স্বদেশ ও সাহিত্য

আমার কথা

হাবড়া জেলা কংগ্রেস-কমিটির আমি ছিলাম সভাপতি। আমি ও আমার সহকারী বা সহকর্মী যাঁরা ছিলেন, তাঁরা সকলেই পদত্যাগ করেছেন। এই কথাটা জানাবার জন্যেই আজকের এই সভার আয়োজন। নইলে সাড়ম্বরে বক্তৃতা শোনাবার জন্যে আপনাদের আহ্বান করে আনিনি। ভারতবর্ষের জাতীয় মহাসভার এই ক্ষুদ্র শাখার যে কর্মভার আমার প্রতি ন্যস্ত ছিল তা থেকে বিদায় নেবার কালে আপনাদের কাছেই মুক্তকণ্ঠে তার হেতু প্রকাশ করাই এই সভার উদ্দেশ্য। একটা কথা উঠেছিল, চুপি চুপি সরে গেলেই ত হতো; এই লজ্জাকর ঘটনা এমন ঘটা করে জানাবার কি প্রয়োজন ছিল? আমার মনে হয় প্রয়োজন ছিল, মনে হয় নিঃশব্দে চুপি চুপি সরে গেলে চক্ষুলজ্জাটা বাঁচত, কিন্তু তাতে সত্যকার লজ্জা চতুর্গুণ হয়ে উঠত। এর পরে এ জেলায় কংগ্রেস কমিটি থাকবে কি থাকবে না, আমি জানিনে। থাকতে পারে, না থাকাও বিচিত্র নয়; কিন্তু সে যাই হোক ভেতরে যার ক্ষত, বাইরে তাকে অক্ষত দেখানোর পাপ আমি করতে চাইনে। এ একটা policy হতে পারে, কিন্তু ভাল policy বলে কোন মতেই ভাবতে পারিনে।

আমি কর্মী নই, এ গুরুভারের যোগ্য আমি ছিলাম না। অক্ষমতার ক্ষোভ আমার মনের মধ্যে আছেই, কিন্তু যে ভার একদিন গ্রহণ করেছিলাম, আজ তাকে অকারণে বা নিছক স্বার্থের দায়ে ত্যাগ করে যাচ্ছি, যাবার সময় এ কলঙ্কও আমার প্রাপ্য নয়। আমার এই কথাটাই আজ আপনাদের একটু ধৈর্য ধরে শুনতে হবে।

আমার মনের মধ্যে হয়ত রূঢ় কথা কোথাও একটু থেকে যেতে পারে, হয়ত আমার অভিযোগের মধ্যে অপ্রিয় সুরও আপনাদের কানে বাজবে, কিন্তু আমাদের বর্তমান অবস্থায় যা সত্য বলে জেনেছি বা বুঝেছি, আপনাদের গোচর না করে আজ আমার ছুটি হতেই পারে না। কারণ, সত্য গোপন করা আত্মবঞ্চনারই সমান। এক আশঙ্কা প্রতিপক্ষের উপহাস ও বিদ্রূপ। কিন্তু নিজের কর্মফলে তাই যদি অর্জন করে থাকি, আমি ছাড়া সে আর কে নেবে? আর তা যদি না হয়ে থাকে, বিদ্রূপের হেতু যদি সত্যই না ঘটে থাকে ত ভয় কিসের? যথার্থ সম্মানের বস্তুকে যে মূঢ় অযথা ব্যঙ্গ করে, সমস্ত লজ্জা ত তারই। অতএব, এ-সকল মিথ্যা দুশ্চিন্তা আমার নেই। আমার একমাত্র চিন্তা অকপটে আপনাদের কাছে সমস্ত ব্যক্ত করা। কারণ, প্রতিকারের ইচ্ছা ও শক্তি আপনাদেরই হাতে। এই শেষ মুহূর্তেও যদি একে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে চান, সে শুধু আপনারাই পারেন।

পাঞ্জাব অত্যাচার উপলক্ষে বছর-দেড়েক পূর্বে একদিন যখন দেশব্যাপী আন্দোলন উত্তাল হয়ে উঠেছিল, তখন আমরা আকাশজোড়া চীৎকারে চেয়েছিলাম স্বরাজ। মহাত্মাজীর জয় জয়কার। গলা ফাটিয়ে দিগ্বিদিকে প্রচার করে বলেছিলাম, স্বরাজ চাই-ই চাই। স্বাধীনতায় মানুষের জন্মগত অধিকার। এবং স্বরাজ ব্যতিরেকে কোন অন্যায়েরই কোন দিন প্রতিবিধান হতে পারবে না। কথাটা যে মূলতঃ সত্য, এ বোধ করি কেহই অস্বীকার করতে পারে না। বাস্তবিকই স্বাধীনতায় মানবের জন্মগত অধিকার, ভারতবর্ষের শাসনভার ভারতবর্ষীয়দের হাতেই থাকা চাই এবং এ দায়িত্ব থেকে যে-কেউ তাদের বঞ্চিত করে রাখে, সেই অন্যায়কারী। এ সবই সত্য। কিন্তু এমনি আরও ত একটা কথা আছে, যাকে স্বীকার না করে পথ নেই,—সে হচ্ছে আমাদের কর্তব্য।

তরুণের বিদ্রোহ

বন্ধুগণ,

নিজের জীবন এলো যখন সমাপ্তির দিকে, তখন ডাক পড়লো আমার দেশের এই যৌবন-শক্তিকে সম্বোধন ক’রে তাদের যাত্রাপথের সন্ধান দিতে। নিজের মধ্যে কর্মশক্তি যখন নিঃশেষিতপ্রায়, উদ্যম ক্লান্ত, প্রেরণা ক্ষীণ, তখন তরুণের অপরিমেয় প্রাণধারার দিক-নির্ণয়ের ভার পড়লো এক বৃদ্ধের উপর। এ আহ্বানে সাড়া দিবার শক্তি-সামর্থ্য নেই—সময় গেছে। এ আহানে বুকের মধ্যে শুধু বেদনার সঞ্চার করে। মনে হয়, একদিন আমারও সবই ছিল—যৌবন, শক্তি, স্বাস্থ্য, সকলের কাজে আপনাকে মিশিয়ে দেবার আনন্দবোধ—এই যুব—সংঘের প্রত্যেকটি ছেলের মতই,—কিন্তু সে বহুদিন পূর্বেকার কথা। সেদিন জীবন-গ্রন্থের যে-সকল অধ্যায় ঔদাস্য ও অবহেলায় পড়িনি, এই প্রত্যাসন্ন পরীক্ষার কালে তার নিষ্ফলতার সান্ত্বনা আজ কোন দিকেই চেয়ে আমার চোখে পড়ে না। আমি জানি, এই তরুণ-সংঘকে জোর ক’রে বলবার কোন সঞ্চয়ই আমার নেই। তাদের পথ-নির্দেশের গুরুতর দায়িত্ব আমার সাজে না; সে কল্পনাও আমি করিনে। আমি কেবল গুটি-কয়েক বহুপরিচিত পুরাতন কথা তোমাদের স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য এখানে উপস্থিত হয়েছি।

পেশা আমার সাহিত্য; রাজনীতি-চর্চা হয়ত আমার অনধিকার চর্চা, এ কথাও এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। আরও একটা কথা প্রথমেই বলা দরকার, সে আমার নিজের লেখার সম্বন্ধে। আমার বইগুলির সঙ্গে যারা পরিচিত, তারাই জানে আমি কোন দিন কোন ছলেই নিজের ব্যক্তিগত অভিমত জোর ক’রে কোথাও গুঁজে দেবার চেষ্টা করিনি। কি পারিবারিক, কি সামাজিক, কি ব্যক্তিবিশেষের জীবন-সমস্যায় আমি শুধু বেদনার বিবরণ, দুঃখের কাহিনী, অবিচারের মর্মান্তিক জ্বালার ইতিহাস, অভিজ্ঞতার পাতার উপরে পাতা কল্পনার কলম দিয়ে লিপিবদ্ধ করে গেছি—এইখানেই আমার সাহিত্য-রচনার সীমারেখা। জ্ঞানতঃ কোথাও একে লঙ্ঘন করতে আমি নিজেকে দিইনি। সেই জন্যেই লেখার মধ্যে আমার সমস্যা আছে, সমাধান নেই; প্রশ্ন আছে, তার উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ এ আমার চিরদিনের বিশ্বাস যে সমাধানের দায়িত্ব কর্মীর, সাহিত্যিকের নয়। কোথায় কোন্‌টা ভাল, কোন্‌টা মন্দ; বর্তমান কালে কোন্‌ পরিবর্তন উপযোগী, এবং কোন্‌টার সময় আজও আসেনি, সে বিবেচনার ভার আমি সংস্কারকের উপরে রেখেই নিশ্চিন্তমনে বিদায় নিয়েছি; আজকে এই কয় ছত্র লেখার মধ্যেও তার অন্যথা করিনি। এখানেও সেই সমস্যা আছে, তার জবাব নেই। কারণ জবাব দেবার ভার বাঙ্গালার তরুণ-সংঘের—এ বৃদ্ধের নয়। সেইটাই এই অভিভাষণের বড় কথা।

নারীর মূল্য

মণি-মাণিক্য মহামূল্য বস্তু, কেন না, তাহা দুষ্প্রাপ্য। এই হিসাবে নারীর মূল্য বেশী নয়, কারণ, সংসারে ইনি দুষ্প্রাপ্য নহেন। জল জিনিসটা নিত্য-প্রয়োজনীয়, অথচ ইহার দাম নাই। কিন্তু যদি কখন ঐটির একান্ত অভাব হয়, তখন রাজাধিরাজও বোধ করি একফোঁটার জন্য মুকুটের শ্রেষ্ঠ রত্নটি খুলিয়া দিতে ইতস্ততঃ করেন না। তেমনি—ঈশ্বর না করুন, যদি কোনদিন সংসারে নারী বিরল হইয়া উঠেন, সেই দিনই ইঁহার যথার্থ মূল্য কত, সে তর্কের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হইয়া যাইবে—আজ নহে। আজ ইনি সুলভ।

কিন্তু দাম যাচাই করিবারও একটা পথ পাওয়া গেল। অর্থাৎ পুরুষের কাছে নারী কখন, কি অবস্থায়, কোন্‌ সম্পর্কে কতখানি প্রয়োজনীয়, তাহা স্থির করিতে পারিলে নগদ আদায় হউক আর না হউক, অন্ততঃ কাগজে-কলমে হিসাব-নিকাশ করিয়া ভবিষ্যতে একটা নালিশ-মকদ্দমারও দুরাশা পোষণ করিতে পারা যায়। একটা উদাহরণ দিয়া বলি। সাধারণতঃ, বাটীর মধ্যে বিধবা ভগিনীর অপেক্ষা স্ত্রীর প্রয়োজন অধিক বলিয়া স্ত্রীটি বেশি দামী। আবার এই বিধবা ভগিনীর দাম কতকটা চড়িয়া যায় স্ত্রী যখন আসন্ন-প্রসবা; যখন রাঁধা-বাড়ার
লোকাভাব, যখন কচি ছেলেটাকে কাক দেখাইয়া বক দেখাইয়া দুইটা খাওয়ান চাই। তাহা হইলে পাওয়া যাইতেছে—নারী ভগিনী-সম্পর্কে বিধবা অবস্থায়, নারী ভার্যা-সম্পর্কীয়ার অপেক্ষা অল্প মূল্যের। ইহা সরল স্পষ্ট কথা। ইহার বিরুদ্ধে তর্ক চলে না! একটা শ্লেট-পেন্সিল লইয়া বসিলে নারীর বিশেষ অবস্থার বিশেষ মূল্য বোধ করি আঁক কষিয়া কড়া-ক্রান্তি পর্যন্ত বাহির করা যায়। কিন্তু কথা যদি উঠে, ইহার অবস্থা-বিশেষের মূল্য না হয়, একরকম বোঝা গেল, কিন্তু নারীত্বের সাধারণ মূল্য ধার্য করিবে কি করিয়া, যখন ইঁহার জন্য সোনার লঙ্কা নিপাত হইয়াছিল, ট্রয়-রাজ্য ধ্বংস হইয়া গিয়াছিল; আরও ছোট-বড় কত রাজ্য হয়ত ইতিপূর্বে নষ্ট হইয়া গিয়াছে, ইতিহাস সে কাহিনী লিপিবদ্ধ করিয়া রাখে নাই। এখানে এতবড় প্রয়োজন নারীতে কি ছিল যে সাম্রাজ্য ভাসাইয়া দিতেও মানুষ পরাঙ্মুখ হয় নাই, প্রাণ দিতেও দ্বিধা করে নাই। তোমার শ্লেটখানিতে জায়গা কত যে ইহার দাম তুমি কষিয়া বাহির করিয়া দিবে? কথাটা বাহিরের দিক হইতে অস্বীকার করি না, কিন্তু ভিতরের দিকে চাহিয়া আমি যদি প্রশ্ন করি, মানুষ রাজ্যের দিকে চাহিয়া দেখে নাই সত্য, কিন্তু তাহা কতটা যে নারীর দিকে চাহিয়া, আর কতটা যে নিজের অসংযত উচ্ছৃঙ্খল প্রবৃত্তির দিকে চাহিয়া—সে জবাব আমাকে কে দিবে?

নারীত্বের মূল্য কি? অর্থাৎ, কি পরিমাণে তিনি সেবাপরায়ণা, স্নেহশীলা, সতী এবং দুঃখে কষ্টে মৌনা। অর্থাৎ, তাঁহাকে লইয়া কি পরিমাণে মানুষের সুখ ও সুবিধা ঘটিবে। এবং কি পরিমাণে তিনি রূপসী! অর্থাৎ পুরুষের লালসা ও প্রবৃত্তিকে কতটা পরিমাণে তিনি নিবদ্ধ ও তৃপ্ত রাখিতে পারিবেন।

error: Content is protected !!