ঔষধ পান করিয়া) কোথায় যেন ভয়ানক ব্যথা প্রফুল্ল, যেন এ ব্যথার আর সীমা নেই। উঃ—

প্রফুল্ল। (ব্যকুল-কণ্ঠে) এককড়ি, দেখ না একবার ডাক্তার কত দূরে—যাও না আর একবার ছুটে।

এককড়ি। ছুটেই যাচ্চি বাবু—

[দ্রুতপদে প্রস্থান

জীবানন্দ। ছুটোছুটিতে আর কি হবে প্রফুল্ল? মনে হচ্চে যেন আজ আর তোমরা ছুটে আমার নাগাল পাবে না।

প্রফুল্ল। (নিকটে হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া) এমন ত কতবার হয়েছে, কতবার সেরে গেছে দাদা। আজ কেন এ-রকম ভাবছেন?

জীবানন্দ। ভাবছি? না প্রফুল্ল, ভাবিনি। (ঈষৎ হাসিয়া) অসুখ বহুবার হয়েছে এবং বহুবার সেরেছে সে ঠিক। কিন্তু এবার যে আর কিছুতেই সারবে না সেও ত এমনিই ঠিক প্রফুল্ল।

[এককড়ি ও বল্লভ ডাক্তারের প্রবেশ]

প্রফুল্ল। (উঠিয়া দাঁড়াইয়া) আসুন ডাক্তারবাবু।

বল্লভ। হুজুরের অসুখ—ছুটতে ছুটতে আসচি। ওষুধটা খাওয়ানো হয়েছে ত?

এককড়ি। হয়েচে ডাক্তারবাবু, তখ্‌খুনি হয়েছে। ওষুধের শিশি হাতে উঠি ত পড়ি করে ছুটে এসেছি।

[বল্লভ কাছে আসিয়া বসিল। কিছুক্ষণ ধরিয়া নাড়ী পরীক্ষা করিয়া মুখ বিকৃত করিল। মাথা নাড়িয়া প্রফুল্লকে ইঙ্গিতে জানাইল যে অবস্থা ভালো ঠেকিতেছে না]

এককড়ি। (আকুল-কণ্ঠে) কি হবে ডাক্তারবাবু! খুব ভাল জোরালো একটা ওষুধ দিন—আমরা ডবল ভিজিট দেব—যা চাইবেন দেব—

প্রফুল্ল। যা চাইবেন দেব? শুধু এই? সে আর কতটুকু এককড়ি? আমরা তারও অনেক, অনেক বেশি দেব। আমার নিজের প্রাণের দাম বেশি নয়, কিন্তু সে দেওয়াও ত আজ অতি তুচ্ছ মনে হয় ডাক্তারবাবু।

বল্লভ। (উপরের দিকে মুখ তুলিয়া) সমস্তই ওঁর হাতে প্রফুল্লবাবু, নইলে আমার আর কি! নিমিত্তমাত্র। লোকে শুধু মিথ্যে ভাবে বৈ ত না যে, চণ্ডীগড়ের বল্লভ ডাক্তার মরা বাঁচাতে পারে! ওষুধের বাক্স সঙ্গেই এনেছি, এ-সব ভুল আমার হয় না। চলুন নন্দীমশাই, শিগ্‌গির একটা মিক্‌চার তৈরি করে দিই।

[এককড়ি ও বল্লভের প্রস্থান

জীবানন্দ। চোখ বুজে শুয়ে কত কি মনে হচ্ছিল প্রফুল্ল। মনে হচ্ছিল, আশ্চর্য এই পৃথিবী। নইলে আমার জন্যে চোখের জল ফেলতে তোমাকে পেয়েছিলাম কি করে?

প্রফুল্ল। আপনি ত জানেন—

জীবানন্দ। জানি বৈ কি প্রফুল্ল! কিন্তু এককড়ি তার কি জানে? সে জানে তারই মত তুমিও শুধু একজন কর্মচারী, এক পাষণ্ড জমিদারের তেমনি অসাধু সঙ্গী। কত যে করেছ, নীরবে কত যে সয়েছ, বাইরের লোকে তার কি খবর রাখে। মাঝে মাঝে যখন অসহ্য হয়েচে দুটো ভাতডাল যোগাড়ের ছল করে ত্যাগ করে যেতে চেয়েছ, কিন্তু যেতে আমি দিইনি। আজ ভাবি ভালোই করেচি। সত্যই ছেড়ে চলে যদি যেতে প্রফুল্ল, আজকের দুঃখ রাখবার জায়গা পেতে কোথায়?

প্রফুল্ল। দাদা—

জীবানন্দ। একটুখানি কাগজ-কলম আনো না প্রফুল্ল, তোমার দাদার স্নেহের দান—

প্রফুল্ল। (পদতলে নতজানু হইয়া বসিয়া) স্নেহ আপনার অনেক পেয়েছি দাদা, সেই শুধু আমার সম্বল হয়ে থাক। আপনি কেবল আমাকে এই আশীর্বাদ করুন, নিজের পরিশ্রমে যা-কিছু পাই এ জীবনে তার বেশি না লোভ করি।

জীবানন্দ। (ক্ষণকাল নিস্তব্ধ থাকিয়া) বেশ, তাই হোক প্রফুল্ল। দান করে তোমাকে আমি খাটো করে যাব না। কিন্তু লোভী তুমি ত কোনদিনই নও!

[বল্লভ নিঃশব্দে প্রবেশ করিয়া ঔষধের পাত্র প্রফুল্লের হাতে দিয়া তেমনি নিঃশব্দে প্রস্থান করিল]

প্রফুল্ল। দাদা! এই ওষুধটুকু খান।

[প্রফুল্ল কাছে আসিয়া ঔষধ জীবানন্দের মুখে ঢালিয়া দিয়া নিজের কোঁচার খুঁট দিয়া তাঁহার ওষ্ঠপ্রান্ত মুছাইয়া দিল]

জীবানন্দ। কি ভয়ানক অন্ধকার প্রফুল্ল! রাত্রি কত হলো ভাই?

প্রফুল্ল। রাত্রি ত এখনো হয়নি দাদা।

জীবানন্দ। হয়নি? তবে আমার দু’চক্ষে এ নিবিড় আঁধার কিসের প্রফুল্ল?

প্রফুল্ল। অন্ধকার ত নেই দাদা! এখনো যে সূর্যাস্তও হয়নি।

জীবানন্দ। হয়নি? যায়নি সূর্য এখনো ডুবে? তবে খোল, খোল,—আমার সুমুখের জানালা খুলে দাও প্রফুল্ল, একবার দেখি তাঁকে। যাবার আগে আমার শেষ নমস্কার তাঁকে জানিয়ে যাই।

[প্রফুল্ল সম্মুখের বাতায়ন খুলিয়া দিল এবং কাছে আসিয়া জীবানন্দের ইঙ্গিত-মত তাঁহার মাথাটি সযত্নে উঁচু করিয়া দিল। অদূরে বারুইয়ের শীর্ণ জলধারা মন্দবেগে বহিতেছে। পরপারে সূর্য অস্তগমনোম্মুখ। দূরে নীল বনানী আরক্ত আভায় রঞ্জিত। তটে ধূসর বালুকারাশি উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে]

জীবানন্দ। (চোখ মেলিয়া কম্পিত দুই হস্ত যুক্ত করিয়া ললাটে স্পর্শ করাইলেন। ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া) বিশ্বদেব! কে বলে তুমি অচেনা? তুমি চির-রহস্যে ঢাকা?

জন্মান্তরের সহস্র পরিচয় যে আজ যাবার দিনে তোমার মুখে স্পষ্ট দেখতে পেলাম। (একমুহূর্ত নীরব থাকিয়া) ভেবেছিলাম, হয়ত তোমাকে দেখে ভয় হবে—হয়ত এ জীবনের শতেক গ্লানি দীর্ঘ কালো ছায়া মেলে আজ মুখ তোমার ঢেকে দেবে, কিন্তু সে ত হতে দাওনি! বন্ধু, এ-জন্মের শেষ নমস্কার তুমি গ্রহণ কর। (শ্রান্তিতে ঢলিয়া পড়িয়া) উঃ— কি ব্যথা!

প্রফুল্ল। (ব্যাকুল কণ্ঠে) ব্যথা কোথায় দাদা?

জীবানন্দ। কোথায়? মাথায়, বুকে, আমার সর্বাঙ্গে, প্রফুল্ল—উঃ—

[দ্রুতপদে ষোড়শী প্রবেশ করিল। তাহার পশ্চাতে এককড়ি ও বল্লভ ডাক্তার]

ষোড়শী। এ কি কথা এরা সব বলে প্রফুল্ল! (জীবানন্দের পদতলে বসিয়া পড়িল) তোমাকে নিয়ে যাবার জন্যে যে আজ সমস্ত ছেড়ে চলে এসেচি! কিন্তু নিষ্ঠুর—অভিমানে এ কি করলে তুমি!

প্রফুল্ল। দাদা, চেয়ে দেখুন অলকা এসেছেন।

জীবানন্দ। অলকা? এলে তুমি? (ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়া) কিন্তু, সময় নেই আর।

ষোড়শী। কিন্তু, এই যে সেদিন বললে, তুমি সংসারে বাঁচতে চাও—মানুষের মাঝখানে মানুষের মত হয়ে। তুমি বাড়ি চাও, ঘর চাও, স্ত্রী চাও, সন্তান চাও—

জীবানন্দ। (মাথা নাড়িয়া) না। আজ ফাঁকি দিয়ে আর কিছুই চাইনে অলকা। চিরদিন কেবল ফাঁকি দিয়ে পেয়ে পেয়েই স্পর্ধা বেড়ে গিয়েছিল, ভেবেছিলাম, এমনিই বুঝি। কিন্তু আজ! তার কৈফিয়ত দেবার দিন এসেছে। সৌভাগ্য এ-জীবনে অর্জন করিনি অলকা, সেই ত ঋণ—সে বোঝা আর যেন আমার না বাড়ে।

[ষোড়শী জীবানন্দের বুকের উপরে মাথা রাখিতে তিনি ধীরে ধীরে তাঁহার অক্ষম হাতখানি ষোড়শীর মাথার পরে রাখিলেন]

জীবানন্দ। অভিমান ছিল বৈ কি একটু। তবু যাবার আগে এই ত তোমাকে পেলাম। এর অধিক পাওয়া সংসারের নিত্য কাজে হয়ত বা কখনো ক্ষুণ্ণ, কখনো বা ম্লান হতো, কিন্তু সে ভয় আর রইল না। এ মিলনের আর বিচ্ছেদ নেই, অলকা, এই ভালো। এই ভালো।

[ষোড়শী কথা কহিতে পারিল না, দুঃসহ রোদনের বেগে তাহার সমস্ত বক্ষ ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতে লাগিল]

জীবানন্দ। উঃ! পৃথিবীতে কি আর হাওয়া নেই প্রফুল্ল?

প্রফুল্ল। কষ্ট কি খুব বেশি হচ্চে দাদা? ডাক্তারকে কি একবার ডাকব?

জীবানন্দ। না না, আর ডাক্তার-বদ্যি নয় প্রফুল্ল, শুধু তুমি আর অলকা। উঃ—কি অন্ধকার! সূর্য কি অস্ত গেল ভাই?

প্রফুল্ল। এইমাত্র গেল দাদা।

জীবানন্দ। তাই। হাওয়া নেই, আলো নেই, বিশ্বদেব! এ-জীবনের শেষ দান কি তবে নিঃশেষ করেই নিলে! উঃ—

ষোড়শী। স্বামী!

প্রফুল্ল। প্রফুল্লকে কি আজ সত্যিই ছুটি দিলে দাদা!

error: Content is protected !!